বিশ্বকাপের হিসেব ছাপিয়ে বাংলাদেশের পুরনো ‘ঐতিহ্য’ ফেরানোর মিশন

বাংলাদেশ
বিশ্বকাপের হিসেব ছাপিয়ে বাংলাদেশের পুরনো ‘ঐতিহ্য’ ফেরানোর মিশন
লালবাগ কেল্লায় ট্রফি উন্মোচনে শাই হোপ (বামে) ও মেহেদী হাসান মিরাজ (ডানে), বিসিবি
Author photo
ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
· ১ মিনিট পড়া
লাল সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়ে লালবাগ কেল্লায় তখন অপেক্ষা করছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক শাই হোপ তখনো এসে পৌঁছাননি। একটু দেরি হলেও তিনি এলেন। লোহার কলাপসিবল ফটক খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকলেন হোপ। চারপাশে তখন গণমাধ্যমের ক্যামেরার ছড়াছড়ি। কেউ ছবি তুলছেন আবার কেউ সেটাকে ভিডিও করছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন—তবুও ট্রফি উন্মোচন করতে দর্শনার্থীতে আসার সুযোগ ছিল না একদমই। নিরাপত্তাকর্মীরাও নিজেদের দায়িত্ব পালনে তখন ব্যস্ত।

সাধারণ দর্শনার্থী না থাকলেও খানিকটা ভিড় চেপেই ভেতরে ঢুকতে হলো হোপকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক আসতেই তাকে স্বাগত জানালেন মিরাজ। সকালে মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের অনুশীলন। তারকা অলরাউন্ডার তাই একটু তাড়াহুড়োতে ছিলেন। সবশেষ কয়েক বছরে ট্রফি উন্মোচনে খানিকটা ভিন্নতা এনেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যার অংশ হিসেবেই মিরাজ ও হোপকে সকালের ‍সূর্য্য উঁকি দিতেই নিয়ে আসা হয়েছে পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লাতে।

ছবিতে লালবাগ কেল্লা বলতে যা বোঝায় সেটা আদৌতে পরী বিবির সমাধির ছবি। সুবাহ বাংলার মুঘল সুবেদারশায়েস্তা খানের কন্যা ছিলেন ইরান দুখত রহমত বানু। তবে তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন পরী বিবি। লাল ইট, মার্বেল ও কষ্টিপাথরে বানানো হয়েছে পরী বিবির চতুষ্কোণ মাজার। ট্রফি উন্মোচনের পুরো আয়োজনটা রাখা হয়েছে সেই মাজারের সামনেই। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের ট্রফি রাখা হয়েছে একটা বক্সে। সোনালি ট্রফিকে তখনো সকালের সূর্যের আলোর স্পর্শ করতে পারেনি।

ট্রফির বক্সের সামনেই রাখা হয়েছে আরেকটি বক্স। সেটাতে অবশ্য একটা লাল বাটনও আছে। একজন এসে দুই অধিনায়কে বুঝিয়ে দিলেন, লাল বাটনে চাপ দিলেই বেরিয়ে আসবে ট্রফি। গণমাধ্যম কর্মীদের ক্যামেরার লেন্স তখন পুরোপুরি ফোকাসে। হোপ লাল বাটন চাপলেন, হোপের আঙুলের উপর আঙুল রেখে বাটনে চাপ দিলেন মিরাজও। বক্স থেকে বেরিয়ে এলো সোনালি ট্রফি। দুই অধিনায়কের মুখে তখন চওড়া হাসি। সিরিজ শেষে হয়ত হাসবেন কেবল একজন?

শেষ হাসিটা কার হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে অন্তত আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। ১৮ অক্টোবর থেকে মিরপুরে হতে যাওয়া সিরিজটা দুই দলের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৭ বিশ্বকাপ খেলার জন্য দুই দলের কাছেই আছে ওই লাল বাটনটা। শেষ পর্যন্ত কে দখল নিতে পারবে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। ২০২৭ সালে সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়েতে হবে পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপ।

স্বাগতিক হিসেবে আগেই বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়েছে সাউথ আফ্রিকার। আইসিসির ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিং থেকে খেলার সুযোগ পাবে আরও ৮টি। আইসিসির বর্তমান ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে নয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দশে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। মিরাজরা যদিও ক্যারিবীয়দের চেয়ে এখনো ৬ পয়েন্টে পিছিয়ে। সাউথ আফ্রিকা সেরা আটে থাকায় ২০২৭ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে সেরা নয়ের মধ্যে থাকতে পারলে পাওয়া যাবে সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার টিকিট।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে সবশেষ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে গেছে। যদিও সেই সমীকরণ মেলাতে ২৪ ম্যাচে হাতে আছে বাংলাদেশের। প্রতিপক্ষ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ভারত কিংবা সাউথ আফ্রিকার মতো দল থাকায় বাংলাদেশকে এগিয়ে থাকতে হবে চলতি সিরিজেই।

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করতে পারলেই কেবল তাদের পেছনে ফেলে নয়ে উঠতে পারবেন মিরাজরা। ফিল সিমন্স অবশ্য এসব পরোয়া করছেন না একদমই। বাংলাদেশের প্রধান কোচের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজটি অন্য আরেকটি সিরিজের মতোই। যদিও সবশেষ সিরিজে নিজেদের ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করে শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগালেন সিমন্স।

বাংলাদেশের প্রধান কোচ বলেন, ‘কোনো সংস্করণ খেলতে ভুলে যাওয়ার ব্যাপার এটি নয়। স্রেফ একটি বাজে সিরিজ গিয়েছে আমাদের, যেখানে আমরা ভালো জুটি গড়তে পারিনি, বিশেষ করে মাঝের ওভারগুলোয়। শুরুতে জুটি হয়েছে, মিডল অর্ডার ভেঙে পড়েছে। শ্রীলঙ্কাতেও (আগের সফরে) কিছুটা দেখেছি আমরা, সহজেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। এরপর একটি রান আউট এবং দ্রুতই আমরা ছয় উইকেট হারিয়ে ফেলি।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘ব্যাপারটি তাই এটি উপলব্ধি করার যে, মাঝের সময়টায় আমাদের জুটি গড়তে হবে এবং ছেলেরা এখানেই কাজ করার চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব। একটি বাজে সিরিজ আমাদের গিয়েছে এবং মানছি যে, ব্যাটাসম্যানরা খারাপ করেছে। তবে শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাদের।’

সিমন্স এটিতে স্রেফ একটি সিরিজ হিসেবে দেখলেও ড্যারেন স্যামির কাছে বাংলাদেশ সফর ২০২৭ বিশ্বকাপ খেলার অভিযান। সবশেষ কয়েক বছরে একটু একটু তলানিতে নামতে শুরু করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দৌরাত্মে এক সময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের এখন বিশ্বকাপ খেলতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হয়। ২০২৩ বিশ্বকাপে তো বাছাই পর্ব পেরিয়েও আসতে পারেনি।

নিজেদের পুরনো ঐহিত্য ফেরাতে ২০২৭ বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়ার বিকল্প নেই ক্যারিবীয়দের সামনে। স্যামিও তাই সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশকে হারিয়ে পয়েন্ট পেতে চান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রধান কোচ বলেন, ‘সাউথ আফ্রিকায় ২০২৭ বিশ্বকাপে সরাসরি জায়গা করে নেওয়ার অভিযানে আছি আমরা এবং দলের মনোযোগ এখন সেদিকেই। সরাসরি খেলার জন্য এই পয়েন্টগুলো পেতে চাই আমরা।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্ভাবনার জায়গা হতে পারে ব্যাটিং। সবশেষ আফগানিস্তান সিরিজে ব্যাট হাতে একদমই ভালো করতে পারেনি। একটু একটু ঝলক দেখালেও ওপেনিংয়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে ভালো খেলে ওয়ানডেতে সুযোগ পাওয়া সাইফ হাসান অবশ্য খানিকটা ছাপ রেখেছেন পারফরম্যান্সের। অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ার পর ছন্দে নেই নাজমুল হোসেন শান্তও। টপ অর্ডারের সঙ্গে নিয়মিতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে মিডল অর্ডারও।

মুশফিকুর রহিম কিংবা সাকিব আল হাসানরা চলে যাওয়ার পর মিডল অর্ডারে সেইরকম কাউকে পায়নি বাংলাদেশ। তাওহীদ হৃদয় নিয়মিত চারে খেললেও এখনো নিজেকে ওই জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। কয়েকটা ম্যাচে ভালো করলেও হৃদয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা অধারাবাহিকতা ও স্ট্রাইক রোটেট করে খেলতে না পারা। জাকের আলী অনিক, শামীম হোসেন পাটোয়ারির মতো ফিনিশার দিয়ে মিডল অর্ডার সামলানোর চেষ্টায় টিম ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে পুরোপুরি। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে।

মিডল অর্ডারের এমন দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ডাকা হয়েছে মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন। টানা ব্যর্থ হওয়ায় স্কোয়াডে থাকলেও ম্যাচ খেলায় বিশ্রাম দেয়া হতে পারে জাকেরকে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম ম্যাচেই অভিষেক হতে পারে অঙ্কনের। যদিও সেটার নিশ্চয়তা দেননি বাংলাদেশের প্রধান কোচ। সিমন্স বলেন, ‘আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি আমরা কী করতে যাচ্ছি। আজকে সন্ধ্যায় অনুশীলনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিব।’

সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মিরপুরের কালো উইকেট। গামিনি ডি সিলভাকে সরিয়ে দেয়ার পর মিরপুরের উইকেটের দেখভাল করছেন টনি হেমিং। উইকেট প্রায়শই কালো দেখালে গেলেও এবার সেটাতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। ছোট ছোট কাটা ঘাস ব্যবহারের পরিবর্তে মাটি, সিল্ট ও কালো ক্লে ব্যবহার করেছেন হেমিং। এমন উইকেট দিয়ে স্যামি তো সরাসরিই বলে দিলেন, ‘এমন উইকেট আমি আগে কখনো দেখিনি।’

বাংলাদেশের প্রধান কোচের উত্তর, ‘আমার চেয়ে মিরপুরের উইকেট সম্পর্কে আপনারা বেশি ভালো জানেন।’ সবশেষ চার সিরিজের সবকটিতে হার। ১২ মাসে ১৪ ম্যাচে খেলে বাংলাদেশ জিততে পেরেছে মাত্র দুইটিতে, সাথে বিশ্বকাপ খেলার সমীকরণ। তবে ২০২৭ বিশ্বকাপের সরাসরি টিকিট কিংবা মিরপুরের কালো উইকেট—এসব ছাপিয়ে মিরপুরে কাল থেকে বাংলাদেশের লড়াইটা শুরু হচ্ছে পছন্দের ফরম্যাটে নিজেদের পুরনো ঐতিহ্য ফেরানোর।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশ