আমাদের হেড মাস্টারই দরকার

ছবি:

ক্রিকেট খেলাটা ঠিক ফুটবল নয়।
ক্রিকেট কোচ-নির্ভর খেলা নয়। এটা মূলত অধিনায়ক নির্ভর খেলা। ক্রিকেটে কোচের আবির্ভাবও খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। আগে ক্রিকেট দলে ম্যানেজার বলে একটা পদ ছিলো; তার কাজ ছিলো টিম ম্যানেজ করা। মাঠের খেলা নিয়ে তার খুব একটা মতামত থাকতো না। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে ক্রিকেটে কোচের আবির্ভাব ঘটলো।
কিন্তু আজও অবদি ক্রিকেট বিশ্বে এটা একটা বিতর্কিত বিষয় যে, একটা সিনিয়র জাতীয় দলে হেড মাস্টার সুলভ, ফুটবল স্টাইলের কোচ দরকার আছে কি না।
শেন ওয়ার্ন মনে করেন, ক্রিকেট দলের সাথে কোচের উপস্থিতি একটা উৎপাত মাত্র।তার মতে ক্রিকেট দলে মাস্টারসুলভ কোচ থাকলে দলের ক্ষতি হয়। কিছুদিন আগে মাইকেল ক্লার্ক বললেন, সোনালী দিনের অস্ট্রেলিয়া দলে কোচ হিসেবে বুকানন না হয়ে তার পোষা কুকুরটা থাকলেও একই ফলাফল আসতো। ইমরান খানের আমলে পাকিস্তানে কোচ তো বটেই, নির্বাচক কমিটিরও খুব একটা পাত্তা ছিলো না। ইমরানই ঠিক করতেন সব।
শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়দের ভারতীয় দলে যখন মাস্টার টাইপ কোচ গ্রেগ চ্যাপেল এলেন, রীতিমতো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো দল। তারা বুঝতে পেরেছিলো, এরকম প্রতিষ্ঠিত সব খেলোয়াড়দের পাশে জন রাইটের মতো ‘ইয়েস স্যার’ কোচ দরকার। যে বড় জোর খেলোয়াড়দের মন বোঝার চেষ্টা করবে।
মূলত বড় দলগুলো তাই করে। মাস্টার নয়, তারা দলে একজন মোটিভেটর বা স্ট্রাটেজি বিশেষজ্ঞ রাখে কোচ হিসেবে।

কিন্তু এই সব আলোচনাই ‘বড় দল’ গুলোর জন্য।
আমরা যতদিন ছোট দল ছিলাম, ততোদিন এসব আলোচনা আমাদের জন্য সত্যি ছিলো না। আমাদের মাস্টার টাইপ কোচই দরকার ছিলো। দাই ডেভ হোয়াটমোর, জেমি সিডন্স বা চান্দিকা হাথুরুসিংহে ছিলেন আমাদের জন্য জরুরী। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের উত্থানপর্বে আমার অন্তত মনে হয়েছিলো, বাংলাদেশ এই পর্ব পার করে এসেছে। এখন বাংলাদেশের মাস্টার টাইপ কোচ না হলেও চলবে।
আর তারই একটা বড় পরীক্ষা ছিলো গতকাল শেষ হওয়া দুটি সিরিজ ও একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট।
যদিও বোর্ড সভাপতি খানিকটা হালকা চালে বলেছিলেন, এই সময়ে আমাদের কোচ হবেন মাশরাফি-সাকিবরা। আমি বিশ্বাস করেছিলাম, তারা স্ট্রাটেজিক্যাল দিক থেকে এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থায় চলে গেছেন। এখন আর দলে মাস্টার দরকার নেই। কেবল ড্রেসিং রুমে একজন মোটিভেটর দরকার এবং স্ট্রাটেজি নিয়ে কিছু কাজ করতে পারে, এমন লোক দরকার।
এখানেই খালেদ মাহমুদ সুজন ম্যারাডোনার মতো ব্যর্থ হলেন।
২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপে ফিরে যাই। আর্জেন্টিনা খেলছিলো ম্যারাডোনার কোচিংয়ে। তার কোচিং অভিজ্ঞতা বলে কিছু ছিলো না। স্রেফ আবেগ দিয়ে দল চালাচ্ছিলেন। যতক্ষন অবদি প্লান-এ দিয়ে কাজ হয়, ততোক্ষন ম্যারাডোনা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। নাইজেরিয়া-টিয়াকে গুড়িয়ে দিলো তার দল। কিন্তু যেই না জার্মানি প্লান-বি নিয়ে এলো, ম্যারাডোনা পালানোর পথ পেলেন না। তার হাতে কোনো উত্তরই ছিলো না।
ঠিক একই ঘটনা ঘটলো আমাদের সাথে। প্রথম তিন ম্যাচে আমরা জিম্বাবুয়ে এবং এই শ্রীলঙ্কাকে স্রেফ মাঠের বাইরে ফেলে দিলাম; গুড়িয়ে দিলাম। সেটা ছিলো প্লান-এ। কিন্তু গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হাথুরুসিংহে পকেট থেকে বের করলেন প্লান-বি। সুজন, হ্যালস্যাল বা সিনিয়র খেলোয়াড়; কারো কাছে এই বিকল্প প্লানের কোনো জবাব ছিলো না। আমরা স্রেফ উড়ে গেলাম, পালিয়ে গেলাম।
এরপর প্রতিটা ম্যাচে হাথুরু প্লান বদলেছেন এবং আমরা বিপাকে পড়েছি। বোঝা গেলো, আমরা দল হিসেবে এখনও মোটিভেটর দিয়ে চলার মতো জায়গায় যাইনি। আমাদের হেড মাস্টারই দরকার।
এখানে অবশ্য বাংলাদেশের একটা দূর্ভাগ্যও আছে। যে দুই সিনিয়রকে আমরা ভরসা করতে চাচ্ছিলাম, সেই মাশরাফি ও সাকিবকে সিরিজের অধিকাংশ সময় তো পেলামই না আমরা।
আমাদের জন্য এখনও দক্ষ কোচ দরকার, যিনি কি না খেলোয়াড়দের হয়ে স্ট্রাটেজিক্যাল কাজ করবেন এবং শাসনও করবেন।
স্বাধীনতার কথা আমরা খুব বলি। কিন্তু এই সিরিজ শিক্ষা দিলো, স্বাধীনতটা এখনই আমাদের জন্য নয়।