‘বোর্ড যদি মনে করে আমি সিন্ডিকেট করি তাহলে তারাই আমাকে বের করে দেবে’

বাংলাদেশ ক্রিকেট
‘বোর্ড যদি মনে করে আমি সিন্ডিকেট করি তাহলে তারাই আমাকে বের করে দেবে’
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, ক্রিকফ্রেঞ্জি
Author photo
আবিদ মোহাম্মদ
· ১ মিনিট পড়া
লম্বা সময় ধরেই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত কোচিং করাচ্ছেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে একের পর এক ট্রফি জেতায় আবারও দরজা খুলে জাতীয় দলের। গত বছর সিনিয়র সহকারী কোচ হিসেবে আরেক দফা বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচিং প্যানেলে যুক্ত হন তিনি। তবে চলতি বছর সবার তোপের মুখে পড়তে হয় তাকে। সবশেষ কয়েক সিরিজে কিছু কিছু ক্রিকেটারদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

এশিয়া কাপের পর আফগানিস্তান সিরিজে স্কোয়াডে নুরুল হাসান সোহান থাকার পরও জাকের আলী অনিককে দিয়ে কিপিং করানোতেও নাম এসেছে সালাহউদ্দিনের। অথচ বাংলাদেশের সিনিয়র সহকারী কোচই চেয়েছিলেন কিপিং করুক সোহান। সালাহউদ্দিন জাতীয় দলে সিন্ডিকেট চালান, এমন খবরও চাউর আছে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। কদিন আগে পদত্যাগ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। যদিও ২০২৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছেন তিনি। এসব নিয়েই ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘আবিদ মোহাম্মদ’ এর সঙ্গে মনখুলে কথা বলেছেন দেশসেরা এই কোচ।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আয়ারল্যান্ড সিরিজের আগে আপনি অনেকটা অভিমান করেই পদত্যাগ করেছিলেন। এখন আবার থেকে যাচ্ছেন। অভিমানটা কী ভেঙেছে?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— ওইটা আসলে অভিমান না, একটু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আমার মনে হয় এটা আমরা ভালোভাবে (সমাধান করেছি)....। এটা নিয়ে এখন কোনো সমস্যা নাই।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি আগেও বাংলাদেশের কোচিং প্যানেলে ছিলেন। ১৫ বছর পর এসে একটু কঠিন হচ্ছে কিনা। কতটা উপভোগ করছেন আপনি?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— একটা বিষয় আমার খুব ভালো আছে, এটা আমি নিজেও বলি...আমি যখন মাঠে ঢুকি তখন আমার মনে ভেতরে কী হচ্ছে বা আমার পরিবারের কী হচ্ছে এটা আপনি কোনদিনও বুঝতে পারবেন না। আমি এই জিনিসটা (কোচিং) সবসময় উপভোগ করি। আমি যেরকম অবস্থায় থাকি না কেন যখন মাঠের ভেতরে ঢুকি তখন আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই। কোচিং করাতে আমার সবসময় ভালো লাগে। যেকোন পরিস্থিতিতেই আমি এটা করতে পারি।

আমার বাসায় যদি আমার আম্মাও অসুস্থ থাকে, আমার স্ত্রীও অসুস্থ থাকে— এগুলো আমাকে খুব বেশি ম্যাটার করে না। যখন আমি মাঠের ভেতরে ঢুকি তখন আমি একেবারে অন্যরকম মানুষ। মাঠে থাকতে পছন্দ করি। এই কারণেই মনে হয় আমি সবসময় সুখী থাকি। আমি বাচ্চাদের সাথেও কোচিং করাতে পারি, বড়দের সাথেও পারি। আমি সবার সাথেই মানিয়ে নিতে পারি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি আসার পর আশরাফুলও জাতীয় দলের কোচিং স্টাফে সুযোগ পেলেন। আপনাকে দেখে হয়ত আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবে। আপনি হয়ত একজন পথপদর্শক হিসেবে থাকবেন, এটা ভাবলে কেমন লাগে?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— দেখুন, অনেক ছোট বেলা থেকেই আমার এই (দেশীয় কোচদের পথপদর্শক) ইচ্ছেটা ছিল। ছোটবেলা থেকেই ওই ইচ্ছেটা আমি যেন বাংলাদেশের কোচদের জন্য কিছু করতে পারি। আর্থিক দিক বলুন কিংবা সামাজিক দিক দিয়ে বলুন— সবদিক দিয়েই। অনেক সাক্ষাৎকারে আমি আগেও বলেছি। আমি যদি এখানে ভালো করি তাহলে পরবর্তীতে বাংলাদেশের ক্রিকেট কোচদের বড় একটা পথ হয়ে দাঁড়াবে।

এটাও আমি সবসময় বলি যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি তাদের জন্যও আমি আসলে একটা অনুপ্রেরণা। কারণ আমিও ভালো ক্রিকেট খেলিনি। কিন্তু তারপরও আমি একটা জায়গায় কোচিং করতে পারছি। অনেক সময় অনেক কোচ খুব আশাহত হয়ে যায় যে আমরা তো ক্রিকেট খেলিনি, আমরা কী সামনে এগোতে পারব? তাদের জন্য আমি একটা অনুপ্রেরণা হতে পারি...আমি যদি পারি তাহলে অন্যরা কেন পারবে না। যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার আছে তাদের হয়ত একটু বাড়তি সুবিধা থাকবেই।

কিন্তু না খেলেও যে পারা যায় সেটাও এখন সবার মধ্যে বিশ্বাস থাকবে সবসময়। আমি ভালো করলে তাদের জন্য অনেক বড় একটা অনুপ্রেরণা হবে। আমি সবসময় চেষ্টা করি আমার কোচদের আপগ্রেড করতে, যারাই আমার সাথে থাকে। আমার সবসময় ইচ্ছে থাকে তারা যেন একটু ভালো লেভেলে কোচিং করাতে পারে। আর্থিক দিক দিয়ে হোক বা জ্ঞানের দিক দিয়ে হোক তারা যেন একটু উপরে উঠতে পারে। সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই লাভ হবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি একটা জায়গায় বলেছিলেন একজন খেলোয়াড় হয়ত ৫ ম্যাচ অফ ফর্ম আছে মিডিয়া সেটাকে ২৫ ম্যাচ নিয়ে যায়। জাকের ভালো করছেন না, হৃদয়কে নিয়েও কথা হচ্ছে উনি অফ সাইডে মারতে পারেন না। সমস্যাগুলো উতরাতে আপনারা এখন কী কী কাজ করছেন?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমার ড্রেসিং রুম। বাইরে থেকে আপনি বিশ্লেষণ করতে পারে, আপনি খুঁত ধরিয়ে দেন। কিন্তু দিন শেষে আমার ওই ছেলেটার মানসিকতা বুঝতে হয়, ছেলেটার অবস্থান বুঝতে হয় ছেলেটা কোন অবস্থায় আছে। কারণ আপনি দেখেন বাইরে যতক্ষণ খেলে। আমি তো তারে মোটামুটি ২৪ ঘণ্টা দেখি।

আমার মনে হয় যারা ভেতরে আছে তারাই ভালো বুঝতে পারবে কার কখন কী লাগবে বা লাগবে না। কার কতটুকু সীমাবদ্ধতা, কাকে কীভাবে এগোতে হবে সেটা ভালো বুঝবে। এগুলো নিয়ে আসলে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। বললাম না আমরা চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত যেন আমাদের দল হিসেবে বা ব্যক্তিগতভাবে উপরে তুলতে পারি। সেটার জন্য আমাদের এগোতে হবে। সেটার জন্য ম্যানেজমেন্ট আছে, বোর্ড ওইদিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

বাইরে দেখুন, দুনিয়ার সব জায়গায় কিন্তু এগুলো হয়, হবেই। বাইরে থেকে বিশ্লেষণ করবে এটা পারে না ওইটা পারে না। আমরা কোচিং স্টাফ যারা আছি তারা কিন্তু ধারাভাষ্যকার না যে বলে দিলাম একটা। আমাদের কাজ হচ্ছে সমাধান বের করা। সমাধান বের করতে গিয়ে আপনি একটা বলে দিলেন আর সমাধান হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন না। সবকিছুর একটা প্রক্রিয়া আছে, উপায় আছে। আমরা ওইভাবে চেষ্টা করছি এগোনোর জন্য।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনাকে নিয়ে একটা কথা চাউর আছে আপনি সিন্ডিকেট করেন, হেড কোচের চেয়েও আপনার আধিপত্য বেশি। এসব শুনলে কেমন লাগে?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— দেখুন, এটা আসলে ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগার বিষয় না। মানুষ বাইরে থেকে অনেক কিছুই বলতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি আমার উপরে সুপিরিয়র আছে, যারা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে বা আমার বস, হেড কোচ তারা কী মনে করছে...আমার ড্রেসিং রুমের খেলোয়াড়রা আমাকে নিয়ে আসলে কী মনে করছে, ক্রিকেট বোর্ড কী মনে করছে সেটা আমার কাছে মূখ্য বিষয়। অন্যরা কী বলল সেটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।

তারা আমাকে বিচার করবে আমি আসলে কেমন মানুষ। কারণ তাদের মাধ্যমে আমি নিয়োগ পেয়েছি। এখন তারা যদি মনে করে আমি সিন্ডিকেট করি তাহলে তারাই আমাকে বের করে দিবে। এটা কাউকে বলা লাগবে না। তারাই তো বিচার করবে। ড্রেসিং রুমে তো এখন আমাদের পরিচালকরাও আছে। আমি মনে করি না এটা নিয়ে আসলে আমার ভাবনা চিন্তা করার কোনো বিষয় আছে। বাইরে যাদের বলার তারা বলবেই। আমি তো বললাম আমার সুপিরিয়র কী মনে করে, আমার হেড কোচ কী মনে করে, ক্রিকেট বোর্ড, ক্রিকেট অপারেশন্স কী মনে করে আমার কাছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: জাকেরের শুরুটা ভালো হলেও এখন সময়টা ভালো যাচ্ছে না। রান না পাওয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচনা হচ্ছে। কতটা সামলাতে পারছে বলে মনে হয়?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— দেখুন, প্রত্যেকটা জিনিসই আপনাকে সামলানো শিখতে হবে। আপনি যখন টপ জায়গায় থাকবেন তখন আপনার পেছনে অনেক লোক থাকবে, সমালোচনা হবে। ভালো করলে বাহবা দেবে, খারাপ করলে কথা বলবে। এটা আপনাকে সামলানো শিখতে হবে। জাকের যদি এটা পজিটিভলি নেয় এবং মেন্টালি যদি টাফ হয় তাহলে সে এখান থেকেও বের হতে পারবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি আসলে সে সহজে সামলাতে নিতে পারবে। আমি মনে করি এটা তার জন্য একটা শিক্ষার বিষয় কীভাবে চাপ সামলাতে হয়।

এখান থেকে সে যখন বের হয়ে যাবে আমার মনে হয় এরপর আর কোনদিন ওই সমস্যাটা হবে না। মানসিক বিষয়য়ের কথা যেগুলো বললেন এগুলো সামলানোর জন্য আপনাকে কিছু টেকনিক জানতে হবে। সেটা হয়ত আস্তে আন্তে শিখে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ থাকবে, সাপোর্টারদের চাপ থাকবে। এটা থেকে সে যখন বের হবে তখন দিন শেষে তারই অনেক লাভ হবে। সে মেন্টালি আরও টাফ হবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। অনেকে অনেক সময়ই মিমস পাঠায়, আপনাকে নিয়ে কী নেগেটিভ কথা হচ্ছে সেটাও হয়ত পাঠায়। আপনি কীভাবে সামলান বা কী ক্রিকেটারদের কী পরামর্শ দেন?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— অনেক সময় আমিও ছেলেদের বলি তোমরা এসব দেইখো না। কিন্তু এগুলো অনেক সময়ই চোখের সামনে চলে আসে। চেষ্টা করা উচিত কীভাবে এটা এড়িয়ে চলা যায়, কীভাবে সামলানো যায়। নেগেটিভ জিনিস থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায় সেটার জন্য আপনাকে এটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

আমার উপায় এক রকম, আরেক জনের উপায় আবার আরেক রকম। কিন্তু আপনাকে শিখতে হবে আপনি কীভাবে উপায় বের করতেছেন। দিন শেষে সমালোচনা হবেই। খারাপ খেললে সমালোচনা হবে, এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। আপনি যে পেশায় আছেন এই পেশায় এটা হবেই। কিন্তু আপনাকে সামলানো শিখতে হবে।

ধরুন, বললাম খেলার সময় চাপ আসে। কিন্তু চাপ কী দেখা যায়? চাপ তো দেখা যায় না। অনেকে তো চাপ নিয়েও ভালো খেলে, পারফর্ম করে। এটা আসলে আপনাকে শিখতে হবে। আমার মনে হয় জাকেরও এক সময় শিখে যাবে। আগে হয়ত শান্ত, লিটনদের ব্যাপারে অনেক বলা হয়েছে। তারা সবাই এখন এটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তারা জানে এখন কীভাবে এসব জায়গা থেকে বের হতে হয়। তারা ওইটা ভালোভাবে শিখে গেছে। আমার মনে হয় জাকেরও একটা সময় শিখে যাবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: সাদমান গত এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করলেন কিন্তু বিপিএলে দল পেলেন না। মিডিয়াতে বলেছেন কেউ ডাকলেও আর খেলবেন না। তাঁর গায়ে টেস্ট ক্রিকেটার তকমার জন্যই হয়ত সে দল পায়নি। তাকে নিয়ে কী বলবেন?

মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন— তকমা (টেস্ট ক্রিকেটার) আসলে কেউ কাউকে বলে দেয় না। এটা হয়ত মুখে মুখে হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি নিজেও হতাশ যে সাদমান কোন দল পায়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে সে সাদা বলেও ভালো করবে এবং ভালো করতেছে। তাঁর অনেক শটস আছে যেগুলো সাধারণ আমরা যাদের স্পেশালিস্ট সাদা বলের ক্রিকেটার বলি তাদের চেয়ে অনেক ভালো এবং সে ধারাবাহিকভাবে রান করছে।

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, কারণ সে অনেক ছোট বেলা থেকেই সাদা বলে সুযোগটা কম পাইছে। আমি শুধু সাদমানকে বলব সে যেন আশা না ছাড়ে। আপনি যদি টেস্ট খেলাটাও দেখেন টেস্টে কিন্তু তার স্ট্রাইক রেট অনেক ভালো। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এবার সে অনেক হতাশ কারণ সে আশা করেছিল এবার হয়ত একটা দল পাবে। আমি মনে করি সাদা বলেও সে রান করবে। কারণ যে টেস্ট ক্রিকেটে রান করতে পারে আমার মনে হয় সে যেকোন ফরম্যাটেই রান করতে পারবে।

আরো পড়ুন: মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন