কাগিসো রাবাদা- এক কৃষ্ণাঙ্গ মানিকের গল্প

ছবি:

নেই কোন ছবি, নেই কোন পেপার কাটিং- যেটা দেখিয়ে কাউকে বোঝানো যাবে কাগিসো রাবাদার ছোট বেলার কাহিনী। ১৯৯৫ সালে জন্মের পর প্রথম তিন বছরই দাদা-দাদীর সাথে ছিলেন বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা এই প্রোটিয়া পেসার।
ছোট বেলার বেশিরভাগ সময় দাদা-দাদীর সাথে কাটাতে হবে... এটাই ছিল তখনকার সমাজব্যবস্থার নিয়ম। কিন্তু বেশি দিন না হতেই রাবাদার বাবা ছেলের দায়িত্ব নিয়ে নেন। আর এর পরেই বদলে যায় সব কিছু।
মূলত ক্রিকেট দিয়ে রাবাদাকে বিশ্ব চিনলেও ছোট বেলা থেকে স্থানীয় রাগবির প্রতিই তাঁর ছিলো যত আগ্রহ। বেড়ে ওঠার সময়ে স্থানীয় রাগবি দলের হয়ে নিয়মিত খেলতেনও তিনি। শুধু তাই নয়, পারফর্মেন্সও ছিল দেখার মত।
তবে রাগবির পাশাপাশি ক্রিকেটেও যথেষ্ট মন ছিলো রাবাদার। রাগবি খেলা শেষে সময় পেলেই বল হাতে নেমে পড়তেন তিনি। ১৪ বছর বয়স থেকেই স্কুলের ক্রিকেট দলে খেলা শুরু করেন রাবাদা। রাগবি ও ক্রিকেট সমানতালে খেলেছেন বেশ কিছু বছর।
স্কুল জীবনের শুরুতে রাগবির প্রতি আগ্রহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটকেই বেছে নেন প্রোটিয়া এই স্পিড স্টার। যার ফলে আজ গোটা ক্রিকেট বিশ্বের কাছেই পরিচিত তিনি একজন পেস তারকা হিসেবেই।
ছেলে বেলায় ক্রিকেট এবং রাগবিতে একের পর এক পুরষ্কারও জিতেছেন রাবাদা। অনূর্ধ্ব-১৩,১৫,১৭,১৯ সব পর্যায়ের ক্রিকেটেই অসাধারণ পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন তিনি।
সব পর্যায়ের ক্রিকেটেই বিচারকদের নিকট থেকে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে আজ জাতীয় দলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন রাবাদা। পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটের ব্যাটসম্যানদের এক ত্রাসের নামই হয়ে উঠেছেন তিনি।
যদিও তা খুবই কম সময়ের ব্যবধানেই, যা এর আগে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব কখনোই দেখেনি। মাত্র ২২ বছর বয়সী এই দক্ষিন আফ্রিকান পেসার ইতিমধ্যেই টেষ্ট ক্রিকেটে সেরা বোলারের খেতাব অর্জন করেছেন।
এত কম বয়সে এই অর্জনের মালিক এখন শুধুমাত্রই রাবাদা। ২২ বছর ২৩১ দিনেই তিনি জিতেছেন টেষ্ট ক্রিকেটের সেরা হবার অবিস্মরণীয় রেকর্ড। এর আগে যে রেকর্ডের মালিক ছিলেন ইংল্যান্ডের পেসার জর্জ লোহম্যান।
২২ বছর ২৫৮ দিনে এই রেকর্ড গড়েছিলেন লোহম্যান। জীবন যুদ্ধের ইতিহাসে যদি ১০ জন মানুষের সফলতার কথা বলা যায় তবে দেখা যাবে ৮ জনই এই যুদ্ধে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন, যার ভেতর রাবাদা একজন।
কে জানতো পেশায় বাবা চিকিৎসক ও মা আইনজীবি হওয়ার পরেও তাদের ছেলে একদিন তেমন কিছু না হয়ে এই পর্যায়ে আসবে। তাও আবার যে বাবার প্রিয় খেলা ছিল রাগবি! বাবারও ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে নামকরা রাগবি খেলোয়াড় হবে।

কিন্তু তার কিছুই হল না, তবে যেটা হয়েছে সেটাও ভাবার থেকে অনেক বড়ই বলা যায়। এতে যেকোন বাবা-মায়ের মন খারাপের থেকে আরো বেশি গর্ববোধ করাই কাম্য। আর ছেলের এই আগ্রহে কখনই মন খারাপ করতেন না রাবাদার বাবা। ছেলেকে নিজের ইচ্ছে মতোই ক্রিকেট খেলতে দিতেন তিনি।
বাবা এমফো রাবাদা এই প্রসঙ্গে বলেন, 'ছোটবেলায় আমি রাবাদাকে যে গতিতে নিয়মিত বল করতে দেখতাম, সেই সময়ে খুব কম বোলারই এমন বল করতো। সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা সময়ের ভেতর একটা ছিল।'
তবে রাবাদার বাবা খুব ভাল ভাবেই জানতেন তারা কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন বিধায় দলে জায়গা পাওয়া তাঁর ছেলের জন্য কতটা কঠিন। কেননা জাতিগত দাঙ্গার সাথে কঠোর ভাবে সম্পৃক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীরা।
যার বড় প্রভাব ছিল দক্ষিন আফ্রিকার ক্রিকেটেও। কোটার অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিন আফ্রিকান ক্রিকেট। এই কোটার কারণে ইচ্ছে থাকলেও কোন ক্রিকেটার ভালো খেলে দলে জায়গা পেতো না।
সুতরাং বর্ণবাদের কঠিন বেড়াজাল থেকে বের হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে জায়গা করে নেয়া সহজ কথা ছিল না। একথা খুব ভাল ভাবেই জানতেন রাবাদার বাবা এমফো রাবাদা। তার পরেও পিছু হটে যাননি তিনি।
ছেলেকে সর্বদা উৎসাহ দিয়ে গেছেন ক্রিকেট খেলার জন্য। রাবাদার ১৪-১৮ বছরের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ খেলাই তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। বলা যায় ক্রিকেটে আসার ক্ষেত্রে পরিবারের কাছ থেকে সবধরনের সাপোর্টই পেয়েছিলেন রাবাদা।
ক্রিকেট ব্যয়বহুল খেলা হওয়া সত্ত্বেও ছেলেকে খেলা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে এসেছে রাবাদার পরিবার। প্রোটিয়া এই পেসারের বাবা সেসময়ের স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন,
'একদিকে আমরা ছিলাম কৃষ্ণাঙ্গ, যা উপেক্ষা করে ছেলে যখন মাঠে খেলে তা দেখা অনেক কঠিন ছিল। আর খেলাটা বেশ ব্যয়বহুল, শুধু তাই নয়, কাজের মাঝে ছুটি নিয়ে সময় দেওয়াটাও অনেক সমস্যার ব্যাপার ছিল। তবে আমার মনে হয় ঈশ্বর আমাদের সহায় ছিলেন।'
পরিবারের সমর্থন পুরোপুরি পেলেও রাবাদার জাতীয় দলে উঠে আসার গল্পটি অবশ্য যথেষ্ট কঠিনই ছিলো। কারণ বহুল জনসংখ্যার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রায় ৩০ দশমিক ৪ মিলিয়ন লোকের বাস এই দেশে। যার বেশির ভাগই কালো মানুষ।
তাও আবার অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানও খুবই খারাপ দেশটির। আর এরকম জায়গা হতে সেখানকার সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূল অবস্থা ভেদ করে কালো মানুষদের ভালো কিছু করা খুবই কঠিন। সেটাই করে দেখিয়েছেন রাবাদা।
পেছনে ফিরলে দেখা যাবে ১৯৯০ এর দশকেই অনেক বেশি বর্ণবাদের স্বীকার হয়েছে আফ্রিকান ক্রিকেট, যা দেশের রাজনীতির প্রভাবের ফল ছিলো। ১৯৯১ থেকে ২০১০ এর প্রথমের দিক পর্যন্ত আফ্রিকা সর্বমোট ৭২টি টেষ্ট ম্যাচ খেলেছে।
যার ভেতর বেশির ভাগ সময়েই মাত্র ১৫ জন সাদা বর্ণের ক্রিকেটার অংশ নিয়েছিল। শুধুমাত্র ৩ জন ছিলো আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ। এই তিনজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাখায়া এন্টিনি।
এমন কঠিন পরিস্থিতি খুব কাছে থেকেই দেখে আসার পরও ছেলেকে ক্রিকেটের পথ ধরে এগোতে উৎসাহ দেয় রাবাদার পরিবার। শুরু হয় স্বপ্ন দেখা, একদিন ছেলে প্রোটিয়া দলে খেলবেই। কঠিন বাস্তব মনে হলেও অসম্ভব কিছু নয়... এমন চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন রাবাদাও।
নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে রাবাদা নিজেই জানিয়েছেন কতটা কষ্ট করে এই অবস্থানে এসেছেন তিনি। ক্রিকেটে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি ছোটবেলায় দেখেছি আমার বাবা-মা কত কষ্ট করেছে, আমিও চাই কষ্টের মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে।'
নিদারুণ কষ্ট করে ক্রিকেটের জগতে পা রাখা রাবাদার পরবর্তী লক্ষ্য দলকে বৈশ্বিক কোনো শিরোপা এনে দেয়া যেটি এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা জিততে সক্ষম হয়নি। পাশাপাশি টেষ্টের মতো ওয়ানডে আর টি টোয়েন্টি দলেও নিয়মিত জায়গা করে নিতে চান তিনি।
এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে ২৫টি টেষ্ট, ২৩টি ওয়ানডে এবং ১৬টি টি-২০ খেলেছেন রাবাদা। টেষ্টে ৩.৩৬ ইকোনমি রেটে ১১৪টি, ওয়ানডেতে ৫.০৫ ইকোনমি রেটে ৭০টি এবং টি-২০ তে ৮.২৫ ইকোনমি রেটে পেয়েছেন ২২টি উইকেট। একই টেষ্টে ১০ উইকেট পাবার মত বিধ্বংসী বোলিং করেছেন ৩ বার। যেটাও এত কম বয়সী পেসারের ক্ষেত্রে বিরল।
বর্তমানে শুধু জাতীয় দলের জন্যই নয়, বিশ্বের জনপ্রিয় ক্রিকেট লীগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগেও (আইপিএল) রাবাদার চাহিদা আকাশচুম্বী। গত বছরের আইপিএল আসরেই তাঁকে ৫ কোটি রুপি দিয়ে দলে ভিড়িয়েছিলো দিল্লি ডেয়ারডেভিলস।
আইপিএলে খেলার সুযোগ পাওয়া প্রসঙ্গে রাবাদা জানিয়েছেন, 'আমি দেশ বিদেশে খেলতে চাই, অনেক খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে চাই। শিখতে চাই অনেক কিছু-ব্যাটিং ও ফিল্ডিংও। বল করতে চাই বিভিন্ন ধরনের কন্ডিশনে, যেমন- এশিয়ান উইকেটে, যেখানকার উইকেট স্পিন নির্ভর। সেখানে যদি ভাল করতে পারি তবেই অনেক কিছু শিখতে পারবো।'
আইপিএলকে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অন্যতম শেখার একটি উপলক্ষ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন রাবাদা। তাঁর ভাষায়, 'আইপিএল ছিল আমার জীবনের অন্যতম শিখার জায়গা, যেখানে আমি দিল্লির হয়ে খেলেছিলাম। বিশ্বসেরা সব খেলোয়াড়ের ভেতর খেলা যে কোন খেলোয়াড়ের জন্যই অনেক বড় বিষয়, যেটা আমার কাছেও তেমনি ছিল।'