কুকের আগেই যে বিরল রেকর্ড ছিলো বেলিমের

ছবি:

চলমান অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ টেস্টে দুর্দান্ত একটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ইংলিশ ওপেনার অ্যালিস্টার কুক। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৩২৭ রানের জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে কুকের বীরোচিত ইনিংসে ভর করে ৪৯১ রানে অলআউট করতে সক্ষম হয় ইংলিশরা।
ওপেনার কুক ইংল্যান্ডের ইনিংসের শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ২৪৪ রানে। আর এরই সাথে একটি দারুণ রেকর্ডে নাম লেখান ইংল্যান্ড ওপেনার। দীর্ঘ ২০ বছর পর মাইকেল অ্যাথারটনের পর ইংল্যান্ডের ওপেনার হিসেবে ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার রেকর্ড (ক্যারি দ্যা ব্যাট) গড়েছেন কুক।
তবে কুকের আগেই এই কীর্তি গড়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের তৎকালীন ওপেনার জাভেদ ওমর বেলিম। আজ থেকে ১৬ বছর আগে জিম্বাবুয়ের বুলাওয়েতে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে খেলতে নেমেই ক্যারি দ্যা ব্যাট হয়েছিলেন বেলিম।
সেই ম্যাচে ২৭৭ মিনিট উইকেটে থেকে ৮৫ রানে অপরাজিত থাকেন সাবেক এই টাইগার ওপেনার। কুকের সেই ইনিংসটি দেখে ১৬ বছর আগের সেই স্মৃতি আবারো ফিরে আসলো জাভেদ ওমরের।
ক্রিকেট ছেড়েছেন অনেকদিন আগেই। তবে এরপরেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি আজও স্মৃতিকাতর করে তোলে বেলিমকে। সম্প্রতি দেশের প্রথম সারির বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সাথে সেই ম্যাচ নিয়েই কথা বলেছেন জাভেদ ওমর বেলিম।
সাবেক এই টাইগার ওপেনার বলছিলেন, ‘খুব ভালো লাগে। মনে হয়, দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলে আমারও কিছু অর্জন আছে। এই অর্জনগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।’
২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এর ঠিক পরের বছরের এপ্রিল মাসে জিম্বাবুয়ে সফরে যায় বাংলাদেশ দল। বিদেশের মাটিতে নিজেদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরিজটি আসলেই অনেক বড় চ্যালেঞ্জিং ছিলো বাংলাদেশের জন্য।
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিক, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলদের মতো তারকাদের নিয়ে সাজানো জিম্বাবুয়ে দলটির বিপক্ষে খেলাটি মুখের কথা ছিলো না তৎকালীন বাংলাদেশ দলটির বিপক্ষে।
আর তাদের বিপক্ষেই ব্যাট হাতে দারুণ খেলেছিলেন জাভেদ ওমর। বুলাওয়ের প্রথম টেস্টে ৬২ রানের ইনিংস খেলার পর হারারেতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টে অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। পাশাপাশি ক্যারি দ্যা ব্যাটের রেকর্ডও গড়েন তিনি। সেদিনকার স্মৃতিচারণ করে বেলিম বলেন,

‘দলের জন্য তো চ্যালেঞ্জ ছিলই। আমার নিজেকে প্রমাণেরও একটা বিষয় ছিল। অভিষেক টেস্টটা খেলতে না পারার দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। বুলাওয়েতে প্রথম টেস্টে ফিফটি করে নিজেকে যেন ফিরে পেলাম।
এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৫ রানে অপরাজিত থেকে ব্যাট ক্যারি করলাম। ম্যাচটা আমরা হেরে না গেলে তৃপ্তিটা পুরোপুরি পেতাম। কিন্তু তারপরও ইনিংসটা অনেক সাহস জুগিয়েছিল।’
অবশ্য ইংলিশ ওপেনার অ্যালিস্টার কুকের ইনিংসটির সাথে তুলনা করতে নারাজ বেলিম। জানিয়েছেন কুকের ২৪৪ রানের ইনিংসটির কাছে নিজেরটি কিছুই নয়। তবে এরপরেও কুক ক্যারি দ্যা ব্যাট হওয়ার কারণেই পুরনো স্মৃতি জাগ্রত হয়েছে বেলিমের বলে জানান। তাঁর ভাষ্যমতে,
‘কুকের ইনিংসটার সঙ্গে হয়তো আমারটার কোনো তুলনাই হয় না। কিন্তু নিজেরটা তো মনে পড়েছেই। কুক ২৪৪ রান করে ব্যাট ক্যারি করেছিল, আমি ৮৫ করে ব্যাট ক্যারি করেছিলাম। কিন্তু তৃপ্তিটা এখানে একই তালিকায় আমরা দুজনেই আছি। ক্রিকেট খেলে এগুলোই তো অর্জন।’
তবে প্রিয় ইনিংসের কথা বলতে হয়ে জাভেদ ওমর এগিয়ে রাখেননি তাঁর বুলাওয়ে টেস্টের ইনিংসটিকে। বরং সেরার দিক থেকে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে ৪৩ রানের ইনিংসটিকেই সবার ওপরে রাখছেন সাবেক এই ব্যাটসম্যান। কেননা ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেই টেস্টে ৩৪০ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন বেলিম।
এত দীর্ঘ সময় ব্যাটিং করার পরও অর্ধশতকের দেখা পাননি তিনি। আর এরই মাধ্যমে একটি বিরল রেকর্ডে নাম লেখান জাভেদ ওমর। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ২০১৫ সালের আগে এত দীর্ঘক্ষণ ব্যাটিং করেও অর্ধশতকের দেখা না পাওয়া একমাত্র ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি।
তবে বেলিমের সেই রেকর্ডটি ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ভেঙ্গে দেন দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স। সেবার ৩৪৫ মিনিট ধরে ব্যাটিং করে ৪৩ রানই করতে সক্ষম হন তিনি।
আর বিরল এই রেকর্ডটির কারণে আজও নিজের সেই ইনিংসটিকে এগিয়ে রাখছেন জাভেদ ওমর বেলিম। বিশেষ করে তাঁর সেই ইনিংসটির কারণেই প্রায় অসম্ভব ম্যাচটিতে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়তে সক্ষম হয়েছিলো হাবিবুল বাশারের দলটি।
ঢাকার মাঠে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে ২৯৮ রান সংগ্রহ করেছিলো জিম্বাবুয়ে। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে ২১১ রানেই গুঁটিয়ে যায় বাংলাদেশ দল।
৮৭ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাটিং করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮৬ রান করতে সক্ষম হয় সফরকারী জিম্বাবুয়ে। ফলে টাইগারদের সামনে লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৩৭৪ রান। বিশাল এই লক্ষ্যে খেলতে নেমে জাভেদ ওমর ও নাফিস ইকবাল মিলে ৮৬ ওভার খেলেন।
ড্রয়ের জন্য খেলার দরকার ছিলো ১৫০ ওভার। শেষ পর্যন্ত বেলিম ও নাফিসের ব্যাটিং দৃঢ়তাতেই ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। বেলিম ৪৩ রান করলেও দারুণ এক সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন নাফিস।
আর এই ড্রয়ের ফলে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। কেননা সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ২২৬ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছিলো টাইগাররা। বেলিম বলছিলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা প্রথম টেস্ট জয় পেলাম। কিন্তু ঢাকার দ্বিতীয় টেস্টে পড়ে গেলাম কঠিন পরিস্থিতিতে।’
১৩ বছর আগেকার স্মৃতির কথা মনে করতে গিয়ে টাইগারদের এই সাবেক ওপেনার আরও বলেন, ‘ম্যাচ বাঁচাতে হলে ১৫০ ওভার কাটিয়ে দিয়ে আসতে হবে। সহজভাবে বললে, কাজটা ছিল অনেক কঠিন। আমাদের কোনো ব্যাটসম্যানেরই এত সময় ধরে ব্যাটিং করার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। নাফিস তো দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিই করে বসল।’
সেই ম্যাচে বেলিমের মূল লক্ষ্য ছিলো ক্রিজে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকা। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সেই লক্ষ্যে অবশ্য অবিচলই ছিলেন তিনি। আর সেই কারণেই ড্র করা সম্ভব হয়েছে ম্যাচটি। বেলিমের ভাষ্যমতে,
‘আমার লক্ষ্য ছিল আউট হব না। কিন্তু আবার একেবারে গুটিয়ে গেলেও চলবে না। মোট কথা, মাটি কামড়ে থেকে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। এই ইনিংসে ৪৩ রান অনেক গুরুত্বের। সেই ইনিংস বাংলাদেশকে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিততে সহায়তা করেছিল। ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ ছিল সেটি। সেখানে আমার একটা অবদান আছে। এই তৃপ্তি আমি আজীবন বয়ে বেড়াব।’
ছবি- সংগৃহীত