১১ বছরের ইয়ামিনের স্বপ্নের ২০ মিনিট

ছবি: ছবিঃ বিসিবি, রতন গোমেজ

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
রাজধানীর বনানী মাঠে ঢুকতেই দেখা মিললো মা-ছেলের। ১১ বছর বয়সী শেখ ইয়ামিন গুনছেন অপেক্ষার প্রহর। বারবার বোরখা পরিহিত মা ঝর্ণা আকতারকে জিজ্ঞেস করছেন উনি আসলে কি বলবো, কি জিজ্ঞেস করবো মা? মা তাঁর সন্তানকে বলছেন, 'জিজ্ঞেস করবে আপনার মতো হতে হলে কি করতে হবে, আমি যে বড় হয়ে আপনার মতোই হতে চাই।'
মাদ্রাসা ছাত্র ইয়ামিন তখনও হয়তো ঠাওর করতে পারেননি কি অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। এতটুকু বয়সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার কথা কয়জনই বা ভাবেন, এই বয়সে কয়জনই বা স্বপ্ন দেখেন আকাশ ছোঁয়ার! কিন্তু ছোট্ট ইয়ামিন দেখেছেন। আর তাঁর ইচ্ছে সৃষ্টিকর্তাও না রেখে পারেননি।
এবার আসা যাক ইয়ামিনের স্বপ্নের গল্প প্রসঙ্গে। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ বনানী মাঠে এসে উপস্থিত হন মুশফিকুর রহিম। ইয়ামিন তখনও মার পাশেই দাঁড়িয়ে ইতি উতি তাকাচ্ছিলেন। মুশফিক গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ইয়ামিন তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন।
সেই ছোট্ট বেলা থেকে যাকে চোখের সামনে দেখার স্বপ্ন দেখেছেন, যার মতো হওয়ার স্বপ্ন লালন করে গেছেন হৃদয়ের গহীন কোনে, সেই স্বপ্নের নায়ক মুশফিকই যে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে! হতবিহবল মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর মিনিট তিনেক মুশফিকের সঙ্গে গল্পে মাতলেন ইয়ামিন।

মুশফিকও দারুণ আগ্রহ নিয়ে শুনে গেলেন তাঁর ক্ষুদে ভক্তের বক্তব্য। এরপর ইয়ামিনের হাতে তুলে দিলেন নিজের স্বাক্ষর করা ছোট একটি ব্যাট, জাতীয় দলের একটি জার্সি এবং তাঁর ব্যবহৃত এক জোড়া ব্যাটিং দস্তানা (গ্লাভস)। 'স্বপ্নের মানুষের' কাছ থেকে পাওয়া এই উপহার পাওয়ার পর মুশফিককে প্রশ্ন করে বসলেন ইয়ামিন, 'আপনার মতো হতে চাই, কি করতে হবে?'
ইয়ামিনের এই প্রশ্নে স্মিত হেসে মুশফিক যা বললেন সেটি হয়তো ইয়ামিন নিজেই ভাবতে পারেননি। টাইগার উইকেটরক্ষকের উত্তরটি ছিল, 'তোমার এই বয়সে আমি তো এতো ভালো খেলতাম না। দোয়া করি আমার চেয়ে যেন ভালো খেলোয়াড় হও।'
মুশফিককে সামনে থেকে দেখার স্বপ্ন পূরণ হবে কখনো কল্পনাতেও ছিল না ইয়ামিনের। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা শক্তির ব্যাপ্তি যে আকাশ পর্যন্ত সেটিই যেন প্রমাণ হলো ছোট্ট ইয়ামিনের দ্বারা। মুশফিককে পেয়ে এবার নতুন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন তিনি।
বাংলাদেশের 'আগামী' মুশফিক হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে ইয়ামিনের ভাষ্য, 'আমার জীবনের স্বপ্ন ছিল আমি উনার সঙ্গে দেখা করবো। আল্লাহ আমার এই স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় কিছু আমার হতে পারে না। ইনশাআল্লাহ আমি মুশফিক ভাইয়ার মতো হতে পারবো।'
পল্টনের কবি নজরুল ক্রিকেট একাডেমিতে প্রায় প্রতিদিন অনুশীলন করেন ইয়ামিন। গত ১১ অক্টোবর বন্ধুরা এবং প্রশিক্ষক মাঠে আসার আগেই একাডেমিতে পৌঁছে যান ইয়ামিন ও তার মা ঝর্না আকতার। বাকিদের আসতে দেরি হওয়াতে মা এবং ছেলে নেটে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন।
দুজনের সেই ক্রিকেট খেলার মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করেন একটি জাতীয় দৈনিকের ফটোগ্রাফার। সেই ছবিগুলো দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরবর্তীতে মুশফিকুর রহিমের নজরে আসে অসামান্য সেই ছবিগুলো। এরপরের গল্পটি সকলেরই জানা।
ইয়ামিনের মতো আনন্দ কম নেই তাঁর মায়েরও। মুশফিককে নিজের ছেলের পাশে দেখে আনন্দের আতিশয্যে তিনি বলেই বসলেন, 'আমি আসলে বলে শেষ করতে পারব না, একজন মা হয়ে আমার ছেলে সুবাদে মুশফিকের সঙ্গে দেখা করেছি। সেও আমার ছেলের মতো। ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে আমি ভাবতে পারিনি। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ।'
ছেলের জন্য মা'র এমন ত্যাগ, সংগ্রাম ও ভালোবাসা দেখে মুশফিকও চুপ থাকেননি। শিশুটির প্রতি শুভকামনা জানিয়ে তিনি বলেছেন, 'আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে একজন সন্তানের স্বপ্ন পূরণ করতে মা যে ত্যাগ-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি আশা করছি এবং দোয়া করছি ও আমার চেয়ে অনেক বড় খেলোয়াড় হোক।'
ইয়ামিনদের মতো ক্ষুদে ভক্তদের ভালোবাসা পাওয়াটাকে অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন মুশফিক। ক্ষুদে এই ক্রিকেটারের জন্য সামান্য কিছু করতে পেরেও নিজেকে কৃতার্থ মনে করছেন তিনি। মুশফিকের বক্তব্য, 'আমাদের জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা এখনকার তরুণ সমাজ। ইয়ামিনের মতো এক-দুজন হলেও আছে যারা আমাদেরকে ফলো করে। ওদের জন্য এতোটুকু করার তৌফিক আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, খুব ভালো লাগছে। ওর মতো ক্রিকেটে আমাদের অনেক ভক্ত আছে সবারই, ইচ্ছা করলেও সবার সঙ্গে দেখা করা হয় না বা পারি না। কিন্তু ইয়ামিনের সঙ্গে আজ হয়েছে।'