‘টাকা না থাকায় একদিন ১০ কিলো হেঁটেও অনুশীলনে গিয়েছি’

ছবি: ক্রিকফ্রেঞ্জি

আগেরবার এশিয়া কাপ জিতলেও মারুফ মৃধা, মাহফুজুর রহমান রাব্বিদের পারফরম্যান্সের আড়ালে যেন পড়ে গিয়েছিলেন তরুণ এই পেসার। তবে সবশেষ যুব এশিয়া কাপে ১৩ উইকেট নিয়ে শিরোপাজয়ী নায়কদের একজন হয়ে উঠেছেন ইকবাল। বছরখানেক আগেও কেউ সেভাবে চিনতে না পারা ইকবালকে নিয়ে এখন আর আলোচনার শেষ নেই। গ্রামের বাড়ি কিংবা বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়া সবখানেই মিশে আছেন তিনি।
এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা-চারে যাদের ব্যাটে আলোর ছোঁয়া
২৪ ডিসেম্বর ২৪
মৌলভীবাজার উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের করিমপুরে জন্ম ইকবাল ইকবালের। পড়াশোনা, খেলাধুলা কিংবা শৈশবের রঙিন স্মৃতি! সবটা জুড়েই আছে করিমপুর। দুই বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ইকবাল ইমস পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়েও মেতে থাকতেন পড়ন্ত বিকেলে। স্কুলে মাঠে বিচরণ করেছেন ব্যাট আর বল হাতে নিয়ে। ক্রিকেটের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে মৌলভীবাজার ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন মামা শাহ পারভেজ।
মামার হাত ধরেই ইকবালের ক্রিকেটের পথযাত্রার শুরু। তরুণ এই পেসারের মামা পারভেজও ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। তবে পরিবারের সমর্থন কিংবা পারিপার্শ্বিকতা স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে নিজের স্বপ্ন পূরণে ভাগিনাকে পুরোটা সময় জুড়ে সমর্থন জুগিয়েছেন তিনি। বর্তমানে দেশের বাইরে থাকলেও ইমনের খেলা যেন টিভিতে দেখা যায় সেই স্বপ্নটা তাকে বুনিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন পারভেজ।
সিলেটে জাতীয় ক্রিকেট লিগ টি-টোয়েন্টি চলাকালীন ক্রিকফ্রেঞ্জিকে সেই গল্প শুনিয়েছেন ইকবাল। তরুণ এই পেসার বলেন, ‘একটা জিনিস দেখেন আমি যখন ছোটকাল থেকে শুরু করেছি তখন আমার মামা আমাকে স্বপ্ন দেখাতো যে তোমার খেলা টিভিতে দেখাতেই হবে। আমার স্বপ্ন এটা, তোমারও স্বপ্ন হতে হবে এটা। আমি তাঁর স্বপ্নকে অনুসরণ করছি এবং এটাকে নিজের স্বপ্ন হিসেবে রূপান্তর করেছি।’
মামা পারভেজের পাশাপাশি ইকবালের ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে অবদান আছে রাসেল আহমদের। ইকবালের পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে একাডেমির বেতন ফ্রি করে দিয়েছিলেন জেলার এই ক্রিকেট কোচ। ইকবাল বলেন, ‘হ্যাঁ, একাডেমিটা আমার জন্য ফ্রি করেছিল রাসেল স্যার। আমাকে বলেছিল ঠিক আছে তোর যেহেতু এই সমস্যা তোর জন্য একাডেমির বেতনটা ফ্রি করে দিলাম তুই অনুশীলন করিস।’

একাডেমিতে বেতন দিতো হতো না আবার মামারও পূর্ণ সমর্থন ছিল ইকবালের উপর। তবে বাড়ি থেকে একাডেমি অনেকটা দূরে হওয়ায় যাওয়া-আসা নিয়ে প্রায়শই কষ্ট করতে হতো তাকে। অনুশীলনের দিনগুলোতে বাবার কাছ থেকে কখনও একশ আবার কখনও দেড়শ টাকা পেতেন তরুণ এই পেসার। তবে একদিন টাকা না থাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে অনুশীলনে গিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কিংবা পাগলামো থেকেই এমনটা করেছিলেন ইকবাল।
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি অনেক স্ট্রাগল করেছি। একটা সময় হতো কি আমার বাসা থেকে একাডেমি অনেক দূর। আপনারাও হয়থ দেখেছেন বা শুনেছেন। আমি আব্বুর কাছ থেকে কখনও ১০০ আবার কখনও ১৫০ টাকা নিতাম। একদিন হয়েছে কি শুনুন মজার কথা একটা বলি। আমি একদিন অনুশীলন করার জন্য হেঁটে চলে গেছিলাম। তখন টাকা ছিল না। ছোটবেলা থেকেই এত পাগল ছিলাম। আমি প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো হেঁটেছি। তারপর সেখানে গিয়ে গাড়ি ধরেছি।’
ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনের পথটা ইকবালের জন্য একেবারেই যে সহজ ছিল না সেই গল্প তো তিনি নিজেই শুনিয়েছেন। ভাই-বোনদের মাঝে সবার বড় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তাঁর উপর দায়িত্বটাও অনেক বেশি। বাবা মো. আবু বকরকে যাতে উপার্জনে সহায়তা করতে পারেন, পরিবারও যাতে সচ্ছলভাবে চলতে পারে সে কারণে ক্রিকেট ছাড়তে বলা হয়েছিল তাকে। যদিও নিজের লক্ষ্য পূরণে অটুট ছিলেন ইকবাল। তবে একটা সময় এসে দুই বছর সময় বেঁধে দিয়েছিল পরিবার। কিছু করে উঠতে না পারলে ক্রিকেট ছাড়তে হতো তাকে! এমন শর্তে অবশ্য কোনভাবেই রাজী ছিলেন না তিনি।
নিজের প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অবশ্য স্বপ্নের পথে অনেকটা হেঁটেছেন ইকবাল। এত অল্প বয়সে বাংলাদেশের হয়ে দুটি যুব এশিয়া কাপ জিতেছেন। খেলেছেন যুব বিশ্বকাপও। চলমান এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে ঢাকা বিভাগের হয়ে ৬ ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছেন তরুণ এই পেসার। নিজেকে শাণিত করে যুবাদের হয়ে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ পাওয়ায় এখন আর ক্রিকেট ছাড়তে বলে না পরিবার।
ইকবাল বলেন, ‘আমার পরিবার থেকে একটা সময় বলেছিল ছেড়ে দাও। আমি ওদের বলেছিলাম হ্যাঁ, ছেড়ে দিব। যেহেতু এতদিন করছি আর দুইটা বছর চেষ্টা করি দেখি কি হয়। তারপর না হয় চিন্তা-ভাবনা করব। পরিবার থেকে অনেক চাপ দিলেও আমি বলছিলাম না আমি ক্রিকেট ছাড়ব না। তখন পরিবার থেকে বলে ঠিক আছে তোমার পেছনে যেহেতু শ্রম দিয়েছি তাহলে আরও দুইটা বছর সময় দিই। এখন আর এরকম বলে না।’
যুব দলের পর ঘরোয়া ক্রিকেটেও অভিষেক হয়েছে ইকবালের। সামনে তরুণ এই পেসারের চাওয়ায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে যুব বিশ্বকাপ জেতা। মামা ও নিজের স্বপ্ন পূরণে লাল সবুজের জার্সি গায়ে জাতীয় দলের হয়েও প্রতিনিধিত্ব করতে চান। ক্যারিয়ার শেষে অবশ্য নিজেকে দেখতে চান বিশ্বের সেরা পাঁচ কিংবা দশ বোলারের একজন হিসেবে। সেই সঙ্গে দেশের হয়ে ট্রফি জেতার স্বপ্নও দেখেন মৌলভীবাজারের এই পেসার।
ইকবাল বলেন, ‘শুধু ভালো খেলব এটা না, আমি আমার জায়গা থেকে চিন্তা করছি যখনই ক্রিকেট শেষ করব দেশের জন্য কিছু একটা করব ইনশাআল্লাহ। আমাদের ট্রফির অভাব আছে, আমি চাই একটা এনে দিতে ইনশাআল্লাহ। আমি যখন ক্রিকেট শেষ করব তখন আমি নিজেকে বিশ্বের সেরা ৫ থেকে ১০ বোলারের মাঝে দেখতে চাই। আসলে এটা আমার অনেক ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখছি।’