লিটন দাস ও কিছু প্রচলিত মিথ

ছবি:

লিটন দাস বাংলাদেশ টেস্ট দলের 'উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান'। দলে তার প্রথম দায়িত্ব উইকেট কিপিংটা ঠিকঠাক মত করা, ব্যাটিংটা উপরি পাওনা (যদি সে সাত নম্বরে ব্যাট করে থাকে)। পুরো দুনিয়া টেস্টে উইকেট কিপিংটাকে এভাবেই দেখে আসছে।
কিন্তু আমরা উইকেট কিপিংয়ের ধারনাকে একটু ভিন্ন চোখে দেখি। কিপিং নয়, ব্যাটিং নিয়ে উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের যোগ্যতা যাচাই করি। ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে ১৩টি টেস্ট খেলেছে ভারত। এক মৌসুমে শুধু উইকেট কিপার হিসেবে ঋদ্ধিমান সাহার পারফর্মেন্স দিয়ে ক্রিকেট পণ্ডিতদের বছরের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
সাহার ব্যাটিং ভারতের জন্য উপরি পাওয়া। কিপিংটা ঠিকঠাক মত করাই সাহার প্রাথমিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ দলে লিটনের প্রাথমিক দায়িত্বও উইকেট কিপিং। কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো ব্যাটসম্যান লিটন অনায়াসে টপ অর্ডারে খেলার যোগ্যতা রাখে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বার বার নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমান রেখেছেন তিনি।
প্রথম শ্রেণির এক মৌসুমে সর্বাধিক রানের রেকর্ডটিও লিটন দাসের। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ১০১২ রানের রেকর্ডটি ভেঙ্গেছেন তিনি। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই গড়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রান করেছেন এই ডানহাতি। 'চাপ শুন্য' লিটনের ব্যাটিং দেখে যে কেউই বলবে, 'এমন নিখুঁত চোখ আটকে ফেলা ব্যাটিং কিভাবে করতে পারে একজন ব্যাটসম্যান!'
ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডি পার করে টেস্ট ক্রিকেট নিজের অভিষেকেই নিখুঁত ব্যাটিংয়ের নমুনা দেখিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টে চল্লিশ ছাড়ানো ইনিংসটি যে দেখেছেন তার মনে গেঁথে যাওয়ার কথা। ভারতীয় ধারাভাষ্যকাররা লিটনের এক একটি অন ড্রাইভ, ফ্লিক শটে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু উইকেট কিপার হিসেবে দেশের সেরা এবং ব্যাট হাতে যোগ্য হওয়ার পরও গত দুই-তিন মৌসুমে কখনই দলে জায়গা পাকা ছিল না লিটনের। 'ব্যাটসম্যান' মুশফিক ও 'কিপার' মুশফিকে আসমান জমিন তফাৎ থাকার পরও বাংলাদেশ টেস্ট দলের নিয়মিত মুখ হতে পারেননি তিনি।

আমরা লিটনের কাছে মুশফিকের মত ব্যাটিং চেয়েছি, কিন্তু তার উইকেট কিপিংটা ভুলে গেছি। ২০১৫ থেকে এই সময়টা দলে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকা লিটন শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে নিশ্চিত ভাবে দলে জায়গা পায়। ঘাড়ে 'কিপার' মুশফিকের নিঃশ্বাস নেই, এই চাপ থেকে মুক্তি মিলতে লিটনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দুই বছর।
চাপ শুন্য লিটন ব্লুমফন্টেইনে দলের বিপদে ৭০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ঠিক পরের টেস্টেই সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট বাঁচালেন 'ব্যাটসম্যান' লিটন। সাকিবের অবর্তমানে সাত নম্বর নয়, পাঁচ নম্বরে ব্যাট করে খেলেছেন ক্যারিয়ার সেরা ৯৪ রানের ইনিংস। ম্যাচের পরিস্থিতি বিচারে লিটনের ইনিংসটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে জায়গা করে নিবে।
চিটাগং টেস্টের চতুর্থ দিনের শেষ বলে মুশফিকুর রহীমের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্কোর তখন ৮১/৩। ভালো শুরুর পর চোখের পলকে তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান সাজঘরে। তখনো সফরকারী দল শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস স্কোর থেকে ১১৯ রান দূরে মাহমুদুল্লাহর বাংলাদেশ দল।
চতুর্থ দিনের শেষ বেলায় বাংলাদেশের ইনিংস হার নয়তো বড় ব্যবধানের হার চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছিল। ভিন্ন চিন্তা ছিল লিটনের মনে। টেস্ট বাঁচাতে হলে পঞ্চম দিনের শুরুতে মাটি কামড়ে লড়াই করতে হত। অপরাজিত মমিনুলের সাথে নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে সমান দায়িত্ব নিতে হত বাংলাদেশের 'নাম্বার ফাইভ' লিটন দাসকে।
ক্রাফটি ইনিংস খেলতে পারেন লিটন, এমন সুনাম আগে থেকেই ছিল লিটনের। কিন্তু প্রথম ইনিংসে লেন্থ বল ছাড়তে গিয়ে শুন্য রানে আউট হওয়া লিটনের কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করে নি বাংলাদেশের সমর্থকরা। ক্যারিয়ারের মাত্র সপ্তম টেস্ট খেলতে নামা লিটন অবশ্য নেতিবাচক বাতাস গায়ে মাখেননি।
পঞ্চম দিন তার ব্যাটে আত্মবিশ্বাস দেখেছে বাংলাদেশ। শট মেকিং আর ডিফেন্সের মিশেলে চাপ সরিয়েছেন তিনি। দেড়শ ছাড়ানো জুটি গড়ে দলকে করেছেন বিপদমুক্ত। মমিনুলের মত সেঞ্চুরির দাবীদার ছিলেন তিনিও। কিন্তু মস্তিষ্ক বিস্ফোরণে সেঞ্চুরি থেকে ছয় রান দূরে থেকে ইতি ঘটে লিটনের স্মরণীয় ইনিংসের।
দ্বিতীয় ইনিংসে মমিনুল-লিটনের জুটিই বাংলাদেশকে চিটাগং টেস্টের পরাজয় এড়াতে সাহায্য করেছে। নিজের ছোট্ট টেস্ট ক্যারিয়ারে এটিই ব্যাটসম্যান লিটনের সেরা সাফল্য। মাত্র সাত টেস্ট পুরনো লিটন দাস বাংলাদেশের সম্পদ, আগে মুখে মুখে এই কথার চল ছিল। এখন সেটা বাস্তবে পরিনত হল। খুব তাড়াতাড়ি অসহিষ্ণু হয়ে পড়লে হয়তো অনেকের মতই অকালে হারিয়ে যাবে লিটন দাসের মত প্রতিভারা।
মাত্র ১১ ইনিংস খেলে ৩১ গড়ে ৩ ফিফটির মালিক লিটন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে একটি টেস্ট ম্যাচ বাঁচাতে সাহায্য করেছে, তাও আবার ব্যাটিং নিয়ে। আর কিপিং তো থ্যাংকসলেস জব। ক্যারিয়ারের শুরুতে মুশফিকের ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১১, ফিফটি মাত্র একটি (প্রথম ১৫ ইনিংস)। সেই মুশফিক আর আজকের মুশফিকের পার্থক্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই।
এত দ্রুত লিটন দাসকে পায়ের তলায় পিষ্ট না করে সময় দেয়া হোক। কাঁধে হাত দিয়ে বলে দেয়া হোক, 'তুমি আমাদের স্থায়ী টেস্ট উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। দলের বিশ্বাস আছে তোমার উপর। তুমি শুধু পারফর্ম করে যাও।'