মাশরাফিঃ আমাদের ডেনিস লিলি

ছবি:

'অ্যা কমপ্লিট ফাস্ট বোলার...' কথাটার সাথে ডেনিস লিলির নাম জুড়ে দেয়া যায় অনায়াসেই। ক্রিকেটের বাইরেও দীর্ঘ চুল, ভারি গোঁফ, গোল্ড চেইন আর সুদর্শন চেহারার লিলি ছিলেন সত্তর-আশির দশকের আইকন। আধুনিক ক্রিকেটের এই বর্ণীল চরিত্রে নিজেদের কল্পনা করেই অস্ট্রেলিয়ার কত তরুন ক্রিকেটের পথে হেঁটেছে তার ইয়ত্তা নেই।
সত্তরের দশকের শুরুতে তরুন ধ্বংসাত্মক ফাস্ট বোলার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ডেনিস। দুর্দান্ত রিদমিক রান আপ থেকে শুরু করে ফলো থ্রু পর্যন্ত একটা কাব্যিক ব্যাপার ছিল। সাথে লিলির আক্রমণাত্মক চরিত্র ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। ৭১-৭২ সালের ইংল্যান্ড সফরে লিলির নাম শুনে ক্রিকেট বিশ্ব।
বব ম্যাসির সাথে নতুন বলে তার আগুনঝরা বোলিংয়ের গল্প এখনো অনেকের মুখে মুখে। ম্যাসি ওল্ড ট্রাফোর্ডে দুই ইনিংস মিলে ১৬ উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়লেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। টিকে গিয়েছিলেন লিলি, অবিশ্বাস্য গতি ও অ্যাকুরেসিতে খুব অল্প সময়েই লিলি হয়ে ওঠেন অস্ট্রেলিয়ান পেস আক্রমনের 'মেইন ম্যান।'
তবে পিঠ ইনজুরির কারনে ক্যারিয়ারের শুরুতে নিয়মিত খেলতে পারেননি তিনি। প্রথম তিন বছরে মাত্র ১১টি টেস্ট খেলেন লিলি। তাতেই উইকেট সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে যায় তার। ভয়ানক ইনজুরির কারনে প্রায় দুই বছরের সময় মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাকে। তখন ফিটনেস নিয়ে খুব একটা পড়াশোনা হত না।
বিশেষ করে ফাস্ট বোলারদের ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট ছিল খুবই নাজুক। সেই সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে ফাস্ট বোলার ম্যানেজমেন্টে লিলির দেখানো পথ এখনো আদর্শ মানা হয়। মাঠে ফেরার প্রবল ইচ্ছা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ৭৪-৭৫ সালের অ্যাশেজে সম্পূর্ণ নতুন রূপে ফিরে আসেন। পেসের সাথে সমঝোতা করে লাইন লেন্থের উপর কাজ করে বদলে ফেলেন নিজেকে।
লম্বা সময় মাঠের বাইরে থাকা লিলি ভয়ে ভিত ছিল না তখনকার ইংল্যান্ড দল। তারা ভেবেছিল কঠিন ইনজুরি ধকল সহ্য করে আসা লিলি সেই পুরনো রূপে ফিরতে পারবে না। পিঠের ইনজুরি আসলেই লিলিকে বদলে গিয়েছিল, বাউন্সারের সাথে আউট সুইং, অফ কাটারের মিশেলে আরও ভয়ঙ্কর বোলারে পরিনত হন তিনি।

ফলাফল, লিলি-থমসন জুটি ৭৪-৭৫ অ্যাশেজ ও ৭৫-৭৬ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। স্কিলের দিক থেকে তৎকালীন বোলারদের থেকে কান্ট্রি মাইল দূরে ছিলেন লিলি। লিলি চ্যালেঞ্জ টপকে যেতে হলে তার অবিশ্বাস্য স্কিলের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হত ব্যাটসম্যানদের। একই সাথে প্রবল ইচ্ছাশক্তিকেও পরাস্ত করতে হত, যা খুব কম ব্যাটসম্যানই করতে পেরেছে। বর্ণীল ক্যারিয়ারে ৭০ টেস্টে অবিশ্বাস্য ২৩ গড়ে ৩৫৫ উইকেট তারই প্রতিফলন।
লিলি মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম রঙ্গিন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন ছিলেন। তার সময়ে তিনিই প্রথম পেশাদারী মনোভাবের ক্রিকেটার ছিলেন। ফিটনেস, ডিসিপ্লিনের দিক থেকে অন্য যে কোন স্পোর্টসের চেয়ে ক্রিকেট পিছিয়ে নেয়... এর প্রমান দিয়েছেন তিনিই। ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মূল চিন্তার জন্ম নিয়েছিল লিলির মাথা থেকেই।
ক্রিকেটারদের আর্থিক নিশ্চয়তা ইস্যুতেও জোরালো আওয়াজ ডেনিস লিলি তুলেছিলেন। মাঠে ও মাঠের বাইরে তিনি হয়ে ওঠেন অস্ট্রেলিয়ান সুপার ম্যান। লিলি ছিলেন ম্যাকগ্রা, লি, গিলেস্পি, ফ্লেমিংদের ছেলেবেলার আইকন।
লিলির সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্ব মানচিত্রে ছিল না। অনেক বছর পর অবশ্য সেই বাংলাদেশেই 'লিলি' চরিত্র রুপায়ন করতে দেখা যায় মাশরাফি বিন মুর্তজা নামের এক পেসারকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম পেস সেনসেশন ছিলেন মাশরাফি। সুঠাম দেহের তরুন মাশরাফি তখন গতি দিয়েই ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতেন।
গতি তারকা নামটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম তার নামের পাশেই জুড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইনজুরি ভাগ্য 'ফাস্ট বোলার' মাশরাফিকে বেশি দিন গতির ঝড় তুলতে দেয়নি। ইনজুরির পর ইনজুরিতে রীতিমত জর্জরিত হাটু দুটি শক্তিহীন হয়ে যায়। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমে স্ক্র্যাচে ভর করে... পরে নিজ পায়ে।
খুঁড়িয়ে হেঁটেছেন, দৌড় দেয়ার স্বপ্নে। কিছুদিন পর দৌড় দিতে গিয়ে ফের ইনজুরিতে পড়েছেন। এভাবেই কেটেছে মাশরাফির ক্যারিয়ারের প্রথমার্ধ। তবে একবারও প্রিয় খেলা ছাড়ার চিন্তাও করেননি তিনি। দেশের জন্য খেলার তাড়না থেকে নিজের বোলিংয়ে এনেছেন আমুল পরিবর্তন। গতি কমিয়ে নিজের শক্তির জায়গায় যোগ করেছেন স্লো বাউন্সার, অফ কাটার হাতিয়ার।
সাথে দুর্দান্ত অ্যাকুরেসি তো আছেই। সব কিছু ছাপিয়ে কঠোর পরিশ্রমী মাশরাফির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল হার না মানা মানসিকতা। দেশের জন্য সামর্থ্যের শতভাগ দেয়াতেই তার তৃপ্তি। ১৭ বছর ধরে খেলে যাচ্ছেন, এখনো স্পেলের প্রথম বল থেকে শুরু করে স্পেলে শেষ বলে শতভাগ ইন্টেনসিটি ধরে রাখেন তিনি।
ইনজুরি নামক রাহু সর্বদা মাশরাফিকে গ্রাস করতে চাইলেও তিনি লড়েছেন, চোয়াল শক্ত করে একের পর এক ইনজুরির সাথে বারংবার লড়াই করে ফিরেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুতে আউট অ্যান্ড আউট ফাস্ট বোলার হিসেবে শুরু করা মাশরাফিকে গুনে গুনে সাতবার অপারেশনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। ইনজুরির কারনে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন ১১বার।
ইনজুরির লিস্টে লিলিকে ছাড়িয়ে গেলেও ফাস্ট বোলার থেকে করিডর বোলারে পরিনত হওয়ায় লিলির পথ বেছে নিয়েছেন মাশরাফি। গতি কমে গেলেও ধাঁর বাড়িয়েছেন বোলিংয়ে। আঁটসাঁট লেন্থে ব্যাটসম্যানদের বেঁধে ফেলায় এখনো দেশ সেরা বোলার সেই মাশরাফিই। লিলির মত টেস্ট ক্রিকেট না খেললেও ওয়ানডে খেলে যাচ্ছেন দাপটের সাথে।
দেরিতে হলেও নিজের শরীরকে চিনেছেন তিনি, বুঝেছেন ফিটনেসের বিজ্ঞান। তাই তো গত চার বছরে মেজর ইনজুরি ছাড়াই খেলছেন মাশরাফি। অধিনায়কত্বের বাড়তি দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে তাকে। সমান্তরালে দেশের হাজার হাজার তরুন ক্রিকেটারদের ক্রিকেটীয় প্রেরনার উৎস সেই মাশরাফিই।
জাতীয় দলের তারকা পেসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেটে পেসাররা মাশরাফি হওয়ার স্বপ্ন দেখেই বড় হচ্ছে। তিনিই পথ দেখাচ্ছেন কিভাবে ফাস্ট বোলার থেকে নিজেকে বদলে ক্যারিয়ার লম্বা করা যায়, আরও ভয়ঙ্কর বোলারে পরিনত হওয়া যায়। তিনিই আমাদের মাশরাফি, আমাদের ডেনিস লিলি।