কারও বিকল্প নয়, প্যাকেজ হতে চাই: মিরাজ

ছবি: সংগৃহীত

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
কলকাতার নতুন সহকারী কোচ গিবসন
৮ মার্চ ২৫
২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে স্বপ্নের মতো অভিষেক হয়েছিল মেহেদী হাসান মিরাজের। পরের কয়েক বছর বোলার তকমা নিয়েই কাটাতে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাটিং সত্ত্বাও জাগিয়ে তুলেছেন তিনি। গত বছরই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ষষ্ঠ উইকেটে আফিফ হোসেনকে নিয়ে ১৭৪ রানের জুটি গড়ে জিতিয়েছিলেন মিরাজ। তার ব্যাট থেকে এসেছিল অপরাজিত ৮১ রান।
এরপর ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে শেষ উইকেটে মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে ৫১ রান করে বাংলাদেশকে জেতান এই অলরাউন্ডার। মিরাজ অপরাজিত থাকেন ৩৯ বলে ৩৮ রান করে। শুধু এই দুটি ইনিংসই নয় প্রায় প্রতি ম্যাচেই ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে অবদান রেখেছেন মিরাজ। নিয়মিত পারফর্ম করে হয়ে উঠছেন দারুণ এক প্যাকেজ। নিজের এই প্যাকেজ হয়ে ওঠার গল্পের কথাই ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন মিরাজ।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: চান্দিকা হাথুরুসিংহে আবারও বাংলাদেশে ফিরেছেন, আপনার অভিষেকটাও তার অধীনেই... কেমন যাচ্ছে আপনাদের দ্বিতীয় ইনিংস?
মিরাজ: হ্যাঁ, আমার অভিষেকটা হাথুরুসিংহের অধীনেই হয়েছিল, ২০১৬ সালে। উনার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি, উনিও আমার ব্যাপারে জানেন। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা আছে। আমার একটা বিষয় ভালো লাগছে যে সে আমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করছে যেন আমি ব্যাটিংয়ে আরও উন্নতি করতে পারি। বোলিংটা নিয়ে হাথুরুসিংহে বেশি চিন্তিত নয়। ধীরে ধীরে যেন ব্যাটিংটা আরও ভালো হয় তা নিয়ে দুজনই কাজ করছি আপাতত।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বয়সভিত্তিক দলে আপনি অলরাউন্ডার ছিলেন। অথচ জাতীয় দলে আপনার শুরুটা শুধুমাত্র বোলার হিসেবে হলেও এখন ব্যাটিংটাও ভালো করছেন। অলরাউন্ডার হিসেবে শুরু করতে না পারায় আক্ষেপ আছে কিনা...
মিরাজ: এটা কিন্তু একটা খেলোয়াড়ের জন্য অনেক সময় অনেক কিছু বদলে যায়। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবি কারণ আমার শুরুটা হয় বোলার হিসেবে। কারণ একজন বোলারের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে, ব্যাটারদের ক্ষেত্রে এই কাজটা একটু কঠিন অনেক সময়।
যেহেতু বোলিংটা ভালোভাবে শুরু হয়েছিল, এরপর ব্যাটিংটার অপশন ছিল, যেহেতু আমি এটাও পারি। শুরুর দিকে একটু সমস্যা হতো, ভাবতাম কিভাবে খেলব না খেলব। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা আয়ত্ত করছি। আত্মবিশ্বাসটা বেড়েছে, আমি এখন জানি কি করব না করব। পরিকল্পনা সাজাতে পারি ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এখন তো লোয়ার অর্ডারেই বেশিরভাগ সময় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে... মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কি উপরে ব্যাটিং করার?
মিরাজ: অবশ্যই পরিকল্পনা বা ইচ্ছা তো আছেই উপরে ব্যাটিং করার। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তো উপরে খেলেছি। আরও অনেক জায়গাতেও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছি। এখন আপাতত উন্নতি করার চেষ্টায় আছি। সামনে অবশ্যই ভালো কিছু আছে আশা করছি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিজেকে তৈরি করে কোন অবস্থানে নিতে চান? দলের স্বার্থে কোন ভূমিকাকে সবার
উপরে রাখবেন?
মিরাজ: দেখেন আমার কাছে দুটোরই সুযোগ আছে। আমি ব্যাটিং-বোলিং দুটাই করি। তবে আমার সব সময়ই চেষ্টা থাকে দলের প্রয়োজনে অবদান রাখার। আমি যদি দুটোতেই ভালো করি তাহলে দলের জন্যই ভালো। আমি যদি দুদিকেই দলকে কিছু না কিছু হলেও দিতে পারি তাহলে কিন্তু দলেরই লাভ, দল ম্যাচ জিতবে বা ভালো করবে।
নিচের দিকে নেমে কিছু রান দলের জন্য করতে যেন পারি এটাও বড় ব্যাপার, যেখানে ব্যাট করি ওই জায়গাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বোলিংটা তো আছেই। আমার চেষ্টা থাকে একটা প্যাকেজ হয়ে খেলার জন্য, জানি না কার কি বিকল্প হতে পারব। আমি চেষ্টা করি দলের স্বার্থে যতখানি নিজেকে উজাড় করে দেয়া যায়।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে কি কি বিষয়ে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন?

মিরাজ: ক্যারিয়ারের শুরুতে কিন্তু ব্যাটিং নিয়ে আমি তেমন মনোযোগী ছিলাম না। তখন শুধু বোলিংটাই ফোকাস ছিল, কিন্তু এখন সময়ের সাথে এটা বদলেছে। আমিও চেষ্টা করছি। দলের সবাই এখন আমার ওপর বিশ্বাস রাখছে এটা খুব ভালো লাগে। আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়।
‘সে ভীষণ বিপজ্জনক’, বুমরাহর স্ত্রীকে মিরাজ
২০ ফেব্রুয়ারি ২৫
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি তিন ফরম্যাটেই আছেন... বোলিংয়ের ক্ষেত্রে একেক সময় একেক ফরম্যাটে ভাবনাটা কি থাকে?
সব ফরম্যাট তো এক না, আলাদা আলাদা ফরম্যাটের জন্য আলাদা পরিকল্পনা তো থাকেই। ৩ ফরম্যাটে যখন আপনি খেলবেন তখন আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা সাজাতেই হবে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে হবে। ফরম্যাট বুঝে আপনাকে পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: রঙ্গনা হেরাথের সঙ্গে আপনার রসায়ন কেমন?
মিরাজ: সব সময় তো দলের সাথে অনুশীলন করা হয়। আমাদের যে কোচ আছেন, বিশ্বম???নের কোচ রঙ্গানা হেরাথ। তিনি তো বিশ্বমানের ক্রিকেটার ছিলেন। এছাড়া আমার কোচ সোহেল স্যার, আমি কোন সমস্যায় পড়লেই উনাদের কাছে চলে যাই। এছাড়া ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে দলের সতীর্থদের থেকে তো সাহায্য নেই। আমার এখনও অনেক উন্নতির সুযোগ আছে। তবে আলাদা করে বা নতুন কোন কিছু আমি চেষ্টা করছি না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এতো বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন, নিশ্চয় বাড়তি একটা চাপ থাকে...
মিরাজ: ক্রিকেটটাই তো একটা চাপের খেলা। যখন মাঠে খেলবেন তখন আপনাকে চাপ নিতেই হবে। এটা যারা সামলাতে পারে তারাই বড় হয়। এই চাপটা কে কিভাবে সামাল দিতে পারে বা কিভাবে কাজে লাগাতে পারছে এটাই সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার কথা-বার্তা এখন আগের তুলনায় অনেক গোছানো। চিন্তা-ভাবনাতেও বড় রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়... এসব পরিবর্তন কি নিজ থেকেই উপলদ্ধি করে এনেছেন?
মিরাজ: দেখেন, মানুষের জীবনে কোন সমস্যা হলে কিন্তু তার ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সব সমস্যার গোড়ায় কিন্তু মাথা, আপনার চিন্তা-ভাবনা। এটাকে কিভাবে উন্নতি করা যায়? সবাই প্রতিদিন ব্যাটিং-বোলিংয়ের অনুশীলন করেন, উন্নতি করেন। কিন্তু মাথাটারও যে ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে। এখানেও ধাপ আছে, উন্নতির জায়গা আছে। কিন্তু এটা নিয়ে আমরা কেউ কাজ করি না। অনেকে আল্লাহ প্রদত্ত হয়ে থাকেন, অনেকের হয় না।
সব মানুষ এক হয় না। মানসিকতা সবার এক হয় না। আমি যদি নিজের মন বা মাথাকে বুঝাই যে আমি পারছি না তাহলে কিন্তু এর প্রভাব আপনার শরীরের মধ্যেও পড়বে। কিন্তু আমি যদি আমার মাথা বা মনকে বুঝাই যে আমি পারব আমি পারব তাহলে কিন্তু শরীর অন্যভাবে কাজ করবে। পুরা বিষয়টাই মানসিকতার, কিভাবে আপনি নিজেকে সেট করছেন বা তৈরি করছেন।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এই মানসিক পরিবর্তনটা কিভাবে করেছেন?
মিরাজ: আমরা যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি, আমাদের কিন্তু অনেক ধরণের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেক চাপ থাকে, পরিস্থিতি আসে ভিন্ন রকম। খেলতে খেলতে অনেক সময় অনেক কিছু হয়ে যায়। এছাড়া আমি বলব আমাদের দেশে এক ভাই আছেন (সাবিত রায়হান), যিনি ক্রিকেটারদের নিয়ে আলাদা করে কাজ করেন।
তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ধরিয়ে দেন। অনেক ক্রিকেটারকে নিয়েই তিনি কাজ করেছেন, আমিও আছি এখানে। উনার সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমার যে কোন কিছু প্রয়োজন হলে আমি উনার সঙ্গে আলাপ করি, এটা আমাকে সাহায্য করেছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: মাসখানেক আগে বিদেশিদের আনিয়ে আপনাদের ক্লাস করানো হয়েছে... ভাষা জটিলতা দূর করতে কি দেশি কাউকে পেলে ভালো হয়?
মিরাজ: এর আগে তো আমরা মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছি, তবে এবার যাকে আনা হয়েছে তা প্রথমবার। একটা বিষয় আমার ভালো লেগেছে যে আমি আমার নিজের বিষয়ে জানতে পেরেছি। কারণ আমাদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে দেয়া হয়েছিল, সেখানে বলা ছিল আমি যা তাই যেন লিখি।
আমাদের অনেকগুলো প্রশ্ন করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল উত্তরটা যেন আমি যা তাই যেন দেই। আমি এরপর আমার ব্যাপারে আরও কিছু জানতে পারি। আমার কি কি করতে হবে উন্নতি করতে, আমার কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে এগুলো বুঝতে পেরেছি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এসব পরিবর্তন কি আপনাকে বাকিদের তুলনায় একটু হলেও এগিয়ে দিয়েছে?
মিরাজ: আপনার সব কিছুই মানসিক। প্রতিটা মানুষেরই এই জায়গায় উন্নতি করা প্রয়োজন। দেখেন সবারই কিন্তু চিন্তা হয়, কোন কাজ নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই সবারই এটা নিয়ে কাজ করতে হবে, এটা করলে অবশ্যই উপকার হবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ নিয়ে ব্যক্তিগত কোন পরিকল্পনা?
মিরাজ: আমার নিজের কোন পরিকল্পনা নেই। কারণ আমি পরিকল্পনা করে গেলেই সফল না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি তাই যে কোন সিরিজ বা ম্যাচের আগে চিন্তা করি না যে এই করব ওই করব। তাই পরিকল্পনা করে কোথাও যাব না। ফলাফল কি হবে এটা আমার হাতে নেই। পরিশ্রম করতে থাকব তাহলেই সফলতা আসবে বলে বিশ্বাস করি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: ক্যাম্প শেষে ঈদের ছুটিতে যাচ্ছেন, এটা নিশ্চয় মানসিকভাবে আরও চাঙ্গা হতে আরও সাহায্য করবে...
মিরাজ: দেখেন ঈদের ছুটি যতদিনই পাই না কেন, চেষ্টা থাকে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর। খেলার ভেতর থাকলে তো পরিবারের দিকে সেভাবে বাড়তি মনোযোগ দিতে পারি না। প্রতিটা খেলোয়াড়ের জন্যই এই ছুটিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু কুরবানির ঈদ, সবাই পরিবারের সঙ্গে থাকবে। আশা করছি সবাই মানসিকভাবে আরও চাঙ্গা হয়েই ক্যাম্পে যোগ দেবে।