অবিশ্বাস্য ফাইনাল জিতে ক্রিকেটের নতুন রাজা ইংল্যান্ড

ছবি: ছবিঃ সংগৃহীত

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড। অথচ ১৯৭৫ সাল থেকে বিশ্বকাপ নামের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। ১৯৭৯,১৯৮৭ এবং ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেললেও তিনবারই রানার্স আপ হিসেবে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁদের। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে ক্রিকেটের জনকরা জিতে নিল তাদের প্রথম বিশ্বকাপ। তাও আবার ঘরের মাঠে আনন্দের জোয়ারে ভাসলো ইয়ন মরগানের দল। রবিবার বিশ্বকাপের ১২তম আসরে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড। এই নিয়ে টানা তিন আসরে কোনো স্বাগতিক দেশ শিরোপা জয়ের হ্যাটট্রিক করলো। এর আগে তিনবারের ফাইনালে রান তাড়া করতে গিয়েই হেরেছিল ইংলিশরা। কিন্তু এবার এই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে দেননি জশ বাটলার-বেন স্টোকরা। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর পর বিশ্বকাপে নতুন কোনো দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখলো ক্রিকেট বিশ্ব। নতুন চ্যাম্পিয়ন পাওয়ার দিন ইংলিশদের লড়াই করতে হয়েছে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত, সুপার ম্যাচ গড়িয়েছে সুপার ওভারে। সেখানেও ম্যাচ টাই, কিন্তু বাউন্ডারির হিসেবে নিউজিল্যান্ডকে ছাড়িয়ে শিরোপা জিতে নেয় ইংল্যান্ড। সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডকে ১৬ রানের লক্ষ্য দিলে নিউজিল্যান্ড ১৫ রান তুলতে সক্ষম হয়। এর আগে দুই দলের ইনিংসই থামে ২৪১ রানে, ফলে ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সুযোগ পায় ক্রিকেট বিশ্ব। আর এই মঞ্চে স্নায়ু চাপ ধরে রেখে শেষ হাসি হাসে ইংলিশরা।
ফাইনালের লড়াইয়ের আগে গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। গ্রুপ পর্বের প্রথম দিকে জয়ের মধ্যে থাকলেও মাঝপথে এসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয়ার শঙ্কা দেখা দেয় ইংলিশ শিবিরে। কিন্তু শেষের দিকে দুর্দান্ত খেলে শেষ চারে জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি সেমিফাইনালে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় ইয়ান বোথাম-নাসির হুসাইনদের উত্তরসরীরা। রবিবার ঘরের মাঠে লর্ডসে প্রতিপক্ষ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে সুপার ওভারে পুরো ম্যাচে বাউন্ডারি বেশী হাঁকানোর সুবাদে জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড।
২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে গিয়েছিল ক্রিকেটের জনকরা। এরপরই বদলে যায় দেশটির ক্রিকেট। ইয়ন মরগানের অধীনে টানা চার বছর ধারাবাহিক ক্রিকেট খেলে বিশ্বকাপে নিজেদের সেরাটা দিয়েই বিশ্বমঞ্চে নিজেদেরকে আরও ওপরে নিয়ে যায় ইংলিশরা। সব মিলিয়ে ঘরের মাঠে সমর্থকদের আনন্দের জোয়ারে ভাসান থ্রি লায়ন্সরা।
এদিন জয়ের জন্য স্বাগতিকদের ২৪২ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় কেন উইলিয়ামসনের দল। সেই লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই নিউজিল্যান্ডের বোলারদের চাপের মুখে ধীরগতিতে ব্যাট করতে থাকেন দুই ইংলিশ ওপেনার জেসন রয় এবং জনি বেয়ারস্টো। উইকেট এবং কন্ডিশন থেকে সুবিধা নিয়ে ব্যাটসম্যানদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করছিলেন কিউই দুই বোলার ট্রেন্ট বোল্ট এবং ম্যাট হেনরি। তাতে অবশ্য সফল হন পেসার ম্যাট হেনরি। লাইন লেন্থ ধরে রেখে নিয়মিত বোলিং করে ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে ওপেনার জেসন রয়কে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় করেন তিনি।
তিন নম্বরে নামা জো রুটকে সঙ্গে নিয়ে এরপর রানের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করতে থাকেন আরেক ওপেনার জনি বেয়ারস্টো। এর মাঝে কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে একবার সুযোগও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সুযোগ লুফে নিতে পারেননি এই পেসার। তবে এর এক ওভার পরই জো রুটকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় করেন এই অলরাউন্ডদার।
অধিনায়ক ইয়ন মরগানকে সঙ্গে নিয়ে জনি বেয়ারস্টো লড়াই চালিয়ে গেলেও লকি ফার্গুসনের গতিতে পরাস্ত হয়ে ইনসাইড এজে ৫৫ বলে ৩৬ রান করে বোল্ড হন বেয়ারস্টো। খানিক পর বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ক্যাচ নিয়ে মরগানকে সাজঘরে পাঠান এই ফার্গুসনই। ৪ উইকেট হারিয়ে বসলেও দলের দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার জস বাটলার এবং বেন স্টোকসের ব্যাটে এগুতে থাকে স্বাগতিকরা।
নিউজিল্যান্ডের বোলারদের বিপক্ষে দাপুটে ব্যাটিং করতে থাকেন দুজন। দুজনই তুলে নেন ফিফটি সঙ্গে নিজেদের মধ্যে শতরানের জুটিও গড়েন তারা। কিন্তু এই দুজনের ১১০ রানের জুটি ভাঙ্গেন ফার্গুসন। বাটলারকে ৫৯ রানে বিদায় করেন তিনি। খানিক পর দুই রান করে ফারগুসনের তৃতীয় শিকার হয়ে বিদায় নেন ওকস।

শেষ দুই ওভারে ২৪ রান প্রয়োজন হলে লিয়াম প্লাঙ্কেটকে সঙ্গে নিয়ে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে খেলতে থাকেন স্টোকস। শেষ ওভারে ১৫ রান প্রয়োজন হলে সেখান থেকে মাত্র ১৪ রান নিতে সক্ষম হন স্টোকস, যদিও ওভারে দুই উইকেট হারিয়েছিল স্বাগতিকরা। সেই ওভারে একটি ছক্কা হাঁকালেও আরেক বলে দুই রান নিতে গিয়ে ফিল্ডারের থ্রোতে স্টোসের ব্যাটে লেগে বল বাউন্ডারিতে চলে যায়। শেষ বলে ২ রান দরকার হলে ১ রান নিতে সক্ষম হয় ইংল্যান্ড। ফলে ম্যাচ ড্র হলে সুপার ওভারে গড়ায় ম্যাচ।
যেহেতু বিশ্বকাপ ফাইনাল তাই পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে প্রথম সুপার ওভার দেখে ক্রিকেট বিশ্ব।সুপার ওভারে প্রথম ব্যাটিং করার সুযোগ পান ইংলিশরা। ব্যাটিংয়ে নামেন জস বাটলার এবং বেন স্টোকস। ট্রেন্ট বোল্টের হাতে বল তুলে নেন অধিনায়ক উইলিয়ামসন।
ওভারের প্রথম দুই বলে ৪ রান নিলেও তৃতীয় বলে বাউন্ডারি হাঁকান স্টোকস, চতুর্থ বলে সিঙ্গেল নিয়ে বাটলারকে স্ট্রাইক দিলে সেই বলে ২ রান নেন এই উইকেটরক্ষক। ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সুপার ওভারে ১৫ রান তুলে নেয় ইংলিশরা। সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য দাড়ায় ১৬ রান।
সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করতে নামেন জিমি নিশাম এবং মার্টিন গাপটিল। বোলিংয়ে ছিলেন জোফরা আর্চার। তাঁর প্রথম ৫ বলে ১৩ রান নিলেও শেষ বলে ২ রান নিতে সক্ষম হন গাপটিল। ফলে সুপার ওভারও টাই হয়, কিন্তু দুই দলের বাউন্ডারি সংখ্যায় ইংল্যান্ড এগিয়ে থাকায় শিরোপা যেতে ইয়ন মরগানের দল।
এদিন অবশ্য টস ভাগ্যটা গিয়েছিল কেন উইলিয়ামসের দিকেই। আর টস জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্তটা নিতে দেরী করেননি এই দলপতি। ব্যাট করতে নেমে শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের বোলারদের দেখে শুনে খেললেও ইনিংসে সপ্তম ওভারে পেসার ক্রিস ওকসের ভিতরে আসা বলে লেগ বিফরের ফাঁদে পড়েন ওপেনার মার্টিন গাপটিল। এরপর অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে নিয়ে জুটি বাঁধেন আরেক ওপেনার হেনরি নিকোলস।
নিজেদের মধ্যে ৭৪ রানের জুটি গড়ার পর পেসার লিয়াম প্লাকেটের বলে উইকেটে পেছনে ক্যাচ দিয়ে ৩০ রানে ফেরেন অধিনায়ক উইলিয়াসন। তবে ফিফটি তুলে নেন আরেক ওপেনার হেনরি। কিন্তু দলীয় ১১৯ রানে তাঁকে ইনসাইড এজে বোল্ড করেন এই প্লাকেটই। এরপর বোলিংয়ে এসে দলের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান রস টেলরকে লেগ বিফরের ফাঁদে ফেলেন মার্ক উড।
৪ উইকেট হারিয়ে বসা কিউইদের বিপরমুক্ত করতে পারেননি অলরাউন্ডার জিমি নিশামও। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম এবং টম লাথাম মিলে দলকে ২০০'র উপর নিয়ে গেলেও নিজের ছন্দমত খেলতে পারেননি গ্র্যান্ডহোম। ২৮ বলে ১৬ রান করে দলীয় ২১৯ রানে তিনি বিদায় নিলে লাথাম খানিকপর ফেরেন ৪৭ রান করে। শেষ ওভারে জোফরা আর্চারের বলে ম্যাট হেনরি বিদায় নিলেও ২৪০'র গন্ডি পার করে নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের পক্ষে ক্রিস ওকস এবং লিয়াম প্লাঙ্কেট নেন ৩টি করে উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোরঃ
নিউজিল্যান্ডঃ ২৪১/৮ (৫০ ওভার) (নিকোলস ৫৫) (ক্রিস ওকস ৩/৩৭)
ইংল্যান্ডঃ ২৪১ অল আউট (৫০ ওভার) (স্টোকস ৮৪*) (জিমি নিশাম ৩/৪৩)
সুপার ওভারঃ
ইংল্যান্ডঃ ১৫/০
নিউজিল্যান্ডঃ ১৫/০