একজন ডি ভিলিয়ার্স ও সাংবাদিক মুখোশধারী ভক্ত
ছবি: ছবি- ক্রিকফ্রেঞ্জি

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
এবি ডি ভিলিয়ার্স শহরে এসেছে, এই খবর পাঠকদের জন্য লেখার পর থেকেই সাংবাদিক সত্ত্বা নড়বড়ে হয়ে ওঠে, জেগে ওঠে নিখাদ ক্রিকেট ভক্তের সত্ত্বা। আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিং জিনিয়াস এসেছে বাংলাদেশে, সাংবাদিক পরিচয়ে তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হবে। তাঁর অনুশীলন দেখার সুযোগ হবে। দলের সদস্যদের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে গল্প শোনা যাবে। এমন এক ঝাঁক ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দেয় মুহূর্তেই।
১৭ তারিখ সিলেট বিমানবন্দরে পা রেখে সোজা টিম হোটেলে যাওয়া থেকে শুরু করে পরের দিন অনুশীলনে যোগ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত অপেক্ষাই করে যেতে হল। অপেক্ষা নিয়েই বিপিএলের সিলেট পর্বের ব্যস্ততার সাথে মানিয়ে নিতে হল। সিলেটের ক্লান্ত বিকেলটা আবার সকালে শহরে পা রাখা ডি ভিলিয়ার্সের ভাবনা মনে করিয়ে দেয়।
শীতের সুন্দর বিকেলটা চাপা উত্তেজনায় কাটিয়ে সন্ধ্যায় রংপুর রাইডার্সের টিম হোটেলের আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করলাম। ফ্র্যাঞ্জাইজি এক কর্মকর্তার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে আগে থেকেই। টিম হোটেলের আশেপাশের নিরাপত্তা একটু অবাক করলো। দুই একজন এলিট ফোর্সের কর্মকর্তাকে দেখা গেল। কিন্তু তেমন বিশেষ কোনো নিরাপত্তা নয়।
রেস্টুরেন্টের দিকে এগোতেই দেখি খুলনা-চিটাগংয়ের ম্যাচে সুপার ওভারের নায়ক রবি ফ্রাইলিংকের সাথে বসে আছেন রংপুরের শন উইলিয়ামস। পাশে বসা একজন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললো, 'ওই দিকের রুমে আছেন এবি। ও হোটেলে এসেই ঘুম দিয়েছে। রুমের যাওয়ার আগে বলেছে, 'আমি এখন শুধুই ঘুমোতে চাই''। আমি সাংবাদিক মুখোশ পরেই অভিনয় করে গেলাম, অবাক না হওয়ার অভিনয়।
খাবার টেবিলে আমাদের আড্ডা চললো, মূলত ডি ভিলিয়ার্স কেন্দ্রিক আলোচনা। সেই সন্ধ্যায় খোঁজ পেলাম পরের দিন সকাল সাড়ে দশটায় অনুশীলন করবেন তিনি। রংপুর এমনিতেই তারকায় ভরা দল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, ক্রিস গেইলদের নিয়ে গড়া দলটির সমর্থকদের মাঠে টানার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান যখন বিপিএলে খেলতে আসে, তাঁর সাথে আসে পাহাড় সমান অভিজ্ঞতা, আসে পেশাদারিত্ব। ম্যাচ, অনুশীলন থেকে শুরু করে হোটেল রুম পর্যন্ত বড় তারকাদের চালচলন দেখেই তরুণ ক্রিকেটারদের অনেক কিছু শেখার থাকে।

সাংবাদিক মুখোশের আড়ালে একজন পাড় ক্রিকেট ভক্ত পর দিন সকাল সাড়ে দশটার অনুশীলন ধরতে সকাল আটটায় সজাগ, পুরো হোটেল ভরা সাংবাদিক, কিন্তু কারোই ব্যস্ততা নেই। শীতে শুক্রবারের সকাল, সিলেট শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা, দোকানপাট বন্ধ। মিষ্টি বাতাস বইছিল, স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহর জুড়ে। সুন্দর সিলেট উপভোগ করতে করতেই সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে পৌঁছে যাই, রংপুরের অনুশীলন ভেন্যু।
এসে দেখি সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠ, থাকার কথাও না। অনুশীলন শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে এসে উপস্থিত আমি। খবর নিয়ে জানলাম, রংপুরের সাথে ঐচ্ছিক অনুশীলন করবে সিলেট সিক্সার্স। আমার অপেক্ষার শেষ নেই, ডি ভিলিয়ার্সের অপেক্ষা। রংপুরের আগেই দেখি ওয়াকার ইউনিস তাঁর দলবল নিয়ে উপস্থিত। এসেছেন নিয়মিত একাদশের বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের নিয়ে। ৩০ মিনিট পরেই দল বেঁধে রংপুর রাইডার্সের আগমন।
টম মুডির নেতৃত্বে মাঠে প্রবেশ করা দলটির মাঝেই দেখা যাচ্ছিলো ডি ভিলিয়ার্সকে। ততক্ষণে হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক এসে উপস্থিত হয়েছেন। হাসিখুশি মুখ নিয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন তিনি। হাতের কাছে চেয়ার খুঁজে নিয়ে ব্যাকপ্যাক রেখেই প্রস্তুতি হন মিডিয়ার সামনে আসার জন্য।
আগে থেকেই মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় নির্ধারিত করা ছিল। সব বড় ক্রিকেটারের মতই পেশাদারী চালচলন তাঁর। সবার সাথে আলাপ করার জন্য গুটি গুটি পায়ে আসার আগে সামনে গিয়ে কুশল বিনময় করলাম আমি। হাসি মুখে বাক্য বিনিময় করেই ক্যামেরার সামনে এসে প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি। আমি তাঁর পাশেই,সাংবাদিক রূপে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একজন ভক্ত হিসেবে, শুনছিলাম বিপিএল নিয়ে ভাবনার কথা।
তিন মিনিটের ছোট্ট সংবাদ সম্মেলন শেষে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতেই হাসি মুখে বললো, 'নো প্রবলেম মেইট।' নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে ব্যাট প্যাড পরে নেট সেশনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন তিনি। আমি উৎসুক হয়ে অপেক্ষায়, ডি ভিলিয়ার্সের অনুশীলন দেখার অপেক্ষা। কিছুক্ষণ সতীর্থদের সাথে খুনসুটি করে দুইটি এমআরএফ ব্যাট হাতে নিয়ে নেটের দিকে এগোতে থাকেন তিনি।
সিলেট জেলা মাঠের দুই নম্বর নেটে রাইলি রুশো ও অ্যালেক্স হেইলসের মাঝেই ডি ভিলিয়ার্স। সুন্দর ব্যাটিং উইকেট সাজানো নেট ব্যাটিংয়ের জন্য। ক্রিজে এসে শফিউল ইসলামের আউট সুইংকে ডিফেন্ড করেই পাশের নেটে ব্যাট করা হেইলসকে জিজ্ঞেস করলেন, 'ম্যাচের উইকেটও কি এখানকার উইকেটের মত?'
গার্ড নিতে নিতেই হেইলস জবাব দেন, 'নাহ, ম্যাচের উইকেট মন্থর। এখানে উইকেট খুবই ভালো। মাঠে অন্যরকম।' হেইলসের জবাব শুনেই লেগ স্ট্যাম্পের গার্ড নিয়ে রংপুরের তরুণ লেগ স্পিনার মিনহাজুল আবেদিন আফ্রিদির বল সামলানোর প্রস্তুতি নেন।
দারুণ ব্যাল্যান্স, অবিশ্বাস্য হেড পজিশন, চোখ আর হাতের সংযোগ, ডি ভিলিয়ার্সের এইসব গুণের কথা শুনেছিলাম। এবার সামনে দেখে, একদম উইকেট কিপারের জায়গা থেকে দেখতে পেলাম। ৩৬০ ডিগ্রিতে খেলতে পারা এই ব্যাটসম্যান একবার বলেছিলেন, 'আমার সকল শটের ভিত্তি হচ্ছে সোজা ব্যাটের ড্রাইভ। ইনিংসের শুরুতে বা অনুশীলনে সবার আগে আমি সোজা ব্যাটে ড্রাইভ করতে পারলেই আত্মবিশ্বাস পাই।'
সিলেট জেলা মাঠের অনুশীলনেও সেই চেষ্টা দেখা গেল। শফিউল, শন উইলিয়ামস, আফ্রিদি, বেনি হাওয়েলদের বিপক্ষে সোজা ব্যাটে শট খেলেই গা গরম করছিলেন তিনি। ২০ মিনিট পরেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একে একে এক্সট্রা কাভারের উপর ছক্কা মারার অনুশীলন, মিড উইকেটে কব্জির মোচড়ে চার, লেট কাট, সব কিছুই বেরিয়ে এলো।
অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে দুই পাশে থাকা দুই বিদেশি, রুশো ও হেইলসের সাথে দুই এক লাইন বাক্য বিনিময় করছিলেন তিনি। আমি অবাক হয়েই তাঁর প্রস্তুতি দেখি। এই প্রস্তুতি নিয়েই পঞ্চাশ ছাড়ানো গড়ে সাড়ে আট হাজার টেস্ট রান, পঞ্চাশ ছাড়ানো গড়ে সাড়ে নয় হাজার ওয়ানডে রান করেছেন তিনি। যেখানে তাঁর ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট একশ ছাড়ানো।
এমন অংক দিয়ে ডি ভিলিয়ার্সকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর সামর্থ্যের পরিধির ব্যাখ্যায় দুটি অংক তুলে ধরা যথেষ্ট। মাত্র ৩১ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ডটি নিজের করে রেখেছেন তিনি। একই ব্যাটসম্যান আবার দলের হার এড়ানোর লক্ষ্যে ২৯৭ বল খেলে মাত্র ৪৩ রান করেছিলেন। তাঁর ক্রিকেটে এই চেহারাটাও ছিল। ক্রিকেট মাঠে এমন কিছু নেই, যা ডি ভিলিয়ার্স করতে পারেননা, আমি সেই ডি ভিলিয়ার্সের একজন ভক্ত।