আক্ষেপ, অর্জন ও ঘটনাবহুল ২০১৮

ছবি: ছবিঃ বিসিবি

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
২০১৮ সালের শুরুতে নড়বড়ে বাংলাদেশ দল বছরের শেষে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। ২০১৯ সালের দীর্ঘ ক্রিকেট সূচির আগে বছরের শুরুতে লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের আচমকা বিদায় বাংলাদেশকে অভিভাবক শুন্য অবস্থায় রেখে যায়। যার প্রভাব বাংলাদেশের পারফর্মেন্সেও পরিলক্ষিত হয়েছিল। তবে বছর শেষে বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফ যথেষ্ট সমৃদ্ধ বলা চলে। প্রধান কোচ স্টিভ রোডস অ্যান্ড কোং বাংলাদেশকে ভালো অবস্থানে এনে দিয়েছে।
বছরের শুরুতে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে তামিম ইকবালের ওপেনিং সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে লিটন দাসে বাংলাদেশ দল তামিম ইকবালের যোগ্য সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। একই সাথে বছরের শেষে ইমরুল কায়েস ও সৌম্য সরকারের রানে ফেরা টপ অর্ডারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে।
শুন্যতা ছিল ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটে পাওয়ার হিটারে। বিশেষ করে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে এখনও ডেথ ওভারে আগ্রাসী ব্যাটিং করার সামর্থ্য রাখা ব্যাটসম্যান খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। আরিফুল হককে সুযোগ করে দিলেও এখনও নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি।
বছরের শুরুতে পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের মধ্যে সাইফউদ্দিন আশা জাগালেও বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণ করার বাকি ছিল। জিম্বাবুয়ে ও উইন্ডিজদের বিপক্ষে দারুণ পারফর্ম করে নির্বাচকদের দুশ্চিন্তা দূর করেছেন তিনি।
ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের সঙ্গী হিসেবে যোগ্য বোলারের খোঁজে ছিল বাংলাদেশ। বছর শেষে সেই সমস্যার সমাধান পেয়েছে বাংলাদেশ। মেহেদি হাসান মিরাজের সাথে নাজমুল ইসলাম অপু সাদা বলের ক্রিকেটে দারুণ সফল বছর কাটিয়েছেন। টেস্টে সাকিব, তাইজুল ও মিরাজদের সাথে যোগ দিয়েছেন নাঈম হাসানের মত তরুণ প্রতিভা।

ওয়ানডে ফরম্যাটে ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা বছর কাটিয়েছে দলটি। ২০১৮ সালে ২০ ম্যাচের ১৩টিই জিতেছে। অথচ ২০১৮ সালের শুরুতে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার কাছে ফাইনালে হেরেছিল বাংলাদেশ, যা তিন বছরে স্বাগতিক দেশ হিসেবে প্রধান সিরিজ হার ছিল।
সেখান থেকে ওয়ানডে ফরম্যাটে অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে মাশরাফির বাংলাদেশ। বছরের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট এশিয়া কাপে আরব আমিরাতের কঠিন কন্ডিশনে ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে জয়ের খুব কাছে গিয়ে হারতে হয়েছে টাইগারদের। ক্যারিবিয়ান সফরে দাপট দেখিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জয় করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে ও উইন্ডিজদের বিপক্ষে সহজেই সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ।
টেস্টে ২০১৮ সালে আট টেস্ট খেলে বাংলাদেশ দলের জয় এসেছে তিনটি, একটি ড্র। তিনটি জয় এসেছে ঘরের মাঠে। বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দিয়ে বছর শুরু করেছিল। চিটাগংয়ে মমিনুলের দুই সেঞ্চুরিতে ম্যাচ ড্র করে বাংলাদেশ। তবে ঢাকায় এসে সিরিজ খুইয়ে বসে বাংলাদেশ। সেখান থেকে টানা ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী হয় বাংলাদেশ।
উইন্ডিজদের ঘরের মাঠে অ্যান্টিগা টেস্টে ৪৩ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ, যেখানে বাংলাদেশ দল ইনিংস ও ২১৯ রানে পরাজিত হয়। জ্যামাইকায় দ্বিতীয় টেস্টে হেরেছে ১৬৬ রানে। বিদেশের মাটিতে বড় ব্যবধানে দুই টেস্টের হারের পর নিজেদের আঙ্গিনায় সিলেটের মাঠে দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট হেরে বসে বাংলাদেশ। সেখান থেকে ঢাকা টেস্টের জয় দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। উইন্ডিজদের বিপক্ষে ঘরের মাঠের দুই টেস্টেও সহজে জয় পায় বাংলাদেশ।
টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ পারফর্মেন্সের দিক থেকে বাকি দল গুলো থেকে বেশ পিছিয়ে ছিল। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ হার ও দেরাদুনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হেরেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ দল ছোট ফরম্যাটের ক্রিকেটে দুর্বলতা পেছনে ফেলে এসেছে। টি-টুয়েন্টির নিদাহাস ট্রফি ও বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন উইন্ডিজদের ঘরের মাঠে সিরিজ জয় করেছে বাংলাদেশ। ১৬টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল পাঁচটি ম্যাচ জয় করেছে। সুযোগ ছিল ঘরের মাঠে উইন্ডিজদের হারানোর। কিন্তু বছরের শেষ ম্যাচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের কাছে হারতে হয় বাংলাদেশকে।
তবে বছর শেষে পেছনে ফিরে তাকালে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার ছাপিয়ে সফলতাই খুঁজে পাবে। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফলতম বছর ছিল এটিই। তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট মিলিয়ে ২১টি জয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ, সর্বোচ্চ ৪৪ ম্যাচ খেলে। বছর শেষে বাংলাদেশ দল ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বর, টেস্টে নয় নম্বর ও টি-টিয়েন্টিতে দশ নম্বরে রয়েছে।
প্রাপ্তিঃ নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল ও এশিয়া কাপের ফাইনাল ২০১৮ সালের বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যায়। এছাড়া উইন্ডিজ সফরে ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি সিরিজ জয় বাংলাদেশদের জন্য বড় অর্জন হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে বছরের সবচেয়ে বড় অর্জনকে জয় পরাজয়ের ব্র্যাকেটে বন্দী করা যাবে না। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ দল অতি মাত্রায় পাঁচ সিনিয়র ভিত্তিক দল হয়ে গিয়েছিল। ২০১৮ সালে যার পরিবর্তন এসেছে। এশিয়া কাপ ও ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের সিরিজে বাংলাদেশ দল তাদের সেরা দল মাঠে নামাতে পারেনি। তবুও অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ।
অপ্রাপ্তিঃ অ্যান্টিগা টেস্টে সাকিব আল হাসানের বাংলাদেশ দল মাত্র ৪৩ রানে অল আউট হয়েছিল। টেস্টের প্রথম সকালেই কিমার রোচ, শ্যানন গ্যাব্রিয়েলদের সামনে চোখের পলকে ভেঙ্গে পড়ে বাংলাদেশ দল, যারা সিরিজে গিয়েছিল উইন্ডিজদের থেকে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থেকে। এছাড়া টেস্ট ক্রিকেটে ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ দল জিম্বাবুয়ের কাছেও টেস্টে হেরেছে। সিলেটের মাঠে অভিজ্ঞ জিম্বাবুয়ের কাছে নিজেদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় বড় ব্যবধানে হারতে হয় বাংলাদেশকে।
সেরা পারফর্মারঃ ২০১৮ সালে টেস্টে বাংলাদেশের সেরা পারফর্মারদের মধ্যে এগিয়ে থাকবেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম। সাত টেস্টে ৪৩ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এছাড়া ৪১ উইকেট নিয়ে তাঁর পরেই আছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। চার সেঞ্চুরিতে মমিনুল হক এই বছর রান করেছেন ৬৭৩। ওয়ানডেতে তামিম ইকবাল বছর জুড়ে দারুণ ফর্মে ছিলেন। একই সাথে সাকিব আল হাসানও বড় রান পেয়েছেন ওয়ানডেতে। উইন্ডিজদের ঘরের মাঠে সিরিজ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন এই দুই বাঁহাতি। এছাড়া এশিয়া কাপে সাকিব-তামিমকে ছাড়িয়ে গেছেন মুশফিকুর রহিম। পুরো আসর জুড়ে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করেছেন তিনি। বছর শেষে বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ওয়ানডে রানের মালিক হিসেবে চূড়ায় থাকছেন মুশফিক। বোলিংয়ে নিজের ধাঁর খুঁজে পেয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। ২০১৮ সালে ২৯ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ২৬ ও ২১ উইকেট নিয়ে তাঁর পরেই আছেন মাশরাফি ও সাকিব। টি-টুয়েন্টি বোলিংয়েও বছরের সেরা মুস্তাফিজুর রহমান। ২১ উইকেট নিয়ে বিশ্বের সেরাদের তালিকায় ষষ্ট ও বাংলাদেশিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন তিনি। এছাড়া সাকিব আল হাসান ১৫ ও মাহমুদুল্লাহ ৯ উইকেট পেয়েছেন এ বছর। ব্যাট হাতে টি-টুয়েন্টিতে দাপট দেখিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ। বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১৪ রান করেছেন তিনি, আছেন সেরা দশেও। নিদাহাস ট্রফিতে দারুণ ব্যাটিং করা মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবালদের সাথে টি-টুয়েন্টিতে সিনিয়রদের সাথে পাল্লা দিয়েছেন লিটন দাস।
হারিয়ে যাওয়া মুখঃ ২০১৮ সালে বিতর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে ছয় মাসের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমান। এশিয়া কাপের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। এছাড়া নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আলোচনায় আসেন আরেক তরুণ মোসাদ্দেক হোসেন। ফর্মহীনতার কারণে শেষ পর্যন্ত দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। টানা ব্যর্থ হওয়ায় ওপেনার এনামুল হক বিজয়কেও ২০১৮ সালে দল থেকে ছিটকে পড়তে দেখা যায়।
নতুন প্রতিভার উত্থানঃ ২০১৮ সালের শেষের দিকে এসে বেশ কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটারকে খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ দল। স্পিনার নাঈম হাসান অভিষেক টেস্টে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে উইন্ডিজদের চিটাগং টেস্টে পরাজিত করার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। একই সিরিজের শেষ টেস্টে, ঢাকার মাঠে অভিষেক হওয়া ওপেনার সাদমান ইসলাম লম্বা সময় ক্রিজে থেকে ফিফটি তুলে নেন, যা বাংলাদেশকে বড় রানের ভিত গড়ে দেয়। এছাড়া পেসার আবু জায়েদ রাহি টেস্টে ভালো সূচনা করেছেন। সাদা বলের ক্রিকেটে স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু, পেসার আবু হায়দার রনি ভালো করেছে।