গলফ, ক্রিকেট এবং গ্রে নিকোলসের চাকরিজীবী মানজি
ছবি: গলফার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও ১৬ বছর বয়সে গলফ ছেড়ে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়েন জর্জ মানজি
বোকাসোকার সঙ্গে পায়ের সমস্যা প্রায়শই বিপাকে ফেলেছে তাকে। আইকিউ কম থাকায় স্কুলেও নিতে চাচ্ছিলেন না প্রধান শিক্ষক। সিনেমায় টম হ্যাঙ্কস মা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন স্যালি ফিল্ড। পুরো গল্পে ছেলেকে সাহস দিয়ে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছেন তিনি সবার থেকে আলাদা নন। মায়ের সেই বিশ্বাসের উপর ভর করেই একটু একটু করে বড় হতে শুরু করেন তিনি। পুরো সিনেমা জুড়ে তাই বারংবার মাকে স্মরণ করেছেন হ্যাঙ্কস।
ফরেস্ট গাম্পকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো তখন প্রায়শই মায়ের বলা কথাগুলো বলতেন। একটা সময় এসে মিসেস গাম্পের বিশেষ উক্তি মানুষকে বলেন হ্যাঙ্কস। মিসেস গাম্পের কথা কোট করে হ্যাঙ্কস বলেন, ‘My mama always said, life is like a box of chocolates. You never know what you're gonna get.’ যার অর্থ দাঁড়ায় আমার মা সবসময় বলতো জীবন হচ্ছে একটা চকলেটের বাক্সের মতো। তুমি কী পাবে বা পেতে যাচ্ছো তা কখনই জানবে না।’
আমাদের গল্পটাও মিসেস গাম্পের সেই কথা ধরেই। অনিশ্চয়তার জীবন তো এমনই। আপনি কী চাইবেন আর কী পেয়ে যাবেন সেটা হয়ত আপনি নিজেও জানেন না। জর্জ
মানজির কথাই ধরুন না, পুরো নাম হেনরি জর্জ মানজি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা অক্সফোর্ডে। তবে মানজির বয়স যখন ১৩ তখন অক্সফোর্ড ছেড়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে পাড়ি জমান। মূলত গলফের প্রেমে মজে স্কটল্যান্ডে গিয়েছিলেন তিনি।
দেশের অন্যতম সেরা গলফ প্রতিষ্ঠান লরেট্টো স্কুল থেকে স্কলারশিপও পেয়েছেন মানজি। তবে বছর তিনেক পরই বদলে যায় জীবনের গল্প। অক্সফোর্ডশায়ারের হয়ে নিয়মিত খেলা মানজির স্বপ্ন ছিল রাইডার কাপে খেলা। কিন্তু গলফ ছেড়ে ক্রিকেটের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন এই স্কটিশ। ফলে ১৬ বছর বয়সে গলফ ছেড়ে পুরোপুরি ক্রিকেটে মন দেন তিনি। সেখান থেকেই পথচলা শুরু, এরপর আর থামতে হয়নি ৩১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারকে।
মিসেস গাম্পের সেই উক্তির কথা যেন মানজির জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। গলফার হওয়ার আশায় এডিনবার্গে যাওয়া মানজি সেটা ছেড়ে হয়ে উঠেছেন সহযোগী দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া বাঁহাতি ওপেনার স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৫৯ ওয়ানডে এবং ৭৮ টি-টোয়েন্টি। সিলেট স্ট্রাইকার্সের জার্সিতে বাংলাদেশে বিপিএল খেলতে এসে গলফ ছেড়ে ক্রিকেট বেছে নেয়ার গল্প শুনিয়েছেন তিনি।
ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে একান্ত আলাপকালে মানজি বলেন, ‘শুরুতে আমি গলফে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলাম। আমি গলফ স্কলারশিপ স্কুলেও পড়েছি। কিন্তু ১৬ বছর বয়সে এসে মনে হল গলফে ক্যারিয়ার হবে না। তখন মনে হলো ক্রিকেটে আমার বড় সুযোগ আছে। সামাজিক দিক, অনুশীলন সুবিধা দেখার পর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থেকে। তারপর গলফ ছেড়ে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছি। এরপর তো ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছি।’
এক দেশের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে স্কটল্যান্ডের পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও মাতিয়ে বেরিয়েছেন মানজি। খেলেছেন দুবাই ক্যাপিটালস, ব্রাম্পটন উলভস, চেন্নাই ব্রেভসের মতো দলের হয়ে। খেলার পাশাপাশি চাকরিও করেন তিনি। মাঠের ক্রিকেটে ব্যাটারদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাট দিয়ে খেলতে দেখা যায়। বিরাট কোহলি যেমন খেলেন এমআরএফ দিয়ে, শচীন টেন্ডুলকার খেলেছেন অ্যাডিডাস, এমআরআফের মতো ব্যাট দিয়ে।
স্টিভ স্মিথ, জো রুট নিউ ব্যালেন্স, কেন উইলিয়ামসনের মতো ক্রিকেটার খেলেন গ্রে নিকোলসের ব্যাট দিয়ে। সেই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেন মানজি। আবার বাঁহাতি ওপেনারের ব্যাটের স্পন্সরও সেই কোম্পানি। নিজে ব্যস্ত রাখতেই মূলত ক্রিকেটের পাশাপাশি চাকরি করেন মানজি। স্কটিশ এই ক্রিকেটারের চাওয়া গ্রে নিকোলসকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী করে তোলা।
মানজি বলেন, ‘আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসি। নিজের মাথাটাকে সবসময় কাজে লাগাতে চাই। ক্রিকেটার হওয়ার পাশাপাশি আমি স্কটল্যান্ডে একটি চাকরিও করি। ব্যাট প্রস্তুতকারী কোম্পানি গ্রে নিকোলসে আমি জব করি। আমার কাজ হচ্ছে এই ব্যাটের কোম্পানিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং স্কটিশদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা।’
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে হলে ১৪১ রান তাড়া করতে হতো বাংলাদেশকে। অথচ ব্যাটিং ব্যর্থতায় ১৩৪ রানে থেমে উল্টো ৬ রানে হারতে হয়েছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দলকে। ম্যাচ শেষ হতেই দলের এমন করুণ হারের ব্যাখ্যা দিতে মাসকাটের আল আমেরাত ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে এসেছিলেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। সেখানে এসেও প্রশান্তি মেলেনি তাঁর। কোন ম্যাচ জিতলে ড্রেসিং রুমে সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ‘আমরা করব জয়’ গান গেয়ে থাকেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
বড় দলের সঙ্গে জিততে পারলে তো আনন্দটা আরও কয়েকগুন বেশি। বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাওয়া জয় স্কটিশদের জন্যও প্রায় একই রকম। ম্যাচ জিতে তাই ড্রেসিং রুমে জয়োৎসব করছিলেন স্কটল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। সংবাদ সম্মেলন কক্ষ ও ড্রেসিং রুম পাশাপাশি হওয়ায় তাদের সেই উল্লাসধ্বনি বারংবার কানে আসছিল মাহমুদউল্লাহর। সেখানে থাকা সাংবাদিকরাও ঠিকঠাক বাংলাদেশ অধিনায়কের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না।
এমন অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন থামিয়ে দিতে হয়েছিল মাহমুদউল্লাহ। সেদিনের সেই ঘটনা মনে আছে মানজিরও। বাংলাদেশকে হারানোর দিনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে স্কটল্যান্ডের বাঁহাতি এই ওপেনার বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মনে আছে। আমরা ম্যাচটি ৬ রানে জিতেছিলাম। বিশ্বকাপের মূল পর্বে যেতে হলে আমাদের জিততেই হতো। আর আমরা বাংলাদেশকে হারিয়ে সেদিন ড্রেসিংরুমে উদযাপনে ব্যস্ত ছিলাম।’
‘আমরা ম্যাচ জেতার পর ড্রেসিংরুমে জাতীয় সঙ্গীত গাচ্ছিলাম এবং সেটারই আওয়াজ বাইরে আসছিল। কারণ একেবারে ড্রেসিং রুমের সামনেই প্রেস কনফারেন্স চলছিল। আমরা কেউই জানতাম না তখন মাহমুদউল্লাহ প্রেসে। আমাদের উদযাপনের কারণে তাকে প্রেস কনফারেন্স থামাতে হয়েছিল। তবে আমরা কি বলছিলাম বা কি করেছিলাম সবাই তা শুনতে পেয়েছিল।’