জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেল প্রান্তিক প্রদীপ

ছবি: যুব বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে প্রান্তিক নওরোজ নাবিল, আইসিসি

মধুর ক্যান্টিন নামটা হয়ত অপরিচিত থাকার কথা নয়। মধুর ক্যান্টিন বাংলাদেশের অনেক ছাত্র আন্দোলন আর সংগ্রাম-পরিকল্পনার সাক্ষী হয়ে আছে। অথচ একজন ক্রিকেটার সাক্ষাৎকার দিতে ডাকলেন কিনা সেখানে। আপনি যদি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থাকেন তাহলে সেটা খেতেই পারেন। আপনি তো এমনটা ভাবতেই পারেন প্রান্তিক নওরোজের যেখানে বিসিবির একাডেমি বিল্ডিং কিংবা জাতীয় দলের টিম হোটেলে থাকার কথা সেই তিনিই কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে।
মাহমুদউল্লাহর ফিটনেস দেখে একাদশ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ
৭ ঘন্টা আগে
জীবন তো এমনই, সবকিছু যেমন পাওয়া যায় না তেমনি সব চিন্তা মেলেও না। আপনারটাও তো হয়ত মেলেনি। প্রান্তিক নওরোজও জীবনের হিসেব মেলাতে পারেননি। কদিন আগে দিল্লিকে পেছনে ফেলে বায়ু দুষণে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ঢাকা। দুষিত শহরের জন্য অস্কারের মতো পুরস্কার থাকলে সেটা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবছর জিততো বাংলাদেশের ঢাকা। ২০১৬ সালে ক্যাপসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে ২.৫ ধুলিকণা থাকে। যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির মতো সমস্যা তৈরি করে।
শেষ পর্যন্ত সেটাই কাল হলো প্রান্তিক নওরোজের। অ্যাজমার পাশাপাশি, ঠাণ্ডাজনিত অ্যালার্জি ও ডাস্ট মাইট এলার্জিতে থেমে গেছে বাঁহাতি ওপেনারের ক্রিকেট যাত্রা। আপনার, আমার মতো করে তিনিও একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন। তবে আমাদের মতো করে পেরে উঠতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাইশ গজের মায়া ছেড়ে ব্যাট, প্যাড, বল তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রান্তিক নওরোজ। ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে শোনালেন সেই গল্পই।
প্রান্তিক নওরোজ বলেন, ‘শারীরিক সমস্যার কারণে আমি অবসর নিতে বাধ্য হলাম। অনেকদিন চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যখন মানিয়ে নিতে পারলাম না। তখন এমন সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। আরও যদি বিস্তারিত বলি তাহলে অ্যাজমা, ঠাণ্ডাজনিত অ্যালার্জি ও ডাস্ট মাইট এলার্জিসহ আরও বেশ কয়েকটি সমস্যা আছে। এগুলোর একটা মেইনটেইন করতে গেলে অন্যটার সমস্যা হয়। এজন্য আমি প্রতিনিয়ত খেলার যে কার্যক্রমগুলো থাকে সেগুলোতে অংশ নিতে পারি না। অনেকে হয়ত বলে এগুলো এভাবে মেইনটেইন করো কিন্তু ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিতে থেকে এতসব আসলে মেইনটেইন করা যায় না।’
যুব দলের হয়ে খেলার পাশাপাশি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে খেলেছেন প্রান্তিক নওরোজ। বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন নিয়ে ছুঁটে চলা বাঁহাতি ওপেনার নিজেকে ফেরাতে সব চেষ্টাই করে গেছেন। শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে বিসিবির পরামর্শ নিয়েছেন, তাদের দেখানো পথেও চলেছেন। এমনকি বছর দুয়েক আগে পরিবার ও নিজের প্রচেষ্টায় সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে।

বিশ্বের নামকরা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললেও ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়ার সাহস দিতে পারেননি তাকে। তবুও দমে যেতে চাননি প্রান্তিক নওরোজ। ২০২৪ সালের মার্চে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ডিপিএল খেলেছিলেন তিনি। প্রাইম ব্যাংকের হয়েও খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। বছরখানেক আগেও ব্যাট-প্যাড নিয়ে পড়া থাকা প্রান্তিক নওরোজের নতুন করে পুরনো সঙ্গী বই-খাতা আর কলম। শত চেষ্টাও করে যখন স্বপ্নকে ছুঁতে পারলেন না তখন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন ক্রিকেট থেকে।
প্রান্তিক নওরোজ বলেন, ‘আমার দ্বারা যতটা চেষ্টা করা যায় তার চেয়ে যখন একটু বেশি দিছি তারপরও যখন হচ্ছিল তখন সিদ্ধান্ত নিই এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। এফোর্ট কিংবা প্রায়োরিটির জায়গা থেকে ক্রিকেটকে সবসময় সবার উপরে রাখার চেষ্টা করেছি। এটা আমার জন্য হতাশার কিন্তু আপনি জীবনের সব ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।’
ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রান্তিক নওরোজ নাবিল, ছবি: ক্রিকফ্রেঞ্জি
অ্যাজমা ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যার কারণে প্রায়শই বিপাকে পড়তে হয় প্রান্তিক নওরোজকে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো করা সাবেক এই ক্রিকেটার বর্তমানে অধ্যায়নরত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একুশ বছর বয়সে সবাই যখন জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তখন তার চাওয়া শান্তিতে একটু নিঃশ্বাস নেয়া। ভবিষ্যত নিয়ে না ভেবে আপাতত দিনে দুটো হাঁচি কম দিতে পারলেই খুশি প্রান্তিক নওরোজ।
নিজের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এসব করব কী করব না এগুলো নিয়ে এখন ভাবছি না। এখন প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে জীবনের ঝামেলা কমানো এবং সার্ভাইভ করা। পরশু দিন কী হবে সেটাও ভাবতে চাচ্ছি না। আমার কাছে মনে হয় আজকে একটু স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলে আমি খুবই খুশি। দুইটা হাঁচি কম দিলে খুব ভালো আলহামদুলিল্লাহ। নামাজ, খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার জীবনে আমি সব পেয়ে গেছি।’
ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে মামাতো ভাই রাজীব আল মামুনের প্রচেষ্টায় খুলনা মোহামেডান ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন প্রান্তিক নওরোজ। পরবর্তীতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছেন দুটি যুব বিশ্বকাপ। সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম, তাওহীদ হৃদয়, পারভেজ হোসেন ইমন, শাহাদাত হোসেন দিপু, তানজিম হাসান সাকিবদের।
যাদের সবাই বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন, তারকা বনে গেছেন। ২০২০ যুব বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বর, মানসিকভাবে অনেক পরিণত প্রান্তিক নওরোজ সেদিন নজর কেড়েছিলেন আইসিসির ভিডিও প্রোগ্রামে দেশকে নিয়ে কথা বলে। যতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন প্রতিপক্ষের বোলারদের বিপক্ষে ঠিক ততোটাই লড়াকু ছিলেন তিনি।
২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হারে কেঁদেছিলেন প্রান্তিক নওরোজ। সেদিনের সেই ছোট ছেলেটা ক্রিকেটের শেষটা করলেন নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে। বাবা-মা হয়ত স্বপ্ন দেখতেন ক্রিকেটার ছেলের আলোয় আলোকিত হবেন তারা, আলোকিত হবে পুরো বাংলাদেশ। অথচ জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেল প্রান্তিক প্রদীপ!