লালা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা... এ যেন উভয় সঙ্কট

ছবি: ছবিঃ সংগৃহীত

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রিকেটের বেশ কয়েকটি নিয়মে পরিবর্তন এনেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। মঙ্গলবার মোট পাঁচটি নতুন নিয়মাবলীর অনুমোদন দেয় আইসিসি। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচনার বিষয় বলে থুতু বা লালা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা।
আইসিসির নতুন নিয়ম অনুযায়ী বলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে থুতু বা লালা ব্যবহার করতে পারবেন না ক্রিকেটাররা। যদি কোনও ক্রিকেটার সেটি করেন সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি সাপেক্ষে প্রাথমিক পর্যায়ে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আম্পায়াররা শুরুতে ছাড় দিতে পারেন। তবে ক্রমাগত এই নিয়ম ভঙ্গ করলে সতর্কবার্তা দেয়া হবে।
এক ইনিংসে দুইবার সতর্কতা দেওয়া হলে বলে থুতু বা লালার ব্যবহার করলেই ৫ রান জরিমানা গুনতে হবে। এছাড়া বলে থুতু বা লালা ব্যবহার করা হলে, ম্যাচ পরিস্থিতি অনুযায়ী আম্পায়াররা বল পরিস্কার করে নেবেন।
টেস্ট ক্রিকেটে বলের একপাশ চকচকে রাখতে লালা ব্যবহারের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এর মাধ্যমে বলের একদিকে শাইনিং বের করে আনা পেসারদের জন্য অপরিহার্য্য। এই ফরম্যাটে ১০-১২ ওভারের পরে বলের চকচকে ভাব নষ্ট হতে থাকে। তখন বলে কোনো নড়াচড়া থাকে না। ফলে ব্যাটসম্যানরা অনায়াসেই উইকেটে থিতু হতে পারেন।
লালা ব্যবহারে বল একপাশ চকচকে রাখা গেলে পেসাররা খুব সহজেই রিভার্স সুইং পেতে পারেন। টেস্ট ক্রিকেটে বল একটু পুরনো হওয়ার পর সুইংয়ের সুবিধার্থে বলের একপাশ চকচকে রাখতে লালার ব্যবহারের জুড়ি নেই। তাই আইসিসির এই নতুন নিয়মের কারণ।
করোনাভাইরাসের সতর্কতা হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিসি। তবে এই সিদ্ধান্তের পর ঝামেলায় পরতে হতে পারে পেসারদের। এই পরিবর্তন ক্রিকেটে বড় রকমের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের পেসাররা। পেসারদের মতো চিন্তাভাবনা করছেন স্পিনাররাও।
জাতীয় দলের হয়ে ৯টি টেস্ট খেলা আবু জায়েদ রাহি আইসিসির এই নতুন নিয়মের কারণে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন। ক্রিকফ্রেঞ্জিকে জানিয়েছে, সুইং নির্ভর বোলার হওয়ার কারণে তিনি এখন একজন সাধারণ বোলারে পরিণত হবেন।
আবু জায়েদ বলেন, 'এই সিদ্ধান্ত আমাকে একদম সাধারণ একজন বোলার বানিয়ে দেবে। আমি একজন সুইং নির্ভর বোলার। দেখা যাবে দুই-তিন ম্যাচে কিছুই করতে পারলাম না। এ জন্য দল থেকেও বাদ যেতে পারি।'

'বলের চকচকে ভাব চলে গেলে ফ্ল্যাট উইকেটে সুইং করাতে না পারলে তো ব্যাটসম্যানকে চ্যালেঞ্জ দেয়া সম্ভব না। প্রত্যেকেরই নিজের শক্তির জায়গা থাকে। কেউ নতুন বলে ভালো তো কেউ পুরাতন বলে। এখন আমার শক্তির জায়গাটা কমে যাবে। তবে একটা ম্যাচ খেলার পরই পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যাবো আসলে কি হতে চলেছে।'
লালার পরিবর্তে বিকল্প কি ব্যবহার করা যেতে পারে সেটা নিয়েও আলাপ আলোচনা চলছে। তবে এ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। আবু জায়েদ আরও বলেন, 'বলের চকচকে ভাব চলে গেলে আমরা লালা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সুইংয়ের মূল অস্ত্র যদি ব্যবহার করতে পারি বোলারদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।'
'২০-২৫ ওভাররে পর রিভার্স সুইং তখন কাজে আসবে। কিন্তু এখন সবই অনুমান। মাঠে কি হয় সেটাই দেখার বিষয়। আমার মনে হয় বলের চকচকে ভাব ধরে রাখতে অন্য কিছু ব্যবহারের উপায় বের করতে হবে। যেহেতু এটা ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।'
আরেক পেসার এবাদত হোসেনেরও চিন্তা ভাবনা একই। বিকল্প হিসেবে ভ্যাসলিন জাতীয় কিছু ব্যবহার করার অনুমোদন পেলে বল চকচকে করা সম্ভব। এছাড়া সবুজ উইকেট বা বাউন্সি উইকেটে খেললে পেসারদের আত্মবিশ্বাস দেবে বলে মনে করছেন দেশের হয়ে ৬টি টেস্ট খেলা এই পেসার।
এবাদত বলেন, 'ভ্যাসলিন জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে। তা না হলে সবুজ এবং বাউন্সি উইকেটে খেলতে হবে, যা বোলারদের আত্মবিশ্বাস দেবে। লালা ব্যবহারে কাজটা সহজ হয় যদিও। শুরু থেকে চেষ্টা করলে লালা ব্যবহার করে বলের চকচকে ভাব ধরে রাখা যায়। তবে এইটা বলের ওপর নির্ভর করবে, কতটুকু ভালোভাবে তা ঘষা হয়েছে।'
লালা নিষিদ্ধ হওয়ায় স্পিনারদের সুবিধা দেখছেন অনিল কুম্বলে। তবে ভারতের এই সাবেক অধিনায়কের সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের স্পিনাররা। আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, পেসারদের মতো স্পিনারদেরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুইংয়ের প্রয়োজন পরে। বিশেষ করে আর্ম বল ছাড়ার ক্ষেত্রে।
আইসিসির এই সিদ্ধান্তে যে কোন ধরণের বোলারই বিপদের মধ্যে পরবে বলে ধারণা করছেন ১৩টি টেস্ট খেলা এই স্পিনার। ক্রিকফ্রেঞ্জিকে রাজ্জাক বলেন, 'পেসারদের মতো স্পিনারদেরও সুইংয়ের প্রয়োজন হয়। আর্ম বলের ক্ষেত্রে বলে সুইংয়ের প্রয়োজন হয়, যদি এটা স্পিন করতে শুরু করে তাহলে ড্রিফট (বাতাসে বল বাঁক খাওয়ানো) অসম্ভব। তাই বলের চকচকে ভাব অবশ্যই প্রয়োজন।'
'আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত সব বোলারদেরকেই কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলবে। তবে স্পিনারদের থেকে পেসারদের ঝামেলাটা বেশি হবে। চকচকে ভাব ধরে রাখা না গেলে স্পিনাররাও বিপদে পরবে। একসাইডে চকচকে ভাব থাকলে বল দুই সাইডেই ড্রিফট করবে।' আরও যোগ করেন তিনি।
স্পিনার তাইজুল ইসলাম লালা ব্যবহার ছাড়া আর কোন বিকল্প দেখছেন না। তিনি বলে, 'ঘামের কারণে বল তারাতারি নষ্ট নয়। ঘাম বলে লাগানো মানে হচ্ছে পানি লাগানো। তাই কঠিন হবে বলের চকচকে ভাব ধরে রাখতে। তাই ট্রাউসারে ঘষে যতদূর সম্ভব চকচকে রাখতে হবে। টেস্টে ৫০-৬০ ওভার পর্যন্ত বলের চকচকে ভাব ধরে রাখা যেত।'
'এখন এটা ৩০-৪০ ওভারের পর নষ্ট হয়ে যাবে। বাকিদের কথা জানি না, আমার ক্ষেত্রে আমার ক্ষেত্রে এট অনেক কাজে আসে। কারণ বল বাঁক খাওয়াতে পারি। কিন্তু বলের চকচকে চলে গেলে তা সম্ভব না। ঘাম বা লালা ব্যবহার না করা গেলে ট্রাউসার বা শার্টে মুছে নিতে হবে। কিন্তু সেগুলো তো ভেজা থাকে। তাই খেলা শুরু হওয়ার পরই সব পরিষ্কার হবে।' আরও যোগ করেন এই স্পিনার।
এনামুল হক জুনিয়র মনে করেন, বোলারদেরকে বেশি বিপদে ফেলবে এই সিদ্ধান্ত। কারণ এখনকার দিনে উইকেট থেকে ব্যাটসম্যানরা বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। বাঁহাতি এই স্পিনার বলেন, 'বিগত কয়েক বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেট থেকে স্পিনাররা বেশি সাহায্য পাচ্ছে না। উইকেট পেতে বাড়তি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এখন যদি বলের চকচকে ভাব ধরে রাখতে না পারি তাহলে আরও সমস্যা হয়ে যাবে। স্পিনারদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ব্যাটসম্যানরা বাড়তি সুবিধা পাবে। তাই উইকেটে স্পিনারদের সাহায্য থাকতে হবে।'
আইসিসির এই নিশেধাজ্ঞার পর দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অলরাউন্ডার লান্স ক্লুজনার লালার বলে মোম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। সীমিত পরিমাণে তা ব্যবহার করা গেলে বসের চকচকে ভাব ধরে রাখা সম্ভব বলে ধারণা করছে সাবেক এই প্রোটিয়া ক্রিকেটার।
ক্লুজনার বলেন, 'লালার পরিবর্তে সীমিত আকারে মোম ব্যবহার করা যেতে পারে। যা থাকবে অধিনায়কের কাছে। ইনিংসের ৮০ ওভার পর্যন্ত এটা ব্যবহৃত হবে। এরপর নতুন আরেকটা পাবে পুরনোটা আম্পায়ারকে হস্তান্তর করা হবে। আইসিসির এমন সিদ্ধান্তে আমি কোন অসুবিধা দেখছি না। কারণ লালার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে।'
বায়ো সিকিওর পরিবেশে পরিবেশে ক্রিকেট হলে বলে থুতু বা লালা ব্যবহারে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও ঝুঁকি নেই বলেই মনে করেন সাবেক প্রোটিয়া পেসার শন পোলক। যদিও আইসিসির ক্রিকেট কমিটির অন্যতম সদস্য তিনিও।
পোলক বলেন, 'জৈব সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই সমাধানের রাস্তাও বের হবে। সেক্ষেত্রে আলাদা পরিবেশের মধ্যে থাকবে সবাই। পরীক্ষাও হবে সবার। ফলে বলের পালিশ ধরে রাখতে এই ধরণের পরিবেশে থুতু বা লালা ব্যবহার করা যেতেই পারে।'
ভারতের কিংবদন্তি সাবেক তারকা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার দুটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। প্রথমত, মোম দিয়ে বল ঘষে চকচকে করা। দ্বিতীয়ত, টেস্টে ৫০ ওভার পরে ফিল্ডিংরত দলকে নতুন বল নেওয়ার অনুমতি দেওয়া।
নিজের অ্যাপ ‘১০০ এমবি’তে ব্রেট লির সঙ্গে ভিডিও আলোচনায় শচীন বলেছেন, ‘বল ঘষে চকচকে করার জন্য প্রতি ইনিংসে ফিল্ডিং দলকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মোমের প্রলেপ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হোক।’