এই মুশফিক সত্যিই দুষ্প্রাপ্য!

ছবি: ছবিঃ ক্রিকফ্রেঞ্জি

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে ব্রডকাস্টারদের একটা সাক্ষাৎকার দিলেন মুশফিকুর রহিম। তারপর ধীর পায়ে হাঁটা ধরেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষের পানে।
কাছাকাছি আসতেই এক জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক তার কানে ক্ষীণ স্বরে কিছুটা একটা বললেন। সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাস্যে মেতে উঠলেন মুশফিক। যার আওয়াজে তার দিকে চোখ ফেরাতে হলো সবার। ওই সাংবাদিককে উত্তরে বললেন, ‘না, না আপনি ১০০ বলেছিলেন। এখানে তা হয়নি। আচ্ছা, ওয়ানডেতে ১০০ হোক, তারপর।’
তার সংবাদ সম্মেলনটার ব্যপ্তি ছিল প্রায় ২২ মিনিট। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। নিজে হেসেছেন, কক্ষের সবাইকে হাসিয়েছেন। কয়েকবার পুরো কক্ষে হাসির রোল পড়েছে। যার শুরুটা প্রতিবারই মুশফিক নিজে করেছেন। সময়টা যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন তিনি।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সাঁঝের আগে মুশফিকের চোখে মুখে এই ভুবনজয়ী হাসিটা স্বাভাবিকই বটে। কারণ তার ঘন্টা খানেক আগেই মিরপুর শের ই বাংলা স্টেডিয়ামের সবুজ জমিনে ইতিহাস গড়ে এসেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরির গৌরব অর্জন করেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। আর কারো যে একাধিক ডাবল সেঞ্চুরিই নেই। একটি করে ডাবল সেঞ্চুরি আছে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের।
মিরপুর টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ২০৩ রানের ইনিংস খেলেছেন মুশফিক। তার ডাবল ও অধিনায়ক মুমিনুলের সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ৫৬০ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। ২৯৫ রানের লিড পাওয়া বাংলাদেশ শেষ বিকেলে জিম্বাবুয়ের ২ উইকেট তুলে নিয়েছে। সবমিলিয়ে গত এক বছর সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশ শিবিরে সোমবার দিনটি যেন বসন্তের বাতাস এনে দিয়েছে। তাতেই স্বস্তির মৌমাত ধরা পড়ল টাইগারদের ড্রেসিংরুমের চারপাশে।

যদিও এমন সপ্রতিভ, প্রাণবন্ত মুশফিকÑঅনেকটা দুষ্প্রাপ্যই বটে। কদাচিৎ এই অবস্থায় দেখা যায় তাকে। তাই সোমবারের আবহটা ‘বিস্ময়’ হয়েই ধরা দিয়েছে সাংবাদিকদের কাছে। কারণ জাতীয় দলের এই সাবেক অধিনায়ককে সাধারণত এই রুপে পাওয়া যাওয়া না। সংবাদ সম্মেলন শেষে মুশফিকের ‘ভিন্নরুপ’ই ছিল সবার আলোচনায়।
মুশফিক মানেই এক অন্তর্মুখী চরিত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে কান পাতলেই তা শোনা যায়। সংবাদ সম্মেলনে, চলতি পথে বহুবার মেজাজ হারানোর নজির রয়েছে তার। কাজের প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ছোট-খাট জিজ্ঞাসার জবাবেও রক্তচক্ষু দেখিয়েছেন মুশফিক। এমন বহু ঘটনা রয়েছে।
১. ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় যেমন এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, কাল তো শততম টেস্ট, বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের সময় কোথায় ছিলেন, মনে পড়ে?
অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার রাগত স্বরে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আ???নাকে কেন বলবো?’ সন্দেহাতীতভাবে বড্ড অদ্ভূত ও অকল্পনীয় সেই উত্তর।
২. একই বছরের জুলাইয়ে মিরপুরে অনুশীলনের পর দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা অসুস্থ মুক্তামণিকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলে যাবেন মুশফিক। এই তথ্যটা জানার পর এক সাংবাদিক বিসিবি একাডেমি মাঠ থেকে বের হওয়ার মুখে জানতে চেয়েছিলেন, ভাই এখনই কি ঢাকা মেডিকেলে যাবেন? জবাব ছিল এমন, ‘আপনার কি দরকার?’
অথচ মুশফিকের এই মানবকর্মকে প্রচারের আলোয় আনতে তার সফরসঙ্গী হওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রশ্নটা করেছিলেন ওই সাংবাদিক।
এই তো গত মাসে বঙ্গবন্ধু বিপিএলের ফাইনালে হারের পর সংবাদ সম্মেলনে, কয়েক বার রেগে যান মুশফিক। তাও পাকিস্তান সফরে তার যাওয়া, না যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করায়। সচরাচরই যা করে থাকেন মুশফিক।
ব্যাটিংয়ে তিনি ধ্যানমগ্ন ঋষি, এটা সবারই জানা। ব্যাটিং খারাপ হলে, কম রানে আউট হলে নিজের ভেতর গুটিয়ে যান মুশফিক। ক্রিকেটারদের মুখেই শোনা গেছে, এমন অনেক সময় আছে যখন তার সঙ্গে কথাই বলা যায় না। অনেক সময় দ্রুত আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে কেঁদেও ফেলেন তিনি।
সোমবার মুশফিককে হাস্যেজ্জল দেখে প্রেসবক্সে সাংবাদিকরাই মনে করার চেষ্টা করলেন, শেষ কবে এমন রুপে দেখা গিয়েছিল তাকে। খুব সহজে সেই সময়টা মনে করা খুব কঠিন।
পরিশ্রমী, ফিটনেস সচেতন মুশফিক ক্রিকেটার হিসেবে আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ। ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রমেই নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাদা পোশাকে দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি, ২০১৩ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিরপুরেই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে খেলেন অপরাজিত ২১৯ রানের ইনিংস। মজার বিষয়, ওই ইনিংসের পর আর কোনো সেঞ্চুরিও আসেনি তার ব্যাট থেকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি, মুশফিকের ক্যারিয়ারে সুসময়ের ধারক।
বহিরাবরণের পরিবর্তন যত দ্রুতই ঘটুক না কেন, সাংবাদিকসহ দেশের আপামর ক্রিকেটপ্রেমীর চাওয়া, রানে থাকুক মুশফিক, ২২ গজে এমনই আনন্দচিত্তে তার দিন কাটুক। তাতে আখেরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের লাভটাই বেশি।