বিশ্বজয়ের নায়কদের আদ্যোপান্ত

ছবি: ছবিঃ আইসিসি

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছিলেন যুব দলের অধিনায়ক আকবর আলী। দলের প্রত্যেকে বিশ্বকাপ জেতার জন্য প্রস্তুত সেটা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি।
আকবর শুধু কথাতেই নয়, কাজেও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ চাইলে যেকোনো অসম্ভব সম্ভব করতে সক্ষম। পুরো বিশ্বকাপে অপরাজেয় থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় অবশ্যই। বাংলার দামাল ছেলেরা সেই কাজটিই করে দেখিয়েছে। তাদের সামনে মাথা নত করেছে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের মতো শক্তিশালী দল।
বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা প্রত্যেক ক্রিকেটারের মাঝে যে আত্মবিশ্বাস এবং স্পৃহা ফুটে উঠতে দেখা গেছে তা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মাঝেও দেখা যায়নি বহুকাল। বিশ্বজয়ী এই নায়কদের নিয়েই আজকের আয়োজন।
১। আকবর আলী- অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক আকবর আলী এরই মধ্যে নিজের জাত চিনিয়েছেন বিশ্ব দরবারে। একজন আদর্শ নেতার সকল গুণই দেখা গেছে ১৮ বছর বয়সী এই তরুণের মাঝ??। তাঁর নেতৃত্বে অপরাজেয় থেকে বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছে বাংলাদেশের যুবারা।
পাঁচ ভাই বোনদের মধ্যে সবার ছোট আকবরের জন্ম ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর রংপুর সদরে। সর্বপ্রথম তাঁর ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয় ২০১২ সালে। ক্রিকেটের প্রতি আজন্ম লালিত ভালোবাসা থেকেই দিনাজপুরের বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন তিনি।
তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৫ সালে সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তি হন আকবর। এরপরের গল্পটা অনেকেরই জানা। নিজ প্রতিভাগুণে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পান তিনি। শুরুতে আশানুরূপ সাফল্য না আসলেও ধীরে ধীরে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দেয়া শুরু করেন আকবর। অবশেষে বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে ষোল কলা পূর্ণ করলেন এই তরুণ।
২। পারভেজ হোসেন ইমন- অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরি নিয়েও দেশের স্বার্থে লড়াই চালিয়ে গেছেন ১৭ বছর বয়সী ইমন। ৪০ শতাংশেরও কম ফিটনেস নিয়ে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারলেও তাঁর এই হার না মানা মানসিকতা প্রশংসা কুড়িয়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে।
২০০২ সালের ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা ইমনের ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অঢেল আগ্রহ। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় টেপ টেনিস ক্রিকেটে নিয়মিতই খেলতেন। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ২০১৩ সালে ইমনের বড় ভাই তাঁকে দিনাজপুরের বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
এর ঠিক তিন বছর পর সাভারের বিকেএসপিতে আসেন তিনি। এরপর নানা চড়াই উৎরাই পার করে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেন ইমন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিশ্বকাপে ৪৭ রানের দারুণ একটি ইনিংস খেলে নিজের জাত আরো একবার চেনান তিনি।
৩। তানজিদ হাসান তামিম- ২০০১ সালের ১ ডিসেম্বর বগুড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন বাঁহাতি এই ওপেনার। জাতীয় দলের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালের সঙ্গে শুধু নামেই মিল নয় তানজিদের, তাঁর মতো আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করেন তিনিও।
২০১৬ সাল পর্যন্ত বগুড়া জেলা দলের হয়ে খেলা তানজিদ ২০১৭ সালে রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন। সেই একাডেমিতে থাকার সময়েই প্রধান কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের নজরে আসেন তিনি।

পরবর্তীতে প্রথম বিভাগ থেকে উত্তরা ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সুযোগ পান এই তরুণ। এরপর ঘুরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৩ রানের ইনিংস খেলে নিজের জায়গা পাকা করে নেন তানজিদ।
৪। মাহমুদুল হাসান জয়- অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অনবদ্য একটি সেঞ্চুরি করেন জয়। একই সঙ্গে দলকে জয়ের ভীত গড়ে দেন তিনি। বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজের জাত চেনানো এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্ম ২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে।
ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট পাগল জয় পড়াশুনো শিকেয় তুলে ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকতেন। এর জন্য বাবা-মার কাছে কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু ক্রিকেট যার রক্তে মিশে আছে তাঁকে বোঝায় কার সাধ্য! শেষ পর্যন্ত অবশ্য জয়ের জেদেরই জয় হয়েছে।
ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ এবং ভালোবাসা দেখে ব্যাংকার বাবা আবুল বারেক নিজেই ২০১২ সালে জয়কে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে দুই বছর কাটিয়ে পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন তিনি। এরপরের গল্পটি অজানা নয় কারোই।
৫। তৌহিদ হৃদয়- ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর বগুড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন অনূর্ধ্ব ১৯ দলের এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটে আসার পেছনে হৃদয়কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন তাঁর মা।
মাত্র সাত বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলে আসছেন হৃদয়। সর্বপ্রথম শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান তিনি। এরপর ২০১৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপেও খেলেন হৃদয়। এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ মঞ্চ মাতালেন তিনি।
৬। শাহাদাত হোসাইন- ক্রিকেটে আসার আগে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়েছে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান শাহাদাত হোসেনকে। ২০১০ সালে যখন শাহাদাতের বয়স মাত্র ৮ বছর তখন তাঁর বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন অনেকটা ফিকে হয়ে ২০০২ সালের ৪ ফ্রেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া শাহাদাতের। এরপর মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বিকেএসপির ট্রায়াল থেকেও বাদ পড়েন তিনি। সেসময় ক্রিকেটার হবার আশা অনেকটাই ছেড়ে দেন শাহাদাত।
তখনই সুদীপ্ত দেব নামের শাহাদাতের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর মা এবং বড় ভাইকে বুঝিয়ে ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি শাহাদাতকে। ২০১৩ সালে দলটির হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলেন তিনি। পরের বছর চট্টগ্রাম জেলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ পান শাহাদাত। ক্রমান্বয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ দলেও জায়গা করে নেন তিনি।
৭। শামিম হোসেন- ২০০০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরে জন্ম গ্রহণ করেন অলরাউন্ডার শামিম হোসেন। ছোটবেলায় শামিমকে ক্রিকেটের প্রতি অনুপ্রেরণা যোগান তাঁর চাচা আনোয়ার। শামিমকে নিজেই ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি।
সেখানে ক্রিকেটে হাতে খড়ি হওয়া শামিম পরবর্তীতে পাড়ি জমান বিকেএসপিতে। এরপর শুধুই এগিয়ে চলার গল্প। ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে পশ্চিমবঙ্গ অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বিপক্ষে ২২৬ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেলেন শামিম। সেই ইনিংসটিই তাঁকে যুব বিশ্বকাপের দুয়ার খুলে দেয়।
৮। অভিষেক দাস- ২০০১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নড়াইলে জন্ম গ্রহণ করেন অলরাউন্ডার অভিষেক দাস। দলের অন্য সতীর্থদের মতো ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না অভিষেক দাস। বরং তাঁর ইচ্ছা ছিল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হওয়ার। ব্যাডমিন্টনে তিনবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হওয়া অভিষেকের ক্রিকেটে আগমন ঘটে ২০১২ সালে।
সেবার একটি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে অংশ নিতে গিয়ে ক্রিকেট কোচ সৈয়দ মনজুর তৌহিদ তুহিনের চোখে পড়েন অভিষেক। ৬ ফুট উচ্চতার এই তরুণকে বেশ মনে ধরে কোচ তুহিনের। অভিষেককে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন মূলত তিনিই দেখান। এরপরই শুরু হয় তাঁর ক্রিকেটে পথ চলা। ব্যাডমিন্টন র্যাকেট ফেলে ক্রিকেটের ব্যাট-বল হাতে শুরু হয় তাঁর নতুন লড়াই।
৯। রকিবুল হাসান- বাঁহাতি স্পিনার রকিবুল হাসানের মূল স্বপ্ন ছিল পেসার হওয়ার। কিন্তু পেসারদের মতো শারীরিক গঠন এবং ফিটনেস না থাকায় সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তাঁর। ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের কুড়িপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করা রকিবুলের লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না।
বাবা-মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও ক্রিকেটকেই ধ্যান জ্ঞান ধারণার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন তিনি। এমনকি পরিবারের কাউকে না জানিয়ে প্রবীণ ক্রিকেট কোচ ওয়াহিদুল গণির অংকুর ক্রিকেট একাডেমিতেও ভর্তি হয়ে যান রকিবুল।
সেখান থেকেই অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার জন্য ডাক আসে তাঁর। এরপর ময়মনসিংহে একটি টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত বোলিং করে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন তিনি। সেসময় বাবা-মাও আর ছেলেকে সমর্থন না দিয়ে পারেননি। সেই ধারাবাহিকতায় যুব বিশ্বকাপ দলেও সুযোগ করেন নেন তরুণ রকিবুল।
১০। তানজিম হাসান সাকিব- ২০০২ সালের ২০ অক্টোবর সিলেটের তিলকচানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তানজিম হাসান সাকিব। দলের অনেক সতীর্থের মতো সাকিবেরও ছোটবেলা থেকে বিপুল আগ্রহ ক্রিকেটের প্রতি। সাকিবের এই ক্রিকেট প্রীতির কথা মাথায় রেখে ২০১৫ সালে তাঁকে বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য নিয়ে যানবাবা গৌউস আলী।
সেখানে অবশ্য প্রথম চেষ্টায় ভর্তি হতে পারেননি সাকিব। তবে এর দুই বছর পর বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ করে নেন তিনি। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে যুব দলে জায়গা পান এই ডানহাতি পেসার।
১১। শরিফুল ইসলাম- ২০০১ সালের ৩ জুন পঞ্চগড়ের কালিগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। পড়াশুনোর প্রতি ছোট থেকেই তেমন মনোযোগ ছিল না তাঁর। ফলে ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তিনি।
এই অকৃতকার্য হওয়াটাই অবশ্য শাপে বর হয়েছে শরিফুলের জন্য। কারণ সেসময় ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে শরিফুলকে দিনাজপুরের একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁর মামা। সেই একাডেমিরই কোচ আলমগীর কবিরের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন চালিয়ে যান শরিফুল।
নিজের সামর্থ্য জানান দিয়ে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে আসেন তিনি। সেখানেই খালেদ মাহমুদ সুজন এবং জহুরুল ইসলামের চোখে পড়েন এই পেসার। এরপর তাঁদের সহায়তায় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জায়গা হয় তার। ধারাবাহিক ভালো খেলার কল্যাণে যুব দলেও ডাক পান শরিফুল।