ক্রিকেটের উৎসবে ক্রিকেটাররাই উপেক্ষিত!

ছবি: ছবিঃ বিসিবি, রতন গোমেজ

|| সিনিয়র ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট ||
‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই।’ আঞ্চলিক এই প্রবাদটা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। যাদের দিয়ে ক্রিকেট, আর এই ক্রিকেটের কারণে যে অনুষ্ঠান; সেখানেই কিনা ক্রিকেটারদের কোনো গন্ধ-বাসনা নেই!
নেই মানে নেই-ই! আলোর বিচ্ছুরণ, চোখ ধাঁধানো আতশবাজি আর ঝলমলে মঞ্চে দেশি-বিদেশি তারকাদের নজর কাড়া পারফরম্যান্স। কিন্তু এতো আয়োজনের কোথাও নেই ক্রিকেট বা ক্রিকেটাররা। যেন এটি সাধারণ কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে দর্শকদের বিনোদন দেয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, এটাই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। আর বিপিএল মানেই নতুনত্ব। এখানে নতুনত্বের শেষ নেই। কিন্তু এই নতুনত্বে সুখের উপাদান নেই বললেই চলে। বিপিএলে যা নতুন, তার প্রায় পুরোটাই বিতর্ক। আগের কয়েকটি আসর সেটার দৃষ্টান্ত। কিন্তু শুরুর আগে থেকেই বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসা এবারের বিপিএলে যা হলো, সেটার সঙ্গে ক্রিকেটের বিন্দুমাত্র সম্পর্কও থাকল না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ আসর বঙ্গবন্ধু বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে ৮ ডিসেম্বর। সেখানে ক্রিকেটারদের উপস্থিতি তো দূরের কথা, ক্রিকেট শব্দটাই শোনা গেল না। অবশ্য এটাই প্রথম ঘটনা নয়। বিপিএলের আগের কয়েকটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও ক্রিকেটারদের ডাকার প্রয়োজন দেখায়নি টি-টোয়েন্টি এই আসরের সংশ্লিষ্টরা। সেই হিসেবে এটা নিশ্চয়ই নতুন কিছু নয়। বরং নিয়ম মেনে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। জমকালো আয়োজন নিশ্চিত করতে নিশ্বাস ফেলার মতো অবস্থা ছিল না বিসিবির। টাকার বস্তা ঢেলে নিয়ে আসা হলো বলিউড স্টার সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফ, সঙ্গীতশিল্পী সনু নিগম, কৈলাশ খেরদের। বাংলাদেশ থেকে থাকলেন কিংবদন্তি ব্যান্ড তারকা জেমসসহ আরও কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী।
এমন আয়োজন মাঠে বসে দেখতে দর্শকদের আগ্রহও দেখা গেল আকাশছোঁয়া। গাঁটের পয়সা খরচ করে মাঠে এসেছিলেন তারা। তাদের সামনে আলোক ঝলমলে মঞ্চে নাচলেন সালমান-ক্যাটরিনা, সুরের ঝংকার তুললেন জেমস-সনু নিগমরা। কিন্তু যাদের কারণে এই আয়োজন, হন্যে হয়ে খুঁজেও সেই ক্রিকেটারদের একজনেরও দেখা মিলল না।

এমন আয়োজনে ক্রিকেটারদের যে থাকার ইচ্ছা ছিল না, তেমন নয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবেন কি না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ দলের এক ক্রিকেটার বলছিলেন, ‘যেতেই হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে যদি আমাদের ডাকে বা টিকেট দেয়, তাহলে যাব।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সেই ক্রিকেটারই বলছিলেন, ‘এই অনুষ্ঠান তো বড় বড় মানুষদের জন্য। আমরা কীভাবে থাকব এখানে!’
ক্রিকেটের এমন আয়োজনে ডাক না পাওয়াটা যে ভালোভাবে নেননি, এই ক্রিকেটারের কথাতেই সেটা স্পষ্ট। কারণ এই ক্রিকেটার জানেন, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) বা পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসেএল) মতো আসরে ক্রিকেটারদের নিয়ে সাজানো হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। শুরুতেই যে পর্বটা থাকে, সেটা শুধু ক্রিকেটারদের জন্য। ট্রফি উন্মোচন, দলগুলোর অধিনায়ককে পরিচয় করিয়ে দেয়াসহ নানা আয়োজনে ক্রিকেটারদের সম্পৃক্ত করা হয়।
বিপিএলে এর বালাই নেই। তাই বঙ্গবন্ধু বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন না কোনো ক্রিকেটার, দল বা তাদের প্রতিনিধি। ট্রফি উন্মোচনের কথাও ভাবেনি এবারের বিপিএলের আয়োজক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা’র ধরন এমন যে, ক্রিকেটারদের উপস্থিতি দূরের কথা, ক্রিকেট শব্দটাই পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল এই আয়োজনে।
সবাই মজে ছিলেন সালমান-ক্যাটরিনা আর সঙ্গীত পরিবেশনা করা সঙ্গীতশিল্পীদের পারফর্ম নিয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে মিরপুরে হাজির হওয়া সাধারণ দর্শকদের মতো বিসিবি কর্তারাও করতালি দিচ্ছিলেন, তবে সেখানে ক্রিকেটীয় কোনো কারণ ছিল না।
বঙ্গবন্ধু বিপিএলের মতো বিশেষ আসরের এমন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখে যারপরনাই হতাশ সাবেক একজন ক্রিকেটার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘এখানে ক্রিকেট কোথায়? শুধু তো নাচ, গান। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্রিকেটারদের নিয়ে অনুষ্ঠান সাজানো তো পরে, কারও মুখে ক্রিকেট শব্দটাই শুনলাম না।’
কেবল ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদেরই পাশ কাটানো হয়নি, যাঁকে নিয়ে এবারের বিপিএলের বিশেষ আসর; সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও সেভাবে মনে করা হয়নি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। জানানো হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্লাইড শো এবং ডকুমেন্টরি দেখানো হবে। কিন্তু সেটা না করে লেজার শো চলাকালীন মাঝে মাঝে জায়ান্ট স্ক্রিনে বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবি দেখানো হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পর্যন্ত এটা সীমাবদ্ধ থাকলেও চলতো। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিবিহীন বঙ্গবন্ধু বিপিএলে পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেছে। টুর্নামেন্ট শুরুর তিনদিন আগে যেখানে সালমান-ক্যাটরিনাদের এনে নাচানো হয়, সেখানে বিদেশি ক্রিকেটারদের একটু আগে-ভাগে এনে অনুশীলন করানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পারেনি বিসিবি ও দলগুলোর দায়িত্বে থাকা স্পন্সর কোম্পানিগুলো।
১১ ডিসেম্বর শুরু হতে যাচ্ছে বিপিএলের মাঠের লড়াই। অথচ এর দুদিন আগে সব মিলিয়ে মাত্র ১০-১২ বিদেশি ক্রিকেটার নিজ নিজ দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। দলের সঙ্গে যোগ দিয়েও অবশ্য স্বস্তি মিলছে না ক্রিকেটারদের। কারণ তারা প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঠিকভাবে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি বিপাকে আছেন কোচিং স্টাফরাও। দলের দায়িত্বে থাকা কোম্পানিগুলোর ক্রিকেটীয় ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় অনুশীলনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে গিয়ে চোখ কপালে উঠছে কোনো কোনো দলের মালিকপক্ষের। অনুশীলন সামগ্রীর দাম শুনে নাকি রীতিমতো হা-হুতাশ করেছে তারা।
এমন অবস্থায় ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই এখন মাঠের লড়াইয়ের অপেক্ষায়। কারণ এই লড়াইয়ে ক্রিকেটাররাই সব, এখানে অন্তত তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।