ইডেন গার্ডেন্সে বেদনার রং গোলাপি

ছবি: ছবিঃ- বিসিসিআই

|| সিনিয়র ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট, কলকাতা থেকে ||
ইডেন গার্ডেন্সের গ্যালারি আর সেখানকার দর্শকদের গলা ফাটানো চিৎকার দেখে মনে হচ্ছিল, ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ শুরু হতে যাচ্ছে। একটু পরপরই গগন বিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ছিল গ্যালারি। কখনও ‘শচিন, শচিন’ আবার কখনও ‘দাদা, দাদা।’ এই ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার দশা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির। গোলাপি রঙে সেজে ওঠার উৎসবে ভারতীয়রা মেতে উঠেছিল সাবেক তারকাদের নিয়ে।
অনেক আলোচনার গোলাপি বলের টেস্ট শুরুর আগে সবার চোখ আটকে ছিল শচিন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিং, কপিল দেব, অনিল কুম্বলেদের দিকে। বাংলাদেশ ও ভারত যে প্রথমবারের মতো গোলাপি বলে টেস্ট খেলছে, সেটা মাথায় রেখে পোশাকও সেভাবে বাছাই করেছিলেন হরভজন। টকটকে গোলাপি একটা ব্লেজার পরে স্মৃতিময় ইডেনে এসেছিলেন ভারতীয় এই স্পিনার।
মহা আয়োজনের এই টেস্ট উপলক্ষে পুরো কলকাতাতেই এখন গোলাপি রঙের ছোঁয়া। ইডেন গার্ডেন্সের সবকিছুই এখন গোলাপি। জায়ান্ট স্ক্রিন থেকে শুরু করে গ্যালারির ছাউনির পিলার, এমনকি গ্যালারির সামনের বেষ্টনিও গোলাপি রঙে সাজানো। রাস্তাঘাটেও গোলাপি আলোয় ঝলমলে পরিবেশ। ৪২ তালা টাটা ভবনের উপরের ১৩ তলা গোলাপি লাইটে সাজানো হয়েছে। রাত হলে আরেকটি বহুতল ভবন সেজে ওঠে গোলাপি আলোয়। এ ছাড়া একটি জাহাজকে সাজানো হয়েছে গোলাপি আলোয়। রাতের আধারকে আলো করে গঙ্গার বুকে চড়ে বেড়াচ্ছে জাহাজটি।

সব মিলিয়ে গোলাপির দখলে পুরো কলকাতা। কিন্তু যে গোলাপি রংকে ঘিরে এতো আয়োজন, এতো উন্মাদনা; সেটাই বাংলাদেশ দলের কাছে হয়ে উঠেছে বেদনার রং। বেদনার রং নীল হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিশ্চয়ই এখন সেটা ভুলে গেছে! অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের কাছে বেদনার রং এখন গোলাপি! যে গোলাপি শব্দটা শুনে গত কয়েকটা দিন পার করতে হয়েছে, সেই রঙের বলেই নির্মম অভিজ্ঞতা হয়েছে মুমিনুল হকের দলের।
গোলাপি বলের প্রথম অভিজ্ঞতা বুঝে ওঠার আগেই ইনিংস শেষ বাংলাদেশের। ইশান্ত শর্মা-মোহাম্মদ শামির বোলিং তোপে ১০৬ রানেই ইনিংস গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ইশান্ত-শামির গোলাপি বলের বাউন্সারে মাঠ ছাড়তে হয়েছে লিটন দাস ও নাঈম হাসানকে। ঝুঁকি এড়াতে এ দুজনকে না খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। বদলি হিসেবে তাঁদের জায়গায় দলে নেয়া হয়েছে তাইজুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজকে।
লিটন ও নাঈমের জন্য নিশ্চয়ই আফসোস হচ্ছে বাংলাদেশের। কিন্তু এরেচেয়ে কয়েক গুন বেশি আক্ষেপ হওয়ার কথা ব্যাটিং নিয়ে। আহত হওয়ায় লিটন আর ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি। বদলি হিসেবে ব্যাটিং করেছেন মিরাজ। অর্থাৎ, ১২ জন ব্যাটসম্যান ব্যাটিং করেছেন বাংলাদেশের ইনিংসে। কিন্তু এই ১২ জন ব্যাটসম্যান রান তুলেছেন ৯২। অতিরিক্ত ১৪ রান মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০৬। সর্বোচ্চ ২৯ রান করেছেন ওপেনার সাদমান ইসলাম।
এই আক্ষেপ ঘুচে যেতে পারতো বল হাতে। ভারতেরও গোলাপি বলে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় বাংলাদেশ হয়তো ভালো কিছুরই প্রত্যাশায় ছিল। কিন্তু স্বাগতিকরা ব্যাটিংয়ে যেতেই উইকেট যেন বদলে যায়। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা সাবলীলভাবে ব্যাটিং করে প্রথমদিন শেষ করেছেন। ৩ উইকেটে ভারতের স্কোরকার্ডে জমা হয়েছে ১৭৩ রান, মিলে গেছে ৬৮ রানের লিড। ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি ৫৯ ও অজিঙ্কা রাহানে ২৯ রানে অপরাজিত আছেন।
ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে এদিন অনেক আয়োজন দেখেছে ইডেন গার্ডেন্সের প্রায় ৭০ হাজার দর্শক। পুরো উৎসবের মেজাজে দিবা-রাত্রি টেস্টের প্রথমদিন পার করেছেন তারা। ঘণ্টা বাজিয়ে ঐতিহাসিক এই টেস্টের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। এরআগে দুই দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে পরিচিত হন তাঁরা।
লাঞ্চে মাঠের মাঝে বসে আড্ডা দেন ভারতের চার সাবেক তারকা ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকার, অনিল কুম্বলে, হরভজন সিং ও ভিভিএস লক্ষ্মণ। চা বিরতিতে ভারতের সাবেক অধিনায়ক ও ক্রীড়াবিদদের দেয়া হয়েছে ল্যাপ অব অনার। একই সময়ে গান পরিবেশন করেন সৌরেন্দ্র ও তাঁর দল। দিনের খেলা শেষে গান পরিবেশন করেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লা।
এসব আয়োজন নিশ্চয়ই উপভোগ করেছেন দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা। প্রথমে বোলিংয়ে, পরে ব্যাটিংয়ে শাসন করায় কোহলি, রোহিত, রাহানেদের কাছে পুরো সময়টা ছিল গোলাপি বলের মতোই রঙিন। অন্যদিকে ব্যাটিংয়ে নেমে উল্টো পথে হাঁটা বাংলাদেশ কেবল বাঁচার কথাই ভেবে গেছে। বাংলাদেশকে এখনও ভাবতে হচ্ছে আরেকজন ক্রিকেটার ছিটকে গেলে দলের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে।