সতীর্থদের ওপর বিরক্ত সাকিব

ছবি: ছবিঃ সংগৃহীত

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ভালো খেলতে নয়, জিততে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু টুর্নামেন্ট জেতার জন্য দলীয় যে পারফর্মেন্স প্রয়োজন সেটা করতে পারেনি তারা। যেকারণে সেমিফাইনালের টিকিট পায়নি মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। পুরো বিশ্বকাপেই দলের পক্ষে একাই যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেছেন সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে জয় নিয়ে আসতে হলে যে লড়াইটা দলীয়ভাবে করতে হয় সেটা বাংলাদেশের পারফর্মেন্সই ফুটিয়ে তুলছে।
টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত ৭ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। প্রত্যেক ম্যাচেই দলের পক্ষে লড়াইটা একাই চালিয়েছেন তিনি। ব্যাটিং, বোলিং দুই বিভাগেই নিজের সেরাটা দিয়ে লড়াই করেছেন দেশের জন্য। এই আসরে মোট ৩টি ম্যাচে জিতেছে টাইগাররা, তিনটিতেই ম্যাচ সেরা হয়েছেন এই অলরাউন্ডার। কিন্তু লড়াইয়ের মাঝে সতীর্থদের কাছ থেকে যেমনটা প্রত্যাশা করেছেন তেমন আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেননি দলের কেউই। যেকারণে সতীর্থদের উপর খানিকটা বিরক্ত সাকিব। সতীর্থদের মাঝে তাড়নার অভাব দেখতে পারছেন তিনি।
ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন সাকিব। এখন পর্যন্ত ৫৪২ রান করেছেন তিনি ব্যাট হাতে। আর বোলিংয়ে নিয়েছেন ১১টি উইকেট। দলের সাফল্যের পেছনে অন্যতম এই কারিগর এবারের বিশ্বকাপটা সম্পূর্ণ নিজের করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের তিনভাগের একভাগ রান একাই করেছেন সহ-অধিনায়ক সাকিব। অর্থাৎ দলের মোট রানের ৩৫ শতাংশ রানই এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। উইকেট শিকারের দিক দিয়ে মুস্তাফিজের পর তাঁর অবস্থান।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দলের বাকি ক্রিকেটার এবং সাকিব আল হাসানের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়। অভিজ্ঞতার দিকে বাকিদলগুলোর তুলনায় এগিয়ে থেকে এবার বিশ্বকাপে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। স্কোয়াডে পাঁচজন সিনিয়র ক্রিকেটার ছিলেন, তাদের ঝুড়িতে ছিল অন্তত চার থেকে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতোগুলো বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন অনেকেই। উল্টো তরুণ ক্রিকেটাররা সিনিয়রদের থেকে দলকে বেশীই দিয়েছেন বললে ভুল হবে না।
বাংলাদেশ দলের পঞ্চপান্ডব ডাকা হয় তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম এবং সাকিব আল হাসানকে। কিন্তু পাঁচ পান্ডবের মধ্যে মাত্র একজনের কাছ থেকেই সেরাটা পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি রেকর্ডে নিজের নাম লেখানো সাকিব প্রশংসা কুড়িয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বের।
সাকিব দারুণ ফর্মে থাকলেও ওপেনার তামিম ইকবালকে এবারের আসরে চেনাই যায়নি। এক সময় আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য সুনাম অর্জন করা তামিম চলমান বিশ্বকাপে পালন করেছেন ভিন্ন ভূমিকা। হয়তো নিজের ভূমিকা পরিবর্তন করতে গিয়ে সেরাটা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এই ওপেনার। ওয়ানডেতে ছয় হাজারের উপর রান করা এই ক্রিকেটারের বিশ্বকাপে রয়েছে মাত্র একটি ফিফটি এবং মোট রান করেছেন এখন পর্যন্ত মাত্র ২২৭।

মুশফিকুর রহিম অবশ্য সাকিবকে যথেষ্ট সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর সেঞ্চুরি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে গিয়েছে এক কদম উপরে। তাঁর কাছ থেকে সেরাটাই পেয়েছে টাইগাররা। সাকিবের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যান তিনি। ৩৫১ রান করলেও দলের হতাশাজনক পারফর্মেন্সে ঢাকা পড়েছে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের পারফর্মেন্স।
গেল বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি মিলিয়ে তিনটি সেঞ্চুরি হাঁকানো মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কাছে লোয়ার অর্ডারে প্রত্যাশা ছিল আরেকটু বেশী। কিন্তু তিনি যেন নিজেকে মেলেই ধরতে পারলেন না এবার। সঙ্গে ছিল ইনজুরি সমস্যা, সব মিলিয়ে চেনা মাহমুদউল্লাহকে পায়নি বাংলাদেশ। যা বিশ্বকাপে দলের হতাশাজনক পারফর্মেন্সের পেছনে আরেকটি বড় কারণ। ৬ ম্যাচ খেলা মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র ১৯০ রান।
অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা হয়তো সাকিবকে হতাশ করেছেন সব থেকে বেশি। কারণ এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবথেকে বেশি উইকেট শিকারি বোলার এবারের আসরে নিয়েছেন মাত্র একটি উইকেট, ৩১৫ গড়ে বোলিং করেছেন তিনি। মাশরাফি নিজে তাঁর সেরাটা দিতে পারেননি যেকারণে বোলিংয়ে এর প্রভাব পড়েছে। প্রতিপক্ষের পাওয়ার প্লে'তে উইকেটই পায়নি টাইগাররা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে তো আক্রমণাত্মক বোলার হিসেবে শেষ পর্যন্ত সাকিবকেই বোলিংয়ে আসতে হয়েছে উইকেটের খোঁজে।
সিনিয়রদের থেকে জুনিয়রদের কাছ থেকে বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মেহেদি হাসান মিরাজ, লিটন দাস এবং মুস্তাফিজুর রহমান দলের প্রয়োজনে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তবে হতাশ করেছেন ওপেনার সৌম্য সরকার। তামিম এবং সৌম্যের জুটি প্রত্যেক ম্যাচেই ভালো শুরু পেয়েছে কিন্তু সেটাকে বড় স্কোরে রূপান্তরিত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত হাল ধরতে হয়েছে সাকিবকেই।
সব মিলিয়ে এসব পারফর্মেন্স দেখে সাকিব বলেই বসলেন বাকিদের মাঝে তাড়নার অভাব দেখেছেন তিনি। তাই তো পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশ দলের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করায় এড়িয়ে গেলেন তিনি। কোচ এবং অধিনায়ক পরিকল্পনা সাজাবেন, জানিয়েছেন সাকিব। তাহলে কি সহ-অধিনায়ক দলের পরিকল্পনার অংশ নেন না?
সাকিব বলেন, 'জানি না আমরা আসলে কি করবো। এটি আসলে কোচ এবং অধিনায়ক ভালো বলতে পারবে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিবে যে তাঁরা কিভাবে খেলতে চায়। সেভাবেই আমাদের খেলতে হবে। আর একটা জিনিস আমি বলতে পারি যে সবাই চেষ্টা করছে যার যার জায়গা থেকে। তবে আমার কাছে মনে হয় আমাদের আরেকটু মরিয়া হয়ে চেষ্টা করা উচিৎ ছিল।
'বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো খেলেছে। তবে যথেষ্ট ভালো আমরা খেলতে চাইনি, আমরা চেয়েছি জিততে। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি, যেটা আমার কাছে মনে হয় খুবই হতাশাজনক যে এতবড় টুর্নামেন্টে আমাদের যে আশা ছিল বা যে চিন্তা নিয়ে এসেছিলাম সেটি বাস্তবায়ন করতে পারলাম না। সেদিক থেকে আমরা খুবই হতাশ। আমার কাছে মনে হয় ছোট ছোট কিছু জিনিস যদি আমরা ঠিকভাবে করতে পারতাম তাহলে আমার মনে হয় ফলাফলটি অনেক ভালো হতো।'
বিশ্বকাপে ছোট ছোট ভুল বাংলাদেশকে ছিটকে দিয়েছে আসর থেকে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কেন উইলিয়ামসনকে সঠিক সময়ে রান আউট করতে পারেননি উইকেট রক্ষক মুশফিকুর রহিম। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ শুরুতেই ফেলেছিলেন সাব্বির রহমান। আর শেষ ম্যাচে রোহিত শর্মার ক্যাচ ফেলেছেন তামিম ইকবাল। বড় বড় ম্যাচে এমন ভুল করার ফল হাতেনাতেই পেয়েছে বাংলাদেশ। তিনটি ম্যাচেই এই ছোট ছোট ভুল ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
গত ম্যাচে ৯ রানে জীবন পাওয়া রোহিত সাজঘরে ফিরেছেন ১০৪ রানের ইনিংস খেলে। উদ্বোধনী জুটিতে যোগ করেছেন ১৮০ রান। এখানেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রন নিজেদের দিকে নিয়ে নিয়েছিল ভারত। ক্যাচটা না ফেললে ফলাফল ভিন্ন হতেও পারতো। ডেভিড ওয়ার্নার ইনিংসের শুরুতেই সাব্বিরকে সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় ওয়ার্নার হাঁকান সেঞ্চুরি, অস্ট্রেলিয়া পায় বিশাল সংগ্রহ। আর কেন উইলিয়ামসন তো মুশফিকের হাতে জীবন পেয়ে রস টেলরের সঙ্গে গড়েন বড় জুটি।
এই ভুলগুলো প্রসঙ্গে সাকিব আরও বলেন 'এখানে আমরা যারা খেলছি সবারই দায়িত্ব আছে ভালো খেলার, চেষ্টা করার। অনেক সময় হয় আবার অনেক সময় হয় না। সেটা অন্য জিনিস। তবে আমার কাছে মনে হয় কোনো কোনো সময় অ্যাপ্লিকেশনটি আরেকটু ভালো হলে হয়তো আমরা আরেকটু ভালো অবস্থায় যেতে পারতাম। সেটি বোলিং, ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিংয়ে হোক সব জায়গায়।
সবমিলিয়ে যদি আমি বলি পুরো বিশ্বকাপের তাহলে ফলাফল অনুযায়ী হতাশার, তবে অনেক ইতিবাচক দিক আছে। তবে ওগুলো আসলে বলে লাভ নেই কতগুলো ইতিবাচক দিক আছে। কারণ দিন শেষে ফলাফলটাই আসল। যেটি আসলে আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। রোহিতের ক্যাচ মিস না করলে হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। কারণ ও যে ফর্মে আছে এবং তাঁর মতো খেলোয়াড় যদি সুযোগ পায় তাহলে সেটা সে বড়ভাবেই কাজে লাগাবে এবং এটাই সে প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
তাই ওই ক্যাচটি আমাদের জন্য একটু খরুচে ছিল। একই সাথে আমি যেটি বললাম যে আমরা প্রথমের দিকে বোলিংটা ভালো করিনি, সেটাও একটা কারণ। আসলে দুটির কম্বিনেশনেই এমনটা হয়েছে যে ফিল্ডিংটা আমরা ওভাবে ভালো করতে পারিনি, একই সাথে বোলিংটাও আমরা ভালো করতে পারিনি।'