এশিয়া কাপ পরবর্তী দুই বছরের পথচলা

ছবি: ছবি- সংগৃহীত

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখা হয়ে গেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের। দুই বছর আগে এশিয়া কাপ জিতে সাফল্যের চুড়ায় পৌঁছে যাওয়া দলটি এ বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে শুন্য হাতে দেশে ফিরেছে। যে আঞ্জু জাইনের হাত ধরে এলো এশিয়া কাপের ট্রফি, তাঁর অধীনেই বিশ্বকাপের এই ব্যর্থতা।
এর জের ধরে ভারতীয় এই কোচকে আর রাখেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। আইসিসির বৈশ্বিক আসরে দলের এমন ব্যর্থতার পর গুঞ্জন উঠে দলের মধ্যে গ্রুপিং, একক সিদ্ধান্ত, স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন তিনি। এসব অভিযোগের কারণেই আঞ্জুর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেনি বিসিবি।
তবে সম্প্রতি বিসিবির সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন ভারতীয় এই কোচ। যদিও তাঁর অধীনেই সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এশিয়া কাপ জয়ের পর আঞ্জুর অধীনে ৪৪ ম্যাচে ২৬টিতে জয়ের মুখ দেখেছেন সালমা-জাহানারারা।
অথচ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি আশা ছিল তাঁদের নিয়েই। প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তানকে হারালেও মূল পর্বে দাঁড়াতে পারেনি মেয়েরা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিশ্চিত জয় হাতছাড়াও করেছে দলটি। কিন্তু গল্পটা যে এমন হওয়ার কথা ছিল না।
এশিয়া কাপের সাফল্যের পর বিশ্বকাপে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বরং এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জয়ের ঠিক দুই বছর পর এখন কোচবিহীন বাংলাদেশ। করোনা পরিস্থিতির মাঝেই আঞ্জু জাইন চলে গেছেন ভারতে। নিজ দেশের একটি রাজ্য দলের মেয়েদের কোচের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। এমন অবস্থায় নারী ক্রিকেট দলের ভবিষ্যত কোন পথে যাবে তা এখন বড় প্রশ্ন।
এদিকে বিশ্বকাপের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে সম্প্রতি ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের পেসার ও সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম। তাঁর মতে, বিশ্বকাপের আগে ছোট দলের সঙ্গেই বেশি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ বলেই বড় দলের বিপক্ষে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি টাইগ্রেসরা।

ক্রিকফ্রেঞ্জিকে জাহানারা বলেন, 'বড় দল বা ভালো দলের সঙ্গে যদি ম্যাচ না পাই তাহলে মুশকিল, আমাদের উন্নতিটা সেভাবে হবে না। যেমন লকডাউনের মধ্যে ফিটনেস না করলে ফিটনেস বাড়বে না। বরং নষ্ট হতে থাকবে, কিছু ফ্রি হ্যান্ড করলে সমান থাকবে। আমাদের অবস্থাও ওই পর্যায়ে আছে।'
জাহানারা আরো বলেন, 'ভালো দলের সঙ্গে না খেললে উন্নতি হবে না তবে একটা জায়গায় স্থির থাকবো। খুব বেশি অবনতি হবে না। যেমন আমরা মনে করি শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে দুর্বল দল। কিন্তু ওরা প্রতি বছর খেলার মধ্যে থাকে, প্রচুর পরিমাণে ম্যাচ খেলে। এই কারণেই ওরা এগিয়ে যায়। আমরা একটা দল হিসেবে খেলেও এগুতে পারছি না। কারণ আমরা বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছি না, ম্যাচও সে??াবে খেলছি না।'
এমন অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য কি করতে হবে সে উপায়ও বাতলে দিয়েছেন সাবেক এই অধিনায়ক। জাহানারা বলেন, 'আমাদের অবস্থার উন্নতি করতে হলে প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে হবে। পাশাপাশি ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলো খেলতে হবে যা আমাদের হয়ই না। নতুনরা না আসলে পুরাতনদের পারফরম্যান্সের ক্ষুধা কমে যাবে। ধরে নেবে তাঁর জায়গা থিতু, পারফর্ম করলেও দলে থাকবো, না করলেও থাকবো। হার-জিত পরের কথা, এটা একটা বিষয় রয়ে যায়। এটা আমার মনে হয়।'
পরিসংখ্যান বলছে ২০১৮ এশিয়া কাপের পর বাংলাদেশ মোট ম্যাচ খেলেছে ৪৪টি। যার মধ্যে ৪১টি টি-টোয়েন্টি এবং ৩টি ওয়ানডে। দুই বছরে টি-টোয়েন্টিতে নারীরা জিতেছে ২৬টি ম্যাচ এবং ওয়ানডে জিতেছে ২টি। ফলাফল হয়নি ৩টির। এর মধ্যে বড় দলের বিপক্ষে সালমাদের লড়তে হয়েছে মোট ২২টি ম্যাচে, ছোট দলের সঙ্গেও একই সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন তারা।
অথচ ২০১৬ এশিয়া কাপের পর ২০১৮ এশিয়া কাপ পর্যন্ত বড় দলের সঙ্গে নারীরা ম্যাচ খেলেছেন ২৪টি, ছোট দলের সঙ্গে মাত্র ৩টি। মোট ২৭ ম্যাচের মাত্র ৭টিতে জিতলেও বড় দলের সঙ্গে বেশি বেশি খেলে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে তাদের। এর মধ্যে টি-টোয়েন্টি ছিল ১২টি এবং ওয়ানডে ১৫টি।
ছোট দলের সঙ্গে বেশি ম্যাচ খেলার প্রসঙ্গে জাহানারার ভাষ্য, 'এশিয়া কাপের আগে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ খেলেছিলাম, টানা ৮ ম্যাচ হারার পরও আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে সেখান থেকে। ভালো দলের সঙ্গে খেলে হারলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচ হয়েছিল। সবাই ভালো খেলেছিল, বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণেই কয়েকটা ম্যাচ হেরেছিলাম। এরপর এরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচ কিন্তু আমরা আর খেলিনি, বিগত ২ বছরে।'
'বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে তাঁদের মাঠে সিরিজ খেলেছি আমরা। সেখানে টানা ম্যাচ হারলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল। প্রতিটা ম্যাচের খুব কাছাকাছি গিয়েছি। এরপর কিন্তু বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে আমরাই পাকিস্তানকে হারাই। আসলে আমাদের প্রচুর ম্যাচ খেলা প্রয়োজন, যেটা আমরা খেলতে পারছি না। যারা আইসিসির শীর্ষ ৮ দলের মধ্যে আছে তারা নিয়মিত ম্যাচ খেলতে থাকে, আমরা এখানে ছোট ছোট দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলি। যার জন্য উন্নতিটা ওইভাবে করে বোঝা মুশকিল।'
বিশ্বকাপে নারীদের থেকে বড় কিছুর আশাই করেছিলেন উইমেন্স ক্রিকেট উইংয়ের চেয়ারম্যান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলও। এশিয়া কাপের সাফল্যের পর বিশ্বকাপে সফল হতে সব কিছুই করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এই ব্যর্থতা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান নাদেল।
ঘুরে দাঁড়ানোর আশা ব্যক্ত করে ক্রিকফ্রেঞ্জিকে শফিউল আলম বলেন, 'এশিয়া কাপ এবং এরপরের কয়েকটি সিরিজে আমরা ভালো খেললেও বিশ্বকাপে গিয়ে এই ধারাবাহিকতা আমরা রাখতে পারেনি। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সাফল্য পেতে আমাদের যেটা করার প্রয়োজন ছিল সেটাই করেছি, বোর্ডও কোন কিছুতে আমাদের না করেনি। এটাই অপ্রাপ্তি।'
'প্রাপ্তির জায়গা অনেক আছে। জীবনের মতো খেলাতেও উথান-পতন থাকবে। বিশ্বকাপ শেষে আসার পরই করোনা এসে পরল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আমরা আবার শুরু করব। গত দুই বছরে যে ধারাবাহিক পারফরম্যন্স ছিল আমি আশাবাদী আবারও সেখানে ফিরে যাবো।' আরও যোগ করেন তিনি।
২০১৮ সালের আগের প্রতি আসরেই এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন ছিল ভারত। কিন্তু সেবার হিসেব পাল্টে দেন বাংলাদেশের নারীরা। ফাইনালে ভারতকে শেষ বলে হারিয়ে পুরো বাংলাদেশকে আনন্দের জোয়ারে ভাসান সালমা-জাহানারা। এই সাফল্যের দুই বছর পর বড় মঞ্চে গিয়ে নিজেদের সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি বাংলদেশ।