ইমারতের বিকেএসপি ও প্রস্তুতি ম্যাচের সংস্কৃতি

ছবি: ছবি- সংগৃহীত

|| স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ||
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। রাজধানীর যান্ত্রিকতা ছেড়ে সবুজে ঘেরা এই প্রাঙ্গনে আসলেই প্রাণ জুড়ায়। তাজা সুবাতাস দেহে প্রশান্তির পরশ বুলায়। যদিও বহু বছর ধরে শিল্পায়ন, নগরায়নের মহাসমারোহ আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে আছে সবুজের এই মেলাকে। তার মাঝেও অটুট ছিল প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
সময় গড়ায়, বছর যায়, বছর আসে। বিকেএসপির সবুজেও ইট-পাথরের আগ্রাসন ছাপ ফেলে। ক্রীড়া শিক্ষায় দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানে গত ৫ বছরে তৈরি হয়েছে কয়েকটি নতুন নতুন স্থাপনা। প্রধান ফটক থেকে কিছুটা দূরে তৈরি হয়েছে জিমন্যাসিয়াম। অনেক ডিসিপ্লিনের অনুশীলন হয় সেখানে।
জামে মসজিদের চারপাশে লেগেছে বাহারি সাজ। নানা জাতের ফুলের সমাবেশ চোখে পড়বে। বিকেএসপির একপ্রান্তে ছিল তিন নম্বর ও চার নম্বর মাঠ। মূলত ক্রিকেটের জন্যই মাঠ দুটি ব্যবহার হয়। তিন নম্বর মাঠের পাশের ডোবা ভরাট করা হয়েছে। সেখানে এখন গাড়ি পার্ক করতে দেখা গেছে। তার অপরপাশেই গড়ে উঠছে বিশাল ভবন। বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের মাধ্যমে জানা গেল, এটি মেয়েদের হোস্টেল হবে।
রান প্রসবা তিন নম্বর মাঠটারও অবয়বও বেশ বদলেছে। একপ্রান্তে বানানো হয়েছে ছোট গ্যালারি। শীতের মিঠে রোদ পোহানোর সঙ্গে মাঠের ক্রিকেটও উপভোগ করা যাবে এখানে বসে। কিন্তু এই গ্যালারি গড়ে উঠেছে সবুজ ঘাসের প্রান্তরকে চাপা দিয়ে। যা গত বছরও ছিল না।
চার নম্বর মাঠের পাশেও স্থাপনা দাঁড়িয়েছে। ডরমেটরি জানান দিচ্ছে বিকেএসপিতে ইমারতের আচ্ছাদন ক্রমশ পোক্ত হচ্ছে। এরই মাঝে চলছে দেশের প্রতিভাবানদের ভবিষ্যতের তারকা হওয়ার নিরলস প্রচেষ্টা। বিসিবি একাদশের বিরুদ্ধে জিম্বাবুয়ের দুই দিনের প্রস্তুতির ম্যাচ দেখার মাধ্যমে ক্রমেই বদলাতে থাকা বিকেএসপির রুপটা ধরা পড়ল।
প্রস্তুতি ম্যাচের প্রথম দিনের (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালটা ছিল কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন। রোদ উঁকি দিতে অবশ্য বিলম্ব হয়নি। রোদ্রকজ্জল সকালে ব্যাটিংয়ে নামে জিম্বাবুয়ে। প্রস্তুতি ম্যাচে সাধারণত টসের আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। সফরকারীরা চেয়েই ব্যাটিং অনুশীলনের সুযোগটা নিয়েছে।

প্রস্তুতি ম্যাচ নিছকই প্রস্তুতির মঞ্চ। জিম্বাবুয়ে যার সঠিক ব্যবহারই করেছে। সদ্য বিশ্বকাপ জয়ী বাংলাদেশ যুব দলের ৬ ক্রিকেটারের উপস্থিতিই ছিল ম্যাচটার মূল আকর্ষণ। বিশ্ব জয়ের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে স্ব-স্ব বাড়ি থেকে ম্যাচের আগের দিন ঢাকায় ফিরেন আকবর আলী-শরীফুলরা। তেমন কোনো অনুশীলন ছাড়াই সাদা বল থেকে লাল বলের ক্রিকেটে নেমে পড়েন তারা।
যুব পর্যায় থেকে সিনিয়র ক্রিকেটে তাদের নতুন অধ্যায়ের শুরুটা একটা টেস্ট দলের বিরুদ্ধে, যেটা তৃপ্তির আস্বাদ দিয়েছে পারভেজ হোসেন ইমনদের। তাদের উপর চোখ বোলাতে ম্যাচ শুরুর আগেই মাঠে হাজির হন জাতীয় দলের দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও হাবিবুল বাশার সুমন।
ম্যাচের বয়স ৩০ মিনিট পার না হতেই উপস্থিত সবার মুখে মুখে ফিরল তিন নম্বর মাঠের উইকেট। বলতেই হয় যে, উইকেট যেন বিরক্তির উদ্রেকই করলো। নিষ্প্রাণ উইকেটে নতুন বলে দুই প্রান্তে বোলিং করলেন মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ ও শরীফুল ইসলাম। বোলিং করছেন আর সীমানা দড়ির কাছে ফিরে ঢকঢক পানি গিলছেন তারা। নতুন বল পেল না কোনো মুভমেন্ট, বাউন্স। মরা উইকেটে প্রাণ আনার
প্রাণান্ত চেষ্টায় সফল হননি দুই পেসার। পরে সুমন খানও গতির ঝড় তুলতে গিয়ে সংগ্রাম করলেন। উইকেট যে তাদের চেষ্টাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল প্রতিনিয়ত। যার কারণ উদ্ধারেও সময় লাগেনি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত কয়েক মাসে ব্যস্ত সময় পার করছে বিকেএসপির মাঠ। দম ফেলানোর ফুরসত নেই। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ হয়েছে, যুবাদের ক্যাম্প হয়েছে।
এখন চলছে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ। প্রস্তুতি ম্যাচ চলাকালীনই চার নম্বর মাঠে চলছিল দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটের ম্যাচ। এমনকি প্রস্তুতি ম্যাচের পরদিনই তিন নম্বর মাঠে আছে এই লিগের ম্যাচ।
টানা ম্যাচের সূচিতে উইকেট বিশ্রাম পায় না। ঘাস গজানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। কার্যত মরা উইকেটেই চললো ম্যাচ। তবে এটুকু সত্যি, ব্যাটিং- বোলিং-ফিল্ডিং মিলে তিন বিভাগে পরিপূর্ণ অনুশীলনই হয়েছে জিম্বাবুয়ের। বাড়তি পাওয়া এই অনুশীলনটা হয়েছে ম্যাচের আবহে।
এর মাঝেও সফরকারীদের তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল এবং সেটা স্বাভাবিক কর্মই বটে। যেমনটা গোটা ম্যাচ ভিডিও করেছেন জিম্বাবুয়ের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট মুফারো চিতুরুমানি। যার ছিঁটেফোটাও দেখা গেল না বিসিবি একাদশে।
শুধু খেলার জন্যই যেন খেলা। মাঠে নামার আগে কিছুক্ষণ ওয়ার্মআপ হলো ট্রেনার তুষার কান্তি হাওলাদারের অধীনে। পাশের উইকেটে কিছুক্ষণ বোলিং করলেন বোলাররা, যার তত্ত্বাবধান করেছেন বোলিং কোচ তালহা জুবায়ের। শেষ বেলায় কোচ দীপু রায় চৌধুরী দুদন্ড কথা বললেন আল-আমিন জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে।
তারপর দিনভর কোচদের কাউকে দেখা গেল না কথা বলতে। হেলদোল নেই কারো মাঝে। ডাগআউটে বসে খেলা দেখছেন। বোলাররা বোলিং করে যাচ্ছেন, ভালো-মন্দ কোনো কিছুতেই সক্রিয় দেখা যায়নি কোচদেরকে। প্রস্তুতি ম্যাচ হলেও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ৬ ক্রিকেটারের জন্য এটাই প্রথম ক্রিকেটের বড় মঞ্চ দর্শন।
ম্যাচ জেতার সুযোগ নেই, এটা স্পষ্ট। কিন্তু দল হিসেবে প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়ার লক্ষণ নেই। একটা টেস্ট দলকে চেপে ধরা, তাদেরকে কঠোর প্রতিরোধের মুখে ফেলাও হতে পারতো এসব ক্রিকেটারদের জন্য বড় অভিজ্ঞতা। ক্যারিয়ারের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য যেটি তাদের প্রেরণার উৎস হতো। কিন্তু সামগ্রিক সবার আড়ষ্টতায় (কোচ-ম্যানেজমেন্ট) সিনিয়র ক্রিকেটে আকবরদের প্রথম অভিজ্ঞতাও হয়ে থাকলো ‘দুলকি চালে চলার’ নিদর্শন হয়ে।
অবশ্য ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তানজিদ হাসান তামিমের দৃষ্টিনন্দন ‘স্ট্রোক প্লে’ সেঞ্চুরি, অধিনায়ক আল-আমিন জুনিয়রের সেঞ্চুরিটা ৬৯ রানে ৫ উইকেট হারানো বিসিবি একাদশের মান বাঁচিয়েছে। তাদের ২১৯ রানের জুটিই জিম্বাবুয়ের প্রস্তুতি পর্বে বেলাশেষের গান বাজিয়ে দেয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই অভাবটা বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অনেকটাই নিয়মিত দৃশ্য। লংগার ভার্সনে কেন জানি নির্জীব থাকেন ক্রিকেটাররা। এই প্রস্তুতি ম্যাচেও যার প্রদর্শনী অব্যাহত ছিল।
সংস্কৃতি বদলের উদাহরণ গড়েই ভারত এখন বিশ্ব ক্রিকেটের অপ্রতিরোধ্য এক দল। সব ধরনের ক্রিকেটেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতি এখন বাংলাদেশের জন্য আবশ্যক। যেখানে সংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতা বদলের মাধ্যমে নতুন ধাপে পা রাখতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট।