ভারত - বাংলাদেশ সিরিজ

১৮ উইকেট পতনের দিনে ২৬ রানে পিছিয়ে বাংলাদেশ

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক
প্রকাশের তারিখ: 10:22 সোমবার, 30 সেপ্টেম্বর, 2024

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

আড়াই দিনের অপেক্ষার পর প্রথম ইনিংসে আবারও ব্যাটিংয়ে নামতে পেরেছিল বাংলাদেশ। কে জানত দিনের শেষ বিকেলেই আবার দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করবে টাইগাররা। তবে কানপুরে ঘটনাবহুল দিন কেটেছে দুই দলেরই। পতন হয়েছে ১৮ উইকেটের। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৫২ রানের লিডের পর ২৬ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেছে বাংলাদেশ। এর আগে প্রথম ইনিংসে ২৩৩ রান করে অল আউট হয় বাংলাদেশ। জবাবে ভারত ব্যাটিংয়ে নেমে একের পর এক রেকর্ডের জন্ম দিয়ে ২৮৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমেও স্বস্তিতে নেই বাংলাদেশ।

ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থেকে খেলতে নেমে শুরুতেই বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অফ স্পিনে পুরোপুরি ‘বিট’ হয়েছিলেন বাঁহাতি জাকির হাসান। বল ব্যাটেই লাগাতে পারেননি লাগে পেছনের পায়ে। ভারতের ক্রিকেটারদের আবেদনে আঙুল তুলে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। তবে রিভিউ নেন জাকির। তবে রক্ষা হয়নি। ইনিংসের অষ্টম ওভারেই সাজঘরে ফিরতে হয় বাংলাদেশের ওপেনারকে।

এরপর আরেক ওপেনার সাদমান ইসলামকে সঙ্গ দিতে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে আসেন হাসান মাহমুদ। তবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তিনি উইকেট বিলিয়ে দিয়ে দলের বিপদ ডেকে আনেন। ইনিংসের দশম ওভারে অশ্বিনকেই ছক্কা মারতে গিয়ে বোল্ড হন হাসান। ফলে ৯ বলে ৪ রান করেই ফিরে যেতে হয় তাকে। এরপর বাধ্য হয়েই ব্যাটিংয়ে নামতে হয় মুমিনুল হককে। এরপর অবশ্য বাংলাদেশকে আর কোনো বিপদ হতে দেননি সাদমান মুমিনুল। সাদমান ৭ ও মুমিনুল কোনো রান না করেই অপরাজিত থেকে ইনিংস শেষ করেন।

এর আগে বাংলাদেশকে জবাব দিতে নেমে হাসানের ইনিংসের করা তৃতীয় বলে চার মেরে ভারতের রানের খাতা খুলেন ইয়াসভি জয়সাওয়াল। একই ওভারে বাঁহাতি ব্যাটার মেরেছেন আরও দুই চার। সবমিলিয়ে প্রথম ওভার থেকে এসেছে ১২ রান। দ্বিতীয় ওভারে খালেদের বিপক্ষে বেশ মারমুখী ছিলেন রোহিত।প্রথম দুই বলে মেরেছেন দুই ছক্কা, ওভারের শেষ বলে জয়সাওয়াল মেরেছেন এক চার। নিজের করা প্রথম ওভারে খালেদ দিয়েছেন ১৭ রান। তৃতীয় ওভারে হাসানের বিপক্ষে দুই ছক্কা ও দুই চারে ২২ রান নিয়েছেন ভারতের দুই ওপেনার। তাতে মাত্র ৩ ওভারে পঞ্চাশ রানের জুটি গড়ে তারা দুজন। টেস্ট ক্রিকেটে এটিই দ্রুততম দলীয় পঞ্চাশের বিশ্ব রেকর্ড।

দুই পেসারের বিপক্ষে রোহিত ও জয়সাওয়াল তাণ্ডব চালানোয় ইনিংসের চতুর্থ ওভারে মিরাজের হাতে বল তুলে দেন শান্ত। ডানহাতি অফ স্পিনারের চতুর্থ বলটি আঘাত হানে রোহিতের প্যাডে। বাংলাদেশের ফিল্ডাররা আবেদন করতেই আঙুল তুলে আউট দেন আম্পায়ার। তৎক্ষণাৎ রিভিউ নিয়ে অবশ্য বেঁচে যান ভারতের অধিনায়ক। টিভি রিপ্লেতে নট আউট দেখানোর পর আম্পায়ারের উপর খানিকটা রাগ ঝেড়েছেন তিনি। জীবন পেয়ে অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি রোহিত। পরের বলে মিরাজের নিচু হওয়া ডেলিভারিতে বোল্ড হয়েছেন ২৩ রান করা এই ব্যাটার।

নিজের প্রথম ১৩ বলে ৩০ রান করলেও রোহিত ফেরায় খানিকটা দেখেশুনে খেলতে থাকেন জয়সাওয়াল। হাফ সেঞ্চুরি পেতে বাঁহাতি ওপেনারকে খেলতে হয়েছে ৩১ বল। ভারতের হয়ে টেস্টে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির তালিকায় পান্ত, কপিল দেব এবং শার্দুল ঠাকুরের পরই তার নাম। ৩ ওভারে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও ভারতের একশ হয়েছে ১০.১ ওভারে। টেস্টে ক্রিকেটে ওভারের বিবেচনায় এটিই সবচেয়ে দ্রুততম দলীয় একশ রান। এর আগে ১২.২ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একশ করেছিল ভারত। হাফ সেঞ্চুরি পাওয়া জয়সাওয়ালের ঝড় থামিয়েছেন হাসান।

ডানহাতি পেসারের নিচু হওয়া ডেলিভারিতে বোল্ড হয়েছেন ৭২ রানের ইনিংস খেলা জয়সাওয়াল। চারে নিয়মিত কোহলি ব্যাটিং করলেও এদিন পাঠানো হয় পান্তকে। চা-বিরতি থেকে ফেরার পরই বাংলাদেশকে উইকেট এনে দেন সাকিব। বাঁহাতি স্পিনারের ঝুঁলিয়ে দেয়া ডেলিভারিতে লং অফের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে হাসানের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ৩৯ রানের ইনিংস খেলা গিল। একটু পর পান্তকেও সাজঘরে পাঠিয়েছেন সাকিব। দ্রুত রান তোলার তাড়ায় স্লগ সুইপ করতে গিয়ে হাসানের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন ৯ রান করা পান্ত।

চতুর্থ উইকেটের পতনের পর কোহলিকে নিয়ে ভারতের ইনিংস টানতে থাকেন লোকেশ রাহুল। এই জুটির পথেই তাইজুল ইসলামের বলে সুইপ করে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন রাহুল। একটু পর কোহলিকে বোল্ড করে আউট করেন সাকিব। হাফ সেঞ্চুরির আক্ষেপে পোড়া কোহলিকে ফিরতে হয়েছে ৩৫ বলে ৪৭ রানের ইনিংস খেলে। কোহলি ফিরে যাওয়ার পর জাদেজাকে থিতু হতে দেননি মিরাজ। বাংলাদেশের অফ স্পিনারের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ডিফেন্স করতে গিয়ে প্যাডে লেগে বল সোজা চলে যায় কাভারে শান্তর হাতে। ফলে ৮ রান করেই ফিরে যেতে হয় জাদেজাকে।

অশ্বিনকে ফিরিয়ে নিজের চতুর্থ শিকার তুলে নেন সাকিব। অফ স্টাম্পে পিচ করা বল কাট করতে গিয়ে লাইন মিস করে বোল্ড হয়েছেন তিনি। পরের ওভারে প্রথম বলেই ৬৮ রান করা লোকেশ রাহুলকে নিজের শিকার বানান মিরাজ। অভিজ্ঞ অফ স্পিনারের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে উইকেট থেকে কেরিয়ে এসে খেলতে গিয়ে স্টাম্পিং হয়েছেন রাহুল। ১২ রান করা আকাশকেও ফেরান মিরাজ। ৯ উইকেটে ২৮৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা দেয় ভারত। বাংলাদেশের হয়ে চারটি করে উইকেট নিয়েছেন সাকিব ও মিরাজ।

দিনের শুরুতে আড়াইদিনের অপেক্ষা শেষে ৩ উইকেটে ১০৭ নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামেন মুশফিকুর রহিম এবং মুমিনুল হক। বল হাতে নেয়ার পর থেকেই মুশফিকের বিপক্ষে অফ স্টাম্পের বাইরে একই লেংথে বোলিং করে যাচ্ছিলেন বুমরাহ। ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর বুমরাহর ডেলিভারিগুলো ছেড়ে দিচ্ছিলেন মুশফিক। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ব্যাটারকে ফেরাতে এবার একটু ফুলার লেংথে ফেলে একটু ভেতরে ঢোকালেন বুমরাহ। আগের মতো এবার ছেড়ে দেয়ায় বোল্ড হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। ৩২ বল খেলা এই ব্যাটার করেছেন ১১ রান। নিয়মিত সাতে ব্যাটিং করলেও এদিন সাকিবের আগে ছয়ে এসেছিলেন লিটন দাস।

ব্যাটিংয়ে এসে বুমরাহর এক ওভারে তিন চার মেরেছেন বাংলাদেশের উইকেটকিপার ব্যাটার। দারুণ ব্যাটিং করতে থাকা মুমিনুল সকালের শুরুতেই হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। মোহাম্মদ সিরাজের প্রথম বলে মুমিনুলকে কট আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক অবশ্য তৎক্ষণাৎ রিভিউ নিয়েছিলেন। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বল মুমিনুলের ব্যাট নয় উরুতে আঘাত হেনেছে। তাতে রিভিউ নিয়ে জীবন ফিরে পান বাঁহাতি এই ব্যাটার। জীবন পাওয়ার পরের বলে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে পুল করে চার মেরে ১১০ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন।

ছয়ে নেমে ব্যাট হাতে বেশ সাবলীল ছিলেন লিটন। বুমরাহর এক ওভারে তিন চার মারা ডানহাতি ব্যাটার বাউন্ডারি বের করতে চেয়েছিলেন সিরাজের বিপক্ষেও। ডানহাতি পেসারের অফ স্টাম্পের বাইরের গুড লেংথ ডেলিভারিতে উইকেট থেকে বেরিয়ে এসে মিড অফ উপর দিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন লিটন। তবে শর্ট মিড অফে দাঁড়িয়ে থাকা রোহিত এক হাতে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলে সাজঘরে ফিরতে হয় ১৩ রান করা বাংলাদেশের উইকেটকিপার ব্যাটারকে। ৬ ইনিংসে তৃতীয়বারের মতো সিরাজকে উইকেট দিলেন তিনি। সাতে নেমে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি সাকিবও।

রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ঝুলিয়ে দেয়া ডেলিভারিতে উইকেট থেকে বেরিয়ে এসে এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে চার মারেন সাকিব। পরের বলে বাঁহাতি ব্যাটার অশ্বিনের একই জাতীয় ডেলিভারিতে উড়িয়ে মারতে চাইলেন বোলারের মাথার উপর দিয়ে। তবে হাত থেকে ব্যাটের গ্রিপ খানিকটা ফসকে যাওয়ায় টাইমিং হলো না ঠিকঠাক। মিড অফে দাঁড়িয়ে থাকা সিরাজ অনেকটা পথ দৌড়ে গিয়ে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ নিয়েছেন। কানপুর টেস্টের আগে অবসরের ঘোষণা দেয়া সাকিবকে ফিরতে হয়েছে ৯ রানে। ব্যাটারদের আসা-যাওয়ার মিছিলে অবিচল ছিলেন মুমিনুল। ভারতের পেসার ও স্পিনারদের সমানতালে শাসন করেছেন তিনি।

লাঞ্চের এক ওভার আগে অবশ্য সিরাজের গুড লেংথে পড়ে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা কোহলিকে ক্যাচ দিয়েছিলেন মুমিনুল। যদিও বাঁ’দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও ক্যাচ লুফে নিতে পারেননি কোহলি। জীবন পাওয়ার পরের ওভারে অশ্বিনকে সুইপে চার মেরে ১৭২ বলে ক্যারিয়ারের ১৩তম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন মুমিনুল। দেশের বাইরে এটি তার দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। প্রথমটি করেছিলেন ২০২১ সালে পাল্লেকেলেতে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ভারতের বিপক্ষে অবশ্য মুমিনুলের এটি প্রথম সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে ভারতের মাটিতে সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রথমটি করেছিলেন মুশফিক।

দিনের প্রথম সেশনে ৩১ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ৯৮ রান তোলে বাংলাদেশ। যেখানে মুমিনুল একাই করেছেন ৬২ রান। লাঞ্চ থেকে ফেরার পর বুমরাহর ওভারের প্রথম বলে চার মেরে মুমিনুলের সঙ্গে জুটির পঞ্চাশ করেন মিরাজ। পরের বলে ডানহাতি ব্যাটার মেরেছেন আরও এক চার। সাবলীল ব্যাটিং করতে থাকলেও ভারতের পেসারের বিপক্ষে টিকতে পারেননি তিনি। বুমরাহর অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে খোঁচা দিতে গিয়ে গিলের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন ২০ রান করা মিরাজ। নিজের পরের ওভারে এসে তাইজুল ইসলামকেও ফিরিয়েছেন বুমরাহ।

হাসান, খালেদরা দ্রুতই ফিরলে লাঞ্চের পর ৮.২ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে মাত্র ২৮ রান তোলে বাংলাদেশ। খালেদকে নিজের হাতে ক্যাচ বানিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের ৩০০তম উইকেট তুলে নেন জাদেজা। সফরকারীদের ২৩৩ রানে অল আউট হওয়ার দিনে একপ্রান্ত আগলে রাখা মুমিনুল অপরাজিত ছিলেন ১০৭ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে। ভারতের হয়ে সর্বোচ তিনটি উইকেট নিয়েছেন বুমরাহ। দুটি করে উইকেট পেয়েছেন সিরাজ, অশ্বিন এবং আকাশ দীপ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর-

বাংলাদেশ (প্রথম ইনিংস)- ২৩৩/১০ (৭৪.২ ওভার) (জাকির ০, সাদমান ২৪, মুমিনুল ১০৭*, শান্ত ৩১, মুশফিক ১১, লিটন ১৩, সাকিব ৯, মিরাজ ২০)

ভারত (প্রথম ইনিংস)- ২৮৫/৯ (৩৪.৪ ওভার) (জয়সাওয়াল ৭২, রোহিত ২৩, গিল ৩৯, পান্ত ৯, কোহলি ৪৭, রাহুল ৬৮; মিরাজ ৪/৪১, সাকিব ৪/৭৮) (ডিঃ)

বাংলাদেশ (দ্বিতীয় ইনিংস)- ২৬/২ (১১ ওভার)  (সাদমান ৭*, জাকির ১০, হাসান ৪, মুমিনুল ০*; অশ্বিন ২/১৪)