ভারতকে টক্কর দেয়ার মতো স্পিনার আমাদের আছে: মুশতাক
ছবি:
|| ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট ||
রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় টেস্ট জয়ের পর নাজমুল হোসেন শান্ত সংবাদ সম্মেলনে এসে জানিয়েছিলেন, এমন মুহূর্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা। পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে হোয়াইটওয়াশ করা নিশ্চিতভাবেই দেশের ক্রিকেটের সেরা সাফল্যের একটি। বাংলাদেশের এমন সাফল্যের পেছনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছেন মুশতাক আহমেদ। পুরো সিরিজ জুড়ে ব্যাটার এবং পেসাররা দাপট দেখালেও আড়ালে থেকে নিজেদের কাজটা করেছেন স্পিনাররা।
পুরোদমে অবদান রাখতে না পারলেও দলের প্রয়োজনে ঠিকই নিজের কাজটা সেরেছেন সাকিব আল হাসান। স্পিনারদের অবদান কতটা ছিল সেটার প্রমাণ মিলে অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজের সিরিজ সেরা হওয়া। বাংলাদেশের সিরিজের জয়, প্রি-অনুশীলন ক্যাম্প এবং ভারতের সফরে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার গল্প ক্রিকফ্রেঞ্জিকে শুনিয়েছেন মুশতাক। বাংলাদেশের সাবেক স্পিন পরামর্শকের গল্প শুনেছেন আবিদ মোহাম্মদ।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: দেশের মাটিতে না পারলেও পাকিস্তানে গিয়ে বেশ কয়েকদিনের অনুশীলন ক্যাম্প করেছিল বাংলাদেশ। আগেভাগে পাকিস্তানে যাওয়া, অনুশীলন করা বাংলাদেশকে অনেকটাে এগিয়ে দিয়েছে কিনা।
মুশতাক: আমি বলবো বাংলাদেশের এমন একটা সিরিজ জয়ের পিসিবিরও খানিকটা কৃতিত্ব আছে। তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ ছিল, তারা ঠিকঠাক অনুশীলন করতে পারছিল না। এমন একটা পরিস্থিতিতে পিসিবির পক্ষ থেকে বিসিবিকে ফোন করে আগেভাগে সেখানে যেতে বলে। যেটা বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে, কারণ ছেলেরা আগে গিয়ে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের মাটিতে ছেলেরা যা করেছে তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য।
তারা যেভাবে মনোযোগ ধরে রেখেছিল... যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছে তার ফলাফল আপনারা এই সিরিজে দেখেছেন। ছেলেরা দেশের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়েই পাকিস্তান গিয়েছিল। আর আমি তো ছিলামই, সেখানের কন্ডিশন, আবহাওয়া, উইকেট কেমন হবে তা নিয়ে আমি তাদের ধারণা দিয়েছিলাম, যা ছেলেদের কাজে লেগেছে। পাকিস্তানে অনেক গরম ছিল, ছেলেরা দ্রুত সেটার সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। তাই আমার মনে হয় আগে গিয়ে অনেক লাভবান হয়েছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পাকিস্তানে যাওয়ার আগে ক্রিকেটাররা বাংলাদেশে দুই মাসের ক্যাম্প করেছে। এটা কতটা কাজে দিয়েছে বলে মনে হয়....
মুশতাক: দেখুন, একটা সিরিজ জয়ের কিংবা সাফল্যের পেছনে অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে। টেস্ট নিয়ে বিসিবি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেছে। এজন্যই কিন্তু তারা দুই মাসের ক্যাম্প করেছে। আপনি যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের মাঝে বেশিরভাগই পাকিস্তানে পারফরর্ম করেছে। আপনি যখন কোন কিছু পরিকল্পনা করবেন এবং সেটার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হবে তখন আপনি এমন সাফল্য পেতে বাধ্য। নিয়তই সব, আপনাকে সবার আগে এটা ঠিক করতে হবে। তাহলে আপনি এমনিই সফল হবেন।
দেখুন, সিলেট আর চট্টগ্রামে যে ক্যাম্পটা হয়েছিল সেখানে মুশফিক, সাদমান, জাকির কিংবা মিরাজরা ছিল। টেস্টের মানসিকতা তারা সেখান থেকেই পেয়েছে। পাকিস্তানে গিয়ে তারা কেমন করেছে এটা তো এখন সবারই জানা। আমি যেহেতু পাকিস্তানের তাই জানতাম উইকেট কেমন হবে। সেটা নিয়ে ছেলেদের আগেই ধারণা দিয়েছিলাম। আমাদের ছেলেরা জেনে বুঝে সেভাবে অনুশীলন করেছে। আমার কাছে মনে হয় পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পেছনে ওই ক্যাম্পেরও বড় একটা অবদান আছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময় দেখতাম কেউ একজন নায়ক হয়ে ম্যাচ জেতাচ্ছে। পাকিস্তান সফরে তো নায়কের শেষ নেই...
মুশতাক: দেখুন, আপনি কাকে রেখে কাকে কৃতিত্ব দেবেন! মুশফিক কি দারুণ খেলেছে। মিরাজ, সাদমান, মুমিনুল ওদের নাম তো আপনাকে নিতেই হবে। আবার জাকির ও সাদমান তো আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে। তারা যে ধরনের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে খেলেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। নতুন বলে ওরা শাহীন বা বাকিদের উইকেট ছুঁড়ে দেয়নি। এতে বল পুরাতন হয়েছে, উইকেট ফ্ল্যাট হয়েছে এবং বাকিরা এটার সুবিধা পেয়েছে। মূলত আমি মনে করি নতুন বলে ওপেনাররা যে জুটি করেছিল এটা সিরিজের টোন সেট করে দিয়েছিল। বাকিরা এখান থেকেই আত্মবিশ্বাস পেয়েছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পুরো সিরিজে নাজমুল হোসেন শান্তর কাছ থেকে প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দেখা যায়নি। তবে অধিনায়ক হিসেবে তিনি সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। অধিনায়ক শান্তকে আপনি কেমন দেখলেন?
মুশতাক: একজন অধিনায়কের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে ড্রেসিংরুমে সবার থেকে সম্মান আদায় করে নেয়া। আমার মনে হয় শান্ত সেটা করতে পেরেছে। সবাই ওকে সম্মান করে এবং তার কথা মেনে চলে। সিনিয়র যারা আছে তারা সবাই শান্তকে সাহায্য করতে মুখিয়ে থাকে। সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করে, ধীরে ধীরে সে সিদ্ধান্ত নিতে শিখছে। ঠিক নেক বা ভুল হোক। কিন্তু যখন আপনি জিততে থাকবেন তখন আপনি রান কম পেলেও সেটার প্রভাব পড়বে না। স্পিনারদের সে খুব ভালো ব্যবহার করতে জানে, এটা একটা বড় গুন। সে ধীরে ধীরে আরও অনেক উন্নতি। দলের সবার সঙ্গে সে বেশ ভালো মানিয়ে নিয়েছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশের বেশিরভাগ বড় জয়ের নায়ক সাকিব আল হাসান। অথচ এমন একটা সিরিজে তাকে খানিকটা নিশ্চুপই মনে হলো বোধহয়। সেটার পেছনে সাম্প্রতিক সময়ে তার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো প্রভাবে রেখেছে কিনা।
মুশতাক: আমার কাছে তো সেটা মনে হয়নি। আর এই সিরিজ জয়ের পেছনে সাকিবের অনেক অবদান আছে। ব্যাটিংয়ে সে হয়তো রান পায়নি কিন্তু বোলিংয়ে কার্যকরী ছিল। তাছাড়া সিনিয়র হিসেবে সে দলকে অনেক উজ্জীবিত রেখেছে। সবার সঙ্গে সে নিয়মিত কথা বলেছে এবং উপদেশ দিয়েছে। তাকে দেখে একবারও মনে হয়নি যে তার মাথায় অন্য কিছু চলছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: দ্বিতীয় টেস্টে লিটন দাস দারুণ একটা সেঞ্চুরি করলেন। উইকেটের পেছনেও পুরো সিরিজে নজর কেড়েছেন। তাকে কেমন দেখলেন?
মুশতাক: লিটনের যে ব্যাপারটা আমি খেয়াল করেছি সেটা হছে সে নিজেকে বুঝতে শুরু করেছে। হয়তো তার মানসিকতা এর মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। কিপিং, ব্যাটিং দুইটা জায়াগায় সে পরিষ্কার ছিল যে সে কি করতে চায়। তার ইনিংস গুলো দেখেন, প্রতিটা ইফেকটিফ ইনিংস। সে অনেক পরিশ্রম করেছে। আর আধুনিক ক্রিকেটের মতো নিজের মানসিকতা তৈরি করেছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: প্রথম টেস্টে পাকিস্তান ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান নিয়ে ইনিংস ঘোষণা করেছিল। আপনার কি মনে হয় শান মাসুদের সিদ্ধান্ত অনেকাংশে ভুল ছিল?
মুশতাক: আমার কাছে এমনটা মনে হয় না। বরং আমি বলবো শান মাসুদের ইনিংস ঘোষণাটা বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু আমরা উল্টো অনেক বেশি ভালো খেলে তাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিলাম। পাকিস্তান যে পরিস্থিতিতে ইনিংস ঘোষণা করেছিল তা ইতিবাচকই ছিল কারণ একদিন বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছিল। তবে আমরা জানতাম যে উইকেট ভালো এবং ভালোভাবে খেললে অবশ্যই পাকিস্তানের কাছাকাছি যেতে পারব কিংবা লিড নিতে পারব। আবার এটাও বিশ্বাস ছিল যে ওদেরকে দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা দ্রত অল আউট করতে পারব। এই বিশ্বাসটার কারণেই ছেলেরা ভালো খেলেছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পাকিস্তানে আমরা ব্যাটারদের সঙ্গে পেসারদের দাপট দেখলাম। ভারত সফরে হয়ত স্পিনারদের কাজটা বেশি থাকবে। স্পিনারদের কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো উচিত?
মুশতাক: আমরা অনেক আগে থেকেই দেখে এসেছি ভারতে স্পিনারদের জন্য বাড়তি সুবিধা থাকে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ সিরিজেও আলাদা কিছু হবে না। সে জন্য আপনাকে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। কিভাবে কি করলে দলের লাভ হবে সেটা আপনাকে ভাবতে হবে। কারণ ভারতের প্রত্যেকটা ব্যাটার বিশ্বমানের। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা এত সহজে হাল ছেড়ে দেয় না। এজন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটারের জন্য ভিন্ন রকম পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজটা অবশ্যই সহজ হবে না। তবে সঠিক পরিকল্পনায় এগোলে ছেলেরা যে কোন কিছু করে ফেলতে পারে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আমাদের স্পিনারদের নিয়ে আপনি কতখানি আত্মবিশ্বাসী?
মুশতাক: আমি সবসময়ই বলে এসেছি বিশ্বাসই সবকিছুর মূলে। যখন আপনি পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা ভারতের মতো দলের সঙ্গে খেলবেন তখন আপনার মধ্যে এই বিশ্বাসটা থাকতে হবে যে আমরা পারব। আমি যতটুুকু দেখেছি পাকিস্তান সিরিজে ছেলেদের মধ্যে এটা ছিল। এই বিশ্বাসটা আমাদের পরবর্তী সিরিজেও লাগবে। আমরা ভারতকে তাদের মাটিতে হারাতে পারি, আমাদের সেই বিশ্বাসটা থাকতে হবে। বিশ্বাসের সঙ্গে আবার আপনার উপকরণও লাগবে। ভারতে খেলা মানে আপনার স্পিনে বাড়তি শক্তি লাগবে। স্কোয়াডে তাইজুল, নাঈম হাসান আছে যারা পাকিস্তানে খেলেনি। পাকিস্তানের সুবজ উইকেটে মিরাজ সিরিজ সেরা হয়েছে। তাই ভারতকে টক্কর দেয়ার মতো আমাদের কাছে বেশ ভালোমানের স্পিন বিভাগ আছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের আত্মবিশ্বাস ভারত সফরে কতটা কাজে দেবে?
মুশতাক: পাকিস্তান সিরিজে ছেলেরা যে আত্মবিশ্বাস পেয়েছে তা ভারতের মাটিতে কাজে আসবেই। আপনি যখন শাহীন-নাসিমদের মতো বোলারদের সামাল দিয়ে খেলে আসবেন তখন বুমরাহ-সিরাজদের মতো বোলারদেরকেও আপনার সামলাতে সহজ হবে। আপনি অন্তত ঘাবড়ে যাবেন না বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবেন না। আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি বড় দলকে হারাতে পারবেন তাহলে সব সম্ভব। তবে আমরা এই একটা জিনিষই চেষ্টা করেছি ছেলেরা যেন নিজেদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা রাখে যে তারা সবাইকে সামলে নিতে পারবে। আমি আশা করছি পাকিস্তান সিরিজের মাধ্যমে ছেলেদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা এসেছে।