আমরা হেরেছিলাম, আমরাই জিতেছি

ছবি:

আমি তখন হাসপাতালে।
ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের সিরিয়ালে বসে আছি। ওয়েটিং রুম বোঝাই রুগী আর রুগীর অভিভাবকেরা। অনেকের ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে। কিন্তু তারাও বসে আছেন। বিভিন্ন রুম থেকে ডাক্তারদের সহকারীরা বের হয়ে এসেছে। হাসপাতালের বেড থেকে দু এক জন রুগীও উঠে এসেছেন।
সবার চোখ দেয়ালে ঝুলতে থাকা টেলিভিশনে। ১২ বলে আর চাই ১৬ রান। সাব্বির একটা বল ডট দিলেন। ফোস করে একটা শব্দ শোনা গেলো ওয়েটিং রুম জুড়ে। পরের বলে সাব্বির রান আউট। চাপা একটা ‘আহ’ শব্দ। দুই বল পরে মুশফিক একটা ছক্কা মারলেন। এসির শো শো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যেই দু একজন কপাল থেকে ঘাম মুছছেন।
শেষ ওভার; ৯ রান দরকার। প্রথম বলে ২ রান নেওয়ার পরই চার মেরে দিলেন মুশফিক। হাসপাতালের নিয়ম-জোরে শব্দ করা যাবে না। একটা গোঙ্গানির মতো উল্লাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ৩ বলে ১ রান দরকার। সবাই উঠে দাড়িয়েছেন। ডাক্তারের চেম্বারের দরজা খুলে গেলো। পরের রুগীকে ডাকা হচ্ছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। মুশফিক একটা রান নিলেন।
আর কোনো বাঁধ মানলো না আওয়াজ, আর কোনো নিয়মে বাঁধা গেলো না জগতটাকে। করতালি আর উল্লাসে মেতে উঠলো হাসপাতাল। হাসিতে ভরে গেলো একটু আগেও কাতরাতে থাকা অসুস্থ মানুষটার মুখ। হাসপাতালের মতো নিরস জায়গা হয়ে উঠলো উৎসবের অঙ্গন।
গতকাল রাতে এই চিত্র কেবল আমার দেখা হাসপাতালে নয়, সারা দেশেই ছিলো। সারা দেশেরই উল্লাসের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো। শ্রীলঙ্কার প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হতে গোনা কয়েক জন বাংলাদেশী সমর্থকের চিৎকার সাগর পার করে যেনো এই দেশে এসে হাজির হয়ে পড়েছিলো।

কিন্তু কেনো এতো উল্লাস? কেনো এই বাঁধ ভাঙা উৎসব? কেনো এতো উচ্ছাস? এ তো বিশ্বকাপের ফাইনাল নয়। এমনকি বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল বা বড় ম্যাচও নয়। প্রতিপক্ষও এমন কিছু অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা নয়; ক্রান্তিকাল পার হতে থাকা ‘দুর্বল’ শ্রীলঙ্কা। তাহলে আমরা কেনো এতো উল্লাস করছি?
কারণ, এই জয়টা আমাদের একটা ছোট্ট কিন্তু ভারী খারাপ সময় কাটিয়ে দেওয়া জয়। আমরা যেনো ক্রিকেট খেলাটাই ভুলে গিয়েছিলাম। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিলো এই বাজে সময়টা।
তারপর থেকে আমাদের কিছুই আর ঠিকঠাক হচ্ছিলো না। বল জায়গাতে পড়ছিলো না, ব্যাটে-বলে সম্পর্কটা হচ্ছিলো না, হাতে ক্যাচ জমছিলো না; কিছুই হচ্ছিলো না। এটাকে বলে ‘ব্যাড প্যাচ’। সময়টা সবদিক থেকে খারাপ যাচ্ছিলো।
মাশরাফিকে অবসরে পাঠানো হয়েছে টি-টোয়েন্টি থেকে। ভুল বুঝে ফেরানোর সব অনুরোধ বিফলে গেলো। সাকিব ইনজুরিতে মাঠের বাইরে। কোচ পাওয়া যাচ্ছিলো না। হাথুরুসিংহেকে নিয়ে ‘আফসোস’ বাড়ছিলো। এই সময়ে আমাদের এমন একটা ম্যাচ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরী ছিলো।
ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, সিনিয়র ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল বারবার বলছিলেন, এমন একটা ম্যাচ এলেই সব বদলে যাবে। মনে হবে, সব ঠিক হয়ে গেছে। সেই ম্যাচটার অপেক্ষায় অনেকে ক্লান্তও হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে সেই ম্যাচ এলো।
তাও কী ফ্যাশনের সাথে এলো! যে বাংলাদেশ আগে কখনো টি-টোয়েন্টিতে দুই শ রান করেনি, তারা কি না ২১৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জিতলো। এর চেয়ে ভালোভাবে খারাপ সময়টাকে দূর করা যেতো না।
এবার একটু বাস্তবতায় ফিরি। এই ম্যাচে জয় মানে এই নয় যে, এখন থেকে বাংলাদেশ প্রতি ম্যাচেই জিততে থাকবে। এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ আর হারবে না। ক্রিকেট খেললে হার-জিত দুটোই পালাক্রমে আসতে থাকবে।
এই ম্যাচ আমাদের কেবল নিশ্চয়তা দিলো যে, ক্রিকেটাররা লড়াই করার আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেয়ে গেছে। এখন তারা হারলেও লড়ে হারবে। আবারও বলি, এই সময়ে পাশে থাকতে হবে। ক্রান্তিকাল শেষ হয়ে যায়নি। এখন অনেক সমস্যা আছে। সবকিছু খোলামেলা না বলাই ভালো।
এখনও অনেক প্রতিকূলতা আছে। এর মধ্যেই লড়বে আমাদের ক্রিকেটাররা। কোনোদিন ৩ বলে ১ রান আসবে, কোনো দিন আসবে না। যেদিন আসবে, সেদিন তো সবাই থাকবে পাশে। যেদিন রানটা আসবে না, সেদিন যেনো আমরা মুখ ফিরিয়ে না নেই। সেদিনও যেনো এটুকু বলতে পারি যে, আমরা হেরে গেছি; ওরা একারা নয়।