আফগান জুজু গিলে নিয়েছে বাংলাদেশকে

ছবি: ছবিঃ বিসিবি, রতন গোমেজ

|| সিনিয়র ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট ||
ভারত প্রতিপক্ষ হওয়া মানেই মানসিক বাধা! মাঠে নেমে লড়াই করার আগেই হেরে বসে থাকে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানও যেন বাংলাদেশের জন্য মানসিক ‘বাধাযুক্ত’ এক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। টেস্ট কিংবা টি-টোয়েন্টি, আফগানিস্তান সামনে পড়লেই দিশা হারিয়ে ফেলছে বাংলাদেশ। আফগান জুজু যেন রীতিমতো গিলে নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে।
আফগান ছোবলে তাই বাংলাদেশর ক্রিকেটই ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার দশা! প্রথম ওলট-পালটটা ব্যাটিং অর্ডারে। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমে এক নবিকে সামলাতে গিয়ে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে তামাশায় মেতে উঠেছিল সাকিব আল হাসানের দল। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানেরই সুযোগ হয়নি নিয়মিত জায়গায় ব্যাটিং করার।
টি-টোয়েন্টিতেও একই দৃশ্য। আফগান স্পিনারদের সামলাতে ওপেনার হয়ে উঠলেন মুশফিকুর রহিম। ব্যাটিং অর্ডারে উপরে উঠে এলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার নেমে গেলেন নিচে। কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টের মতো এখানেও রক্ষা হলো না। ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২৫ রানের হার নিয়ে মাঠ ছাড়ল ঘরের মাঠে ‘পরাক্রমশালী’ দলের খেতাব জেতা বাংলাদেশ।
বরিবার মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টসে হেরে প্রথমে ফিল্ডিং করতে নেমে উড়ন্ত সূচনাই করেছিল বাংলাদেশ। ১০ রানের মধ্যেই আফগানিস্তানের তিন উইকেট তুলে নেন সাইফউদ্দিন ও সাকিব। কিন্তু মোহাম্মদ নবির ব্যাটিং ঝড়ে আফগানরা ঠিকই ১৬৫ রানের লড়াকু সংগ্রহ পেয়ে যায়। জবাবে শুরু থেকেই উল্টো পথে হাঁটা বাংলাদেশ ১৯.৫ ওভারে ১৩৯ রানে অলআউট হয়ে যায়। বাংলাদেশের ইনিংসজুড়ে থাকল মাত্র একটি ছক্কা। সেটাও এলো ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে নামা পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের ব্যাট থেকে।

ওয়ানডেতে যেমন যেমন, টি-টোয়েন্টি এলেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেই হারায় বাংলাদেশ। ২০ ওভারের এই ফরম্যাটে রশিদ-নবিদের বিপক্ষে প্রথম সাক্ষাতটাই কেবল সুখস্মৃতি হয়ে আছে বাংলাদেশের। বাকি সব ম্যাচে আফগানদের জয়জয়কার। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের চারটিতেই জয় পেয়েছে আফগানরা।
১৬৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতেই চমক দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ উদ্বোধন করতে পাঠিয়ে দেয়া হয় মুশফিকুর রহিমকে। যদিও এটা প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে নয়, তাদের স্পিন আক্রমণ সামলাতে মুশফিকের ওপর ভরসা রাখে বাংলাদেশ। এই পরিকল্পনা কাজে আসেনি। আফগানিস্তানের অফ স্পিনার মুজিব উর রহমান একাই বাংলাদেশের ইনিংস লণ্ডভণ্ড করে দেন।
কোনো রান যোগ না করতেই আকাশে বল তুলে বিদায় নেন লিটন দাস। ভরসার প্রতীক হয়ে উইকেট যাওয়া মুশফিকও একটু পরই সাজঘরে ফেরেন। অধিনায়ক সাকিব সামাল দেয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। ১৫ রান করে থেমেছেন তিনি। বাংলাদেশের এই তিন ব্যাটসম্যানের দুজনকেই সাজঘরের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন মুজিব। দলীয় ৩২ রানে সৌম্য সরকারকেও শিকারে পরিণত করেন আফগান এই স্পিনার।
৩২ রানেই নেই চার উইকেট, এমন অবস্থায় পঞ্চম উইকেটে জুটি বেঁধে লড়াইয়ের চেষ্টা শুরু করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাব্বির রহমান। কিছুটা সফলও হয়েছেন এ দুজন। দলের দুঃসময়ে ৫৮ রানের জুটি গড়েন এই দুই ব্যাটসম্যান। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ ৪৪ রান করে ফিরে যেতেই আবারও শুরু হয় উইকেট বৃষ্টি। সাব্বিরের ২৪, আগের ম্যাচের নায়ক আফিফ হোসেনের ১৫ এবং মুস্তাফিজের ১৫ রান কেবল হারের ব্যবধান কমিয়েছে। মুজিব ৪টি এবং রশিদ খান, ফরিদ মালিক ও গুলবাদিন নাইব ২টি করে উইকেট নেন।
এরআগে বল হাতে শুরুটা ভালোই ছিল বাংলাদেশের। এমন উড়ন্ত শুরু অনেকদিন দেখেনি বাংলাদেশ। ইনিংসের প্রথম বলেই সাইফউদ্দিনের জাদুকরী ডেলিভারি। তাতে উপড়ে যায় আফগান ওপেনার রহমতউল্লাহ গুরবাজের অফ স্টাম্প। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে আসা অনেকেই হয়তো দারুণ এই দৃশ্যটি মিস করেছেন। কারণ তখনও অনেকে সিট খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন।
ইনিংসের প্রথম বলেই প্রতিপক্ষের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দেয়ার উচ্ছ্বাস দ্বিতীয় ওভারে দ্বিগুন করে তোলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। মারকাটারি ফরম্যাটের ম্যাচ হলেও সাকিব হয়ে ওঠেন চরম কৃপণ। নিজের করা প্রথম ওভার থেকে আফগান ব্যাটসম্যানদের কোনো রানই নিতে দেননি তিনি। সঙ্গে তুলে নেন মারুকুটে হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের উইকেট।
১০ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তান তখন মাঝ দরিয়ায়। এমন সময় আবারও ঘাতকের ভূমিকায় হাজির আফগানিস্তানকে বেশ জ্বালা দেয়া সাইফউদ্দিন। ৩৩ রানে ৪ উইকেট নেয়া বাংলাদেশের তরুণ এই পেসারের এবারের শিকার নাজিব তারাকাই। দিক হারিয়ে বসা দলকে পথ চেনানোর দায়িত্ব চাপে আজগর আফগান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ঝড় তোলা নাজিবউল্লাহ জাদরানের কাঁধে।
যদিও এই জুটিকে থিতু হতে দেননি সাকিব। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আগেই নাজিবউল্লাহকে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। অবশ্য ৪০ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে ছন্দে ফেরাতে সময় নেননি আজগর আফগান ও মোহাম্মদ নবি। পঞ্চম উইকেটে ৭৯ রানের জুটি গড়ে দলকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান এ দুজন। এই জুটি গড়ার পথে ক্রমেই মারকুটে হয়ে উঠতে থাকেন আজগর-নবি।
বিশেষ করে মোহাম্মদ নবি ছিলেন অগ্নিমূর্তিতে। ৩৭ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪০ রান করে আজগর ফেরার পর বাংলাদেশের বোলারদের একাই তাড়িয়ে ফিরেছেন নবি। শেষ পর্যন্তও তাঁর সামনে বাধার দেয়াল তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। মূলত নবির ব্যাটেই ১৬৫ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় আফগানরা। অসাধারণ ব্যাটিং করে ৫৪ বলে ৩টি চার ও ৭টি ছক্কায় ৮৪ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন অভিজ্ঞ এই আফগান অলরাউন্ডার। টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করা সাইফউদ্দিন ৪টি ও সাকিব ২টি উইকেট নেন।