তামিম ইকবালের বীরত্ব ও আমাদের শিক্ষা

ছবি: ছবি - সংগৃহীত

|| দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ||
ক দিন আগে এক সাক্ষাতকারে বার্সেলোনার তারকা ইভান রাকিটিচ বলেছেন, দলের জন্য দরকার হলে মাঠে একটা হাড় ভেঙে রেখে আসতে রাজী আছেন তিনি। এমন কথা অনেকেই বলেন। দলের জন্য রক্ত দেওয়ার কথা আমরা কম শুনিনি। কিন্তু করতে পারেন কয় জন?
হ্যা, ম্যালকম মার্শাল পেরেছিলেন। পেরেছিলেন গ্রায়েম স্মিথ বা অনিল কুম্বলেও। আর পারলেন আমাদের তামিম ইকবাল।
মুস্তাফিজুর রহমান নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার সাথে সাথে শ্রীলঙ্কা দলের খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। মুশফিকুর রহিমও হতাশায় ভেঙে পড়বেন বলে মনে হচ্ছিলো। তখনই সকলের চোখকে বিষ্ফারিত করে দিয়ে, শরীরে শিহরন তুলে এক হাতে ব্যাট দুলিয়ে মাঠে নেমে এলেন তামিম ইকবাল!
এসে প্রথম বলটাই খেলতে হলো তাকে। এর পরের দৃশ্যটা তো এখন ভূবন বিখ্যাত হয়ে গেছে। ভাঙা হাতটা শরীরের পেছনে রেখে আরেক হাত দিয়ে সামলালেন বুক বরাবর ছুটে আসা বাউন্সটা। দ্বিতীয় দফা ব্যাট করতে নেমে ওই একটা বলই সামলালেন। আর তাতেই বাংলাদেশের এক অনন্য ইতিহাস গড়ে ফেললেন বাহাতি এই ওপেনার। সারা বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে তামিম দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের জন্য ক্রিকেটটা কেবল খেলা নয়; এটা যেনো জীবনের চেয়ে বেশী কিছু।
ম্যাচ শেষে মুশফিকুর রহিম বলছিলেন, ‘আমি বিষ্মিত হয়েছি। খুব বিষ্মিত হয়েছি তামিমকে ওই অবস্থায় মাঠে নেমে আসতে।’
বিষ্মিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
দিনের প্রথম ওভারেই মরুর উইকেটে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন লাসিথ মালিঙ্গা। এক ওভারে নেই বাংলাদেশের দুই উইকেট। এরপর হাতে বলের আঘাত পেয়ে অসহ্য যন্ত্রনা দাতে চেপে মাঠ ছাড়লেন তামিম ইকবাল। মাঠ থেকে বেরিয়ে সরাসরি হাসপাতালে যেতে হলো। সেখানে পরীক্ষায় ধরা পড়লো হাতের কবজিতে তার একাধিক চিড় ধরা পড়েছে। এ অবস্থায় খেলা তো দূরে থাক সপ্তাহ ছয়েকের মধ্যে হাত নাড়ানোও যাবে না।

এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে খবর চলে এলো, তামিম ইকবালের এশিয়া কাপ শেষ। সেভাবেই সবাই মানসিক প্রস্তুতি নিলেন। এমনকি বিসিবি থেকেও নিশ্চিত করা হলো, তামিম আর এই এশিয়া কাপ খেলতে পারছেন না।
ড্রেসিংরুমে এসে মুখ কালো করে বসে রইলেন তামিম। হাতটা তার ব্যান্ডেজে মোড়ানো আর গলা থেকে সিলিং দিয়ে ঝোলানো। বারবার তাকে ক্যামেরায় ধরা হচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে তামিমের অসহায় মুখটা। একটার পর একটা উইকেট পড়ছে।
অষ্টম উইকেট পড়ার পরই উঠে দাড়ালেন তামিম। মাশরাফির কাছে গিয়ে বললেন, তিনি খেলতে নামতে চান। একটা বলও সামাল দিয়ে যদি মুশফিককে সহায়তা করা যায়, তাই করতে চান।
সবাই আলোচনা করে রাজী হলেন। কিন্তু তামিমের হাত যে গ্লাভসের ভেতর ঢোকানো যাবে না। ব্যান্ডেজ করা হাত কিভাবে ঢুকবে গ্লাভসে? মাশরাফি এসে নিজে হাতে কেটে গ্লাভসের সামনের অংশটা ফাঁক করে দিলেন। কোনোক্রমে হাতে গলানো হলো গ্লাভসটা। এবার একজন গ্লাডিয়েটরের মতো করে হাতে ব্যাট নামের তরবারি নিয়ে মাঠে নামলেন তামিম।
দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে রচিত হলো নতুন একটা বীরত্বের কাব্য।
তামিম ইকবালের এই মহাকাব্যিক সাহসিকতা পুরো বাংলাদেশকে আবেগাপ্লুত করেছে। সারা পৃথিবীতে সারা ফেলে দিয়েছে। টুইটার ফেসবুকে, একবার পর একটা স্যালুট জানানো বার্তার দেখা মিলছে। তবে এই সাহসিকতাকে শুধু বন্দনা করে বসে থাকলে চলবে না। এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
আমাদের যারা তরুন ব্যাটসম্যান, তাদের সামনে সুযোগ তামিমের এই নিবেদনের কাছ থেকে তারা কিছু শিখতে পারেন।
শুধু তামিম কেনো; এই ম্যাচ চোট নিয়ে খেলেছেন মুশফিকুর রহিমও। তার পাজড়ের হাড়ে ব্যাথাটা আবার দু দিন হলো খুব বেশী। গতকাল ব্যাটিং করেছেন সেই ব্যাথা নিয়ে। একটা করে শট করেছেন এবং বুকে হাত দিয়ে ব্যাথাটা সামাল দিয়েছেন।
ব্যাথা নিয়ে খেলছেন সাকিব আল হাসানও। তার এখন অস্ত্রপচার করানোর কথা ছিলো। তিনি দলের স্বার্থে সেটা না করিয়ে এখন খেলছেন। মাশরাফির কথা আর নাই বলি। দুই পায়ে এক ডজন অস্ত্রপচার নিয়েও তিনি দলের সেরা ফাস্ট বোলার হয়ে লড়ছেন।
আজকের তরুন ক্রিকেটারদের বলি, এই তামিম, এই মুশফিক, এই মাশরাফি, এই সাকিব; এরাই বাংলাদেশ।
আজকের তরুনদের নিয়ে অভিযোগ, তারা সুস্থ থাকার পরও বাড়তি অনুশীলন করতে চান না। তারা নাকি সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একবার এই সিনিয়রদের দিকে ফিরে দেখুন। নিজের শরীরটাকে বাজিতে রেখে কিভাবে দেশের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন এই মানুষগুলো।
আপনাদের উদাহরণের জন্য তো বাইরে তাকাতে হবে না। নিজের দলেই এরকম সব আদর্শ রয়েছেন। একবার তাদের দিকে ফিরে তাকান এবং বলুন যে, আমরাও পারবো।
আপনারা সবাই হয়ে উঠুন একজন করে তামিম ইকবাল।