যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...

ছবি:

২০১৪ সাল পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই ভুলে যাওয়ার মত ছিল। ঘরের মাঠে বার বার জেতা ম্যাচ হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপের মত আসরেও ব্যর্থ ছিল মুশফিকের বাংলাদেশ।
সেই বছরের মাঝামাঝি সময়ে চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে কোচ হিসেবে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন। নতুন কোচ, নতুন ভাবনা আর দলের বাজে ফর্ম... সব মিলিয়ে আব্দুর রাজ্জাককে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকেই বাদ দেয়া হয়।
সেই সময়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি। তবে ওভার প্রতি অতিরিক্ত রান খরচা করছিলেন বেশ কয়েকটি সিরিজে। আর টেস্টে রাজ্জাকের রেকর্ড কখনই খুব একটা উজ্জ্বল ছিল না।
২০০৬ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর দলে নিয়মিত ছিলেন না কখনই। ১২ টেস্ট খেলে মাত্র ২৩ উইকেট মালিক ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে রাজ্জাকের দল থেকে বাদ পড়ায় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সুযোগ মিলে আরেক বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানির।
একই বছর টেস্ট দলে জায়গা পাকা হয় তাইজুল ইসলামের। অ্যাকশান জটিলতায় দুই বছরের মাথায় সানির ক্যারিয়ার থমকে যায়। একই সময় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের বোলিং আক্রমণে আমুল পরিবর্তন আসে।
মুস্তাফিজ, তাসকিনদের মত তরুন ফাস্ট বোলাররা ওয়ানডে সেট আপের অপরিহার্য অংশ বনে যান। আর মাশরাফি ও রুবেল তো আগে থেকেই ছিল। এক-দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দল স্পিন হেভি দল থেকে এশিয়ার অন্যতম সেরা পেস অ্যাটাকে পরিনত হয়।

টেস্টে অবশ্য ওয়ানডের মত রেভেলুশন হয়নি। বাংলাদেশ দল এখনো টেস্ট জিততে হলে স্পিনের সাহায্য নেয়। ২০১৪-১৫ মৌসুমের দিকে টেস্টের অন্যতম সদস্য বনে যান তাইজুল। এর মাঝে লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখনকেও সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
ব্যাপক প্রত্যাশা জাগালেও ফিটনেস ও ডিসিপ্লিন ইস্যুতে হারিয়ে যান লিখন। এক মৌসুম বাদেই দলে সুযোগ মিলে সদ্য অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ থেকে আসা মেহেদি হাসান মিরাজের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে একজন অফ স্পিনার দরকার ছিল।
ইংলিশ টপ অর্ডারে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের আধিক্য বেশি, তাই প্রয়োজনের তাগিদে মিরাজকে টেস্ট ক্যাপ তুলে দিয়ে জুয়া খেলে নির্বাচকরা। জুয়ায় জিতে যান নির্বাচকরা, ইংলিশদের বিপক্ষে দুই টেস্টে ১৯ উইকেট নিয়ে টেস্ট দলের ফ্রন্ট লাইন স্পিনারের জায়গা দখন করেন সদ্য ঊনিশ পার করা মিরাজ।
এর পর সাকিব-তাইজুল ও মিরাজের স্পিন বিষেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। একই সময়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কখনো বাড়তি স্পিনারের প্রয়োজন বোধ করলে কখনো মিরাজ, সানজামুল আবার কখনো মোশাররফকে সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু একবারও অভিজ্ঞ আব্দুর রাজ্জাককে স্মরণ করেনি হাথুরুসিংহে ও নির্বাচকরা। ২০১৪ সালে দল থেকে বাদ পড়া আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য বসে থাকেননি। তিনি সেটাই করেছেন যা প্রতিটি ক্রিকেটারের করা উচিত।
ঘরোয়া ক্রিকেটে গিয়ে ব্যাগ ভরে ভরে উইকেট নিয়েছেন তিনি, সাদা ও লাল বলে সমান তালে। গত তিন মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের সব পুরনো রেকর্ড নিজে করে নিয়েছেন তিনি।
প্রথমে চারশ উইকেট... এরপর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পাঁচশ উইকেটের মালিক হন এই ৩৫ বছর বয়সী রাজ্জাক। কিন্তু কে শুনে রাজ্জাকের ডাক। দলে সাকিব, তাইজুল ও মিরাজ আছে না! রাজ্জাকের কি দরকার আমাদের?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরকার পড়লো 'অভিজ্ঞ' রাজ্জাকের। আঙ্গুলের ইনজুরি আরেক অভিজ্ঞ সাকিবকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে ছিটকে ফেলে।এখন অভিজ্ঞতা তো মুদি দোকানে পাওয়া দায়। তাই চার বছর পর রাজ্জাকের দুয়ারে গেল নির্বাচকরা।
চিটাগং টেস্টে রাজ্জাক সহ আরও পাঁচ স্পিনারের বহর নিয়ে স্কোয়াড সাজালো বাংলাদেশ। কিন্তু চিটাগংয়ের ফ্ল্যাট উইকেটে রাজ্জাক নয়, খেলল সানজামুল। অভিষেক টেস্টে রান বন্যা বইয়ে দিয়ে ঠিক পরের টেস্টের দল থেকে বাদ দেয়া হল সানজামুলকে।
শেষ পর্যন্ত ঢাকা টেস্টে সেরা একাদশে জায়গা পেলেন রাজ্জাক। প্রথম বল থেকে স্পিন করছে, এমন উইকেটে বল হাতে এক একটা গোলা ছুঁড়লেন রাজ্জাক। যেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন তিনি, সেই একই প্রতিপক্ষের এক একটি উইকেট নিয়ে সতীর্থদের সাথে উল্লাস করেছেন সেই পুরনো স্টাইলে।
ঢাকা টেস্টের নাটাই বাংলাদেশের হাতছাড়া না হোক, টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং করে সেটাই নিশ্চিত করেছেন তিনি। রাজ্জাক ফিরেছেন, এসেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় যোগ করলেন। তরুন ক্রিকেটারদের জন্য হাল না ছাড়ায় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেন। ওয়েলকাম ব্যাক আব্দুর রাজ্জাক।