|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সাফল্য পাল্লাটা এখনও এত বেশি ভারী হয়ে উঠতে পারেনি। জাতীয় দলের হয়ে ছেলেদের সবচেয়ে বড় সাফল্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনাল। যুবাদের অবশ্য আছে বিশ্বজয়ের গল্প। ২০২০ সালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশের যুবারা। কদিন আগে তরুণদের হাত ধরে এসেছে যুব এশিয়া কাপও। তবে বাংলাদেশের প্রথম বড় সাফল্যটা এসেছিল মেয়েদের হাত ধরে।
২০১৮ সালে ভারতকে এশিয়া কাপ জিতে নারী ক্রিকেটাররা প্রমাণ করেছিলেন, বড় মঞ্চে তারাও আলো ছড়াতে পারেন। সেই সময়ের পর থেকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশে মেয়েদের ক্রিকেট। এবারের বছরটা বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের জাগরণের বছর বলা যেতে পারে। ঘরের মাঠে ভারতের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি জয়, ওয়ানডে সিরিজ ড্র। এ ছাড়া পাকিস্তানের হারিয়েছে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জেতা বাংলাদেশ কদিন আগে দেশে ফিরেছে সাউথ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি জিতে। দেশে ফিরে ক্রিকফ্রেঞ্জির প্রতিনিধি আবিদ মোহাম্মদ’কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নিগার সুলতানা জ্যোতি। যেখানে কথা বলেছেন নিজের অধিনায়কত্ব, বাংলাদেশের সাফল্য, মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি মিডিয়ার অনাগ্রহসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে। দুই পর্বের প্রতিবেদনে আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: মেয়েদের ক্রিকেটে নিয়মিত সাফল্য আসতে শুরু করেছে। আরও ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পেতে আর কোন কোন জায়গাগুলোতে বিসিবির নজর দেয়া উচিত বলে মনে হয়...
নিগার সুলতানা: প্রথমত, আপনাকে ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোতে নজর দিতে হবে। এখানে কাঠামো যত শক্তিশালী হবে ততই ভালো। কারণ আপনার পাইপলাইনে যখন ভালো খেলোয়াড় বেশি থাকবে তখন প্রতিযোগিতা বাড়বে। খেলোয়াড়দের মাঝে ভালো করার আগ্রহটাও বেশি থাকবে। এটা কেন বলছি জানেন? আমার দেখেছি যে আমারও এখন বিকল্প আছে কিংবা তৈরি হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ভালো একটা দিক। কারণ আমি যদি খেলতে না পারি তাহলে আমার যেন বিকল্প থাকে। এটা আমি মন থেকেই চাই।
আপনি যদি এমনটা তৈরি করতে চান তাহলে ঘরোয়াতে আপনাকে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলতে হবে। এখন অনেক নতুন নতুন খেলোয়াড় উঠে আসছে। সব থেকে বড় কথা ক্রিকেট বোর্ড অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ এবং ইমার্জিং দল নিয়ে অনেক বেশি কাজ করছে। এটা কিন্তু উন্নতির বড় একটা সাইন। তবুও আরও বেশি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হবে। ফরম্যাট অনুযায়ী যদি আমাদের কাজ করতে হয় তাহলে টি-টোয়েন্টি অনেক বড় জায়গা। ওয়ানডে নিয়ে আমরা হয়ত আত্মবিশ্বাসী থাকি কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে ঘাবড়ে যাই। এই ফরম্যাটে আমরা একটু না বেশ দূর্বল। আমরা ঘরোয়াতে কিন্তু কোনো টি-টোয়েন্টি লিগ খেলি না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: তাহলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বিপিএলের মতো এমন একটা টুর্নামেন্ট করতে পারলে ভালো হতো কিনা
নিগার সুলতানা: এটা (লিগ আয়োজন) নিয়ে তো কথা হচ্ছে। আপনারাও জানেন, আমরাও বলেছি। বিসিবিও এই ব্যাপারে ইতিবাচক কিন্তু কতখানি বাস্তবায়ন হবে সেটা আমি জানি না। কিছুদিন আগে যখন স্যারের (বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন) সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন আমরা এই কথাটা উঠিয়েছিলাম। উনি নিজে থেকেই এসে বলেছেন জ্যোতি কয়টা দল করতে পারবা তুমি? কয়টা দল হলে ভালো হয়, এসব উনি নিজে থেকে আগ্রহ নিয়ে বলছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘দেখুন, স্যার আমরা যেহেতু প্রথম কিংবা নতুন তাতে ৩-৪টা দল করতে পারলে ভালো হয়। অন্ততপক্ষে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ দল যেন হয়।
এখানে আসলে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের। তারা যদি আমাদের দলগুলো কিনতে চায় তাহলে এটা ভালো হবে। কারণ বিপিএল যখন হবে তখন মেয়েরা বছরে একটা লিগ পেলো। তারপর বিদেশি ক্রিকেটাররা যখন বাংলাদেশে খেলতে আসবে তখন আমাদেরও ওদের দেশে খেলার দরজা খুুলে যাবে। এটা অনেক বেশি সুযোগ তৈরি করবে। অবশ্যই, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা আমরা যত বেশি খেলবো তত বেশি উন্নতি করতে পারবো। বিশ্বকাপের আগে যদি এটা হয় তাহলে তো বলবো আরও বেশি কাজে দেবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: প্রথমবার সাউথ আফ্রিকায় ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি জিতে ফিরলেন। দেশে আসার আগে নিশ্চই বিমানবন্দরে মিডিয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন। সেভাবে সাড়া না পাওয়ায় মন খারাপ হয়েছে নিশ্চই?
নিগার সুলতানা: না, মন খারাপ হয়নি। আমি আসলে আশাই করিনি যে তারা (মিডিয়া) কেউ আসবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এমন ভাবনার কারণ কী?
নিগার সুলতানা: দেখুন, আপনি নারী ক্রিকেট নিয়ে কাজ করবেন কি করবেন না সেটা আপনি জানেন। আমরা এই ব্যাপারটা জানি যে এটা ব্যবসা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। আমাদের মেয়েদের ক্রিকেটে গণমাধ্যমের ব্যবসা হয় না। যে কারণে তারা খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না। ব্যাপারটা আপনিও বুঝেন যাদের নিয়ে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হয় তাদের নিয়ে সবাই মাতামাতি করে। আমাদের এখানে হয়ত তারা খুব বেশি লাভবান হোন না তাই আসেন না। এটা নিয়ে আমাদের কোনো আফসোস নেই।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বলছেন আফসোস নেই, তারপরও তো কখনও কখনও নিশ্চয় মনে হয় প্রচারণা পেলে ভালো হতো...
নিগার সুলতানা: প্রচারণা তো সবাই পেতে চায়। মিডিয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তারা যখন একটা দলকে বেশি বেশি মানুষের সামনে তুলে ধরে তখন স্পন্সররা আসে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তখন মানুষ দেখে, জানে তাতে খেলোয়াড়রা লাভবান হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের হয় না। আমাদের বাংলাদেশ দলে কে কে খেলতেছে অনেকে জানেই না। ব্যাপারগুলো আসলে ওইভাবে প্রচারই হয় না। এটা তো আমাদের দোষ না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: প্রচার না হওয়ার জন্য বিসিবিরও দায় দেখছেন কিনা...
নিগার সুলতানা: বিসিবি আসলে এখানে কি করতে পারে বলুন। তাদের যেটুকু করার সেটুকু তো তারা করতেছে। বিসিবি ছাড়া কে আমাদের দেখভাল করছে। বিসিবি অনেকভাবেই বলে কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখায় না। বিসিবি স্পন্সরের কাছে গেলে বলে মেয়েদের ক্রিকেটে মিডিয়ার তেমন আগ্রহ নেই। তাহলে কেন স্পন্সর আসবে? দেখুন, ভারত সিরিজে অনেক স্পন্সর ছিল, পাকিস্তান সিরিজেও ছিল। আমার কথা হচ্ছে আপনার যখন প্রয়োজন আপনি তখন এলেন তাহলে তো হবে না। বাকি সময়েও তো আমাদের সমর্থন করতে হবে।
এখন সবার ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে বেশি আগ্রহ। কী জন্য? কারণ সবাই তাদের নিয়ে কথা বলে, আলোচনা করে। একটা মিডিয়া আমাদের নিয়ে কথা বলুক দেখেন আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে কিনা। সবকিছু নির্ভর করছে আপনি জিনিসটাকে কিভাবে দেখতেছেন। এখন আমরা খেলোয়াড়রা তো এটা নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। আমরা অনেক আগেই জেনে গেছি এটা আমাদের চিন্তার বিষয় না। খারাপ লাগার সময়টা পেছনে ফেলে এসেছি। যখন ছোট ছিলাম তখন খারাপ লাগতো।
যখন ক্রিকেট শুরু করেছি তখন মন খারাপ হতো যে আমরা খেলতেছি কিন্তু আমাদের কেউ চেনে না, জানে না, মিডিয়াও আমাদের নিয়ে আলোচনা করে না। যখন দলে ঢুকলাম তখন এমন লাগতো। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তো আমরাও খেলি তাহলে আমাদের সাথে কেন এমন হয়। একটা সময় এসে যখন বুঝতে শুরু করলাম তখন বুঝলাম যে এটা আসলে আমাদের চিন্তার বিষয় না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: মিডিয়ার আলোচনা না থাকায় খানিকটা মন খুলে খেলতে পেরেছেন। এমনটা কী?
নিগার সুলতানা: অবশ্যই, দলের সবাইকে আমি সবসময় বলি দেখো যখন মিডিয়া আসবে তখন তোমাদের চাপ ফিল করবা। মনে হবে চাপে পড়ে যাচ্ছি। এটা এক দিক থেকে ভালো যে মিডিয়ার কোনো চাপ নেই। কারণ আমি যখন ভালো খেলবো না তখন আমার ওপর বেশি চাপ আসবে যে কেন ভালো খেলছি না। এটা করেছে-ওইটা করেছে এসবের কোন চাপ নেই। আমি তো নিউজ দেখি, নিউজ পড়ি। আমি তো দেখি ছেলেদের সঙ্গে কি হয়।
আমাদের ছেলে ক্রিকেটারদের তো ফেসবুক, ইউটিউবে মানসিকভাবে অত্যাচার করা হয়। এটা অনেক সময় একজন খেলোয়াড় নিতে পারে আবার নিতে পারে না। মেয়েরা তো এমনিতেই মানসিকভাবে এত শক্ত না। সেই সময় এসব চাপ নিতে পারলো না। তখন আরেক সমস্যা। এখন ফ্রি খেলতেছি, চাপ নেই। এক দিক থেকে চিন্তা করলে এটা ভালো হতো। এটা মজার ছলেই বলছি। এমন না যে আমরা চাই না মিডিয়া কাভার করুক।
অবশ্যই, মিডিয়া কাভার করুক। এখন কেউ না চাইলে তো আপনি তাকে জোর করতে পারবেন না। আপনার হয়ত আগ্রহ আছে তাই কষ্ট করে বিমানবন্দরে আপনি এসেছেন। অন্য আরেকটা চ্যানেলও ছিল। বাকিদের হয়ত আগ্রহ ছিল না। আমরা তো চাইলেও তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারবো না। আমরা যেটা পারবো সেটা হচ্ছে ভালো ক্রিকেট খেলা। আমরা চেষ্টা করছি ভালো খেলার যেন এসব জিনিসগুলো সবার সামনে আসে। আমার কাছে আজকে আমাদের সাফল্য হচ্ছে সাউথ আফ্রিকা থেকে আসার পরে আপনারা দুজন এসেছেন। পরের সফরে দেখা যাবে চারজন আসবে। আস্তে আস্তেই এগোই আমরা।