|| বিশ্বকাপ স্পেশাল ||
১৯৭৯ বিশ্বকাপকে বলা যায় প্রথম আসরের কার্বন কপি। প্রথম বিশ্বকাপের মতো এবারও আয়োজক দেশ ছিল ইংল্যান্ড, পৃষ্ঠপোষক প্রুডেন্সিয়াল অ্যাসিউরেন্স কোম্পানি, দলের সংখ্যা ৮, ম্যাচ সংখ্যা ১৫, ভেন্যুর সংখ্যা ৬, ষাট ওভারের ম্যাচ, লাল বল, সাদা জার্সি এবং অবশেষে ক্লাইভ লয়েডের হাতে ট্রফি। পার্থক্য কেবল একটাই, অস্ট্রেলিয়ার বদলে এবার রানার্সআপ হয়েছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
১৯৭৯ সালে আয়োজিত প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরটি আরও একটি কারণে আলাদা। কেরি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজের দাপটে এই বিশ্বকাপটি ছিল আইসিসির অস্তিত্ব প্রমাণের পরীক্ষা। ১৯৭৭ সালে বিভিন্ন দেশের নামী-দামী ক্রিকেট তারকাকে নিয়ে একটি 'বিদ্রোহী লিগ' চালু করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কেরি প্যাকার। মূলত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সাথে চ্যানেল নাইনের টিভি সম্প্রচারস্বত্ত্ব নিয়ে মতবিরোধের জের ধরেই সৃষ্টি হয়েছিল অর্থের ঝনঝনানিওয়ালা এই লীগ। রঙিন জার্সি, দিবারাত্রির ম্যাচ, ফ্লাড লাইট, হলুদাভ সাদা বল, হেলমেট, ড্রপ-ইন পিচ, ফিল্ডিং সার্কেল, খেলা সম্প্রচারে একগাদা ক্যামেরার ব্যবহার — সব মিলিয়ে কেরি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজ তখন বিশ্ব ক্রিকেটেরই প্রধাণ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আইসিসির নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবার প্রচ্ছন্ন হুমকি থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহী এই লিগে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বের নামকরা সব ক্রিকেটাররা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের গতানুগতিক ধারাকে খোলনলচে পাল্টে দেয়া ব্যক্তি মালিকানাধীন এই লীগকে বিশ্বকাপের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ বলেও মনে করছিলেন অনেকে।
কেরি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজ নিয়ে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব যখন দ্বিধাবিভক্ত, ঠিক তখনই প্রথম আসরের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় আইসিসি। ছয়টি টেস্ট খেলুড়ে দল এবং প্রথমবার চালু হওয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব বলে স্বীকৃত 'আইসিসি ট্রফি'র দুই ফাইনালিস্ট শ্রীলঙ্কা ও কানাডাকে নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেটের এই বৈশ্বিক মহাযজ্ঞ।
কেরি প্যাকার সিরিজের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আগের আসরের ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়া। কেরি প্যাকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ সকল ক্রিকেটারকে বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া খেলেছিল কার্যত দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে দলটি।
প্রথম আসরের মত এবারও আট দল খেলেছিল দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে। গ্রুপ এ-তে ছিল অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড এবং নবাগত কানাডা। গ্রুপ বি-তে ছিল ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা।
গ্রুপ “এ" থেকে স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান আর গ্রুপ "বি" থেকে সেমিফাইনালে উঠেছিল টুর্নামেন্টের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ড। ফাইনাল হয়েছিল সেমিফাইনালে বিজয়ী দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে। মাইক ব্রিয়ারলির ইংল্যান্ডকে ৯২ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা ঘরে তুলেছিল ক্লাইভ লয়েডের উইন্ডিজ।
১৯৭৯ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বটা ছিল একদমই ম্যাড়মেড়ে। বেশিরভাগ ম্যাচই ছিল একতরফা। যার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কানাডার মাত্র ৪৫ রানে গুটিয়ে যাওয়া। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ড হিসেবে যেটি টিকে ছিল ২৪ বছর! মজার ব্যাপার হল, ২০০৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৩৬ রানে অলআউট হয়ে লজ্জাজনক এই রেকর্ড ভেঙেছিল কানাডাই!
গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোতে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও ১৯৭৯ বিশ্বকাপেই ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম 'আপসেট' দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অনুষ্ঠিত আসরের নবম ম্যাচে টেস্ট খেলুড়ে দেশ ভারতকে ৪৭ রানে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল শ্রীলঙ্কা। তখনো টেস্ট মর্যাদা না পাওয়া শ্রীলঙ্কার জয়টিকে দেখা হয়েছিল অঘটন হিসেবেই।
সুনীল ওয়েট্টিমুনি (৬৭), দিলীপ মেন্ডিস (৬৪) এবং রয় ডায়াসের (৫০) হাফ সেঞ্চুরির সৌজন্যে লঙ্কানরা পেয়েছিল ২৩৮ রানের লড়াকু পুঁজি। জবাব দিতে নেমে সুনীল গাভাস্কার (২৬) এবং অংশুমান গায়কোয়াডের (৩৩) উদ্বোধনী জুটিতে এসেছিল ৬০ রান। কিন্তু দুই ওপেনারের বিদায়ের পরই যেন মড়ক লাগে ভারতীয় ইনিংসে। তিন নম্বরে নামা দিলীপ ভেংসরকার (৩৬) একপ্রান্ত থেকে লড়াই চালিয়ে গেলেও কপিল (১৬), বিশ্বনাথ (২২), অমরনাথরা (৭) ছিলেন ব্যর্থ। যার ফলাফল ৩৫ বল বাকি থাকতেই ১৯১ রানে থমকে যায় ভারতীয় ইনিংস।
৩টি করে উইকেট নিয়েছিলেন লেগ স্পিনার সোমচন্দ্র ডি সিলভা (৩/২৯) এবং ডানহাতি পেসার অ্যান্টনি ওপাথা (৩/৩১)। তিনটি করে চার ও ছক্কায় সাজানো ৫৭ বলে ৬৪ রানের ঝড়ো ইনিংসের জন্য ম্যাচসেরা হয়েছিলেন দিলীপ মেন্ডিস আর টেস্ট খেলুড়ে দল হয়েও ভারতকে ফিরতে হয়েছিল একেবারে খালি হাতে।
হেডিংলিতে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল আগেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলা দুই দল ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান। সম্ভবত এটাই ছিল গ্রুপ পর্বের সবচাইতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াই।
টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক আসিফ ইকবাল। তবে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের ব্যাটিংটা এদিন একদমই ভাল হয় নি। ৬০ ওভার ব্যাট করে ৯ উইকেট হারিয়ে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৬৫ রান। সর্বোচ্চ ৩৩ রান এসেছিল গ্রাহাম গুচের ব্যাট থেকে। পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩টি করে উইকেট নিয়েছিলেন ডানহাতি পেসার সিকান্দার বখত এবং অফ স্পিনার মাজিদ খান।
জবাব দিতে নেমে ইংলিশ পেসার মাইক হেনড্রিকের বিধ্বংসী বোলিংয়ে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পাকিস্তানের ইনিংস। ৩৪ রান তুলতেই নেই ৬ উইকেট! ১২ ওভার বল করে মাত্র ১৫ রান খরচায় হেনড্রিক একাই নেন ৪ উইকেট!
পাকিস্তানের শেষ ভরসা তখন অধিনায়ক আসিফ ইকবাল। ৭ম উইকেট জুটিতে ওয়াসিম রাজাকে (২১) নিয়ে ৫২ রান যোগ করে লড়াই জমিয়ে তোলেন তিনি। তবে দলীয় ১১৫ রানের মাথায় বব উইলিসের বলে আসিফ (৫১) বিদায় নিলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইংল্যান্ডের হাতে। ৯ম উইকেটে ইমরান খান-ওয়াসিম বারীর ৩৫ রানের জুটি আবার নতুন করে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত ১৪ রানের শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে স্বাগতিকরা। ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন মাইক হেনড্রিক।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আসরের প্রথম সেমিফাইনালে স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড। গ্রাহাম গুচের ৭১, অধিনায়ক ব্রিয়ারলির ৫৩ এবং ডেরেক রেন্ডালের 'ঝড়ো' ৪২ রানের উপর ভর করে ইংল্যান্ড করেছিল ৮ উইকেটে ২২১। জবাবে শুরুটা ভাল হলেও মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে
ব্ল্যাক ক্যাপসরা। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৬৯ রান করা ওপেনার জন রাইটের বিদায়ের পরই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে তাদের ইনিংস। শেষদিকে উইকেটরক্ষক ওয়ারেন লিস (২৩), রিচার্ড হ্যাডলি (১৫) এবং ল্যান্স কেয়ার্ন্সের (১৪) ছোট ছোট ইনিংসগুলো জয়ের স্বপ্ন দেখালেও শেষ পর্যন্ত ৯ রানের হার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে আরও একবার প্রতিপক্ষ শিবিরে ত্রাস সৃষ্টি করেন ডানহাতি পেসার মাইক হেনড্রিক। তবে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন গ্রাহাম গুচ।
উল্লেখ্য, এটা ছিল সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের টানা দ্বিতীয় হার।
লন্ডনের ওভালে 'হাই ভোল্টেজ' দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় আসরের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়াকে বিদায় করে সেমিফাইনালে ওঠা পাকিস্তান। দুদলের মধ্যকার এই লড়াই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল চার বছর আগের সেই রোমাঞ্চকর থ্রিলারের কথা।
দুই ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ (৭৩) ও ডেসমন্ড হেইন্সের (৬৫) ফিফটি এবং কলিস কিংয়ের (২২ বলে ৩৫) 'ক্যামিও'তে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৬ উইকেটে ২৯৩ রান। জবাবে শুরুতেই ওপেনার সাদিক মুহম্মদকে (১) হারালেও আরেক ওপেনার মাজিদ খান ও তিন নম্বরে নামা জহির আব্বাসের ব্যাটে চড়ে জয়ের পথেই এগোচ্ছিল পাকিস্তান। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করেন ১৬৬ রান। মাজিদ-আব্বাস জুটির নান্দনিক স্ট্রোকপ্লের সামনে ক্যারিবীয় পেস ব্যাটারিকে একটা সময় মনে হচ্ছিল অসহায়।
একটু বলে নেয়া ভাল, হোল্ডিং, গার্নার, রবার্টস আর ক্রফটের মত ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারের সমন্বয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস অ্যাটাক তখন বিশ্বসেরা। অথচ তাদের বিরুদ্ধেই কিনা অবলীলায় স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন দুই ব্যাটসম্যান। উইজডেনের ভাষায়, “Runs flowed off the bat with surprising ease. Majid, ever-relaxed and seemingly having ever so much time to play his shots, and Zaheer the dazzling stroke-player, master on the off-side, put the fearsome bowling to the sword."
জয়ের জন্য শেষ ২০ ওভারে পাকিস্তানের চাই ১১৮ রান। হাতে আছে ৯ উইকেট। এমন সময় হঠাৎ জ্বলে উঠলেন কলিন ক্রফট। মাত্র ১২ বলের আগুনঝরা এক স্পেলে তুলে নিলেন পাকিস্তানের 'তিন' ব্যাটিং স্তম্ভ মাজিদ খান (৮১), জহির আব্বাস (৯৩) এবং জাভেদ মিয়াঁদাদের (০) উইকেট। ১৭৬/১ থেকে মুহূর্তের মধ্যেই স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ১৮৭/৪!
এদিকে অভিজ্ঞ হারুনুর রশীদ (১৫) কাটা পড়লেন রান আউটের খাঁড়ায়। তবে দ্রুত চার উইকেট হারালেও পাকিস্তানের জয়ের স্বপ্ন তখনও বেঁচে ছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন ভিভ রিচার্ডস। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, ভিভ রিচার্ডস! পেসারদের স্বর্গে হঠাত করেই অফ স্পিনের ভেলকি নিয়ে হাজির হলেন তিনি। একে একে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠালেন আসিফ ইকবাল (১৭), মুদাসসর নজর (২) এবং ইমরান খানকে (৬)। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় তখন কেবলই সময়ের অপেক্ষা। দুই টেইলএন্ডার ওয়াসিম বারী (৯) এবং সরফরাজ নওয়াজকে (১২) আউট করে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকলেন অ্যান্ডি রবার্টস।
২৯ বল বাকি থাকতেই ২৫০ রানে অলআউট পাকিস্তান। বোলারদের নৈপুণ্যে প্রায় ফসকে যাওয়া ম্যাচটা ৪৩ রানে জিতে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর গর্ডন গ্রিনিজ হলেন ম্যাচসেরা।
'ক্ল্যাসিক' দুটি সেমিফাইনালের পর ফাইনালের শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে উপস্থিত আসরের টপ ফেবারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ড। যেখানে দুদল মিলে উপহার দিল আজীবন মনে রাখার মত একটি ম্যাচ।
লর্ডসের ফাইনালে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ৯৯ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ডেসমন্ড হেইন্স (৯), গর্ডন গ্রিনিজ (২০), আলভিন কালিচরণ (৪), ক্লাইভ লয়েড (১৩) — একে একে সবাই ফিরলেন ব্যর্থ হয়ে। ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে ক্রিজে ছিলেন কেবল কলিস কিং যার ব্যাটিং গড় মাত্র ১৩!
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ১৩ গড়ের কিংই হয়ে উঠলেন নায়ক। নিজের মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই মারলেন চার! ১০ চার ও ৩ ছক্কার সাহায্যে খেললেন ৬৬ বলে ৮৬ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস! এমন এক ইনিংস যা ভিভ রিচার্ডসের মত ব্যাটসম্যানকেও দর্শক বানিয়ে ছেড়েছিল!
সেদিন মাঠে কলিস কিংয়ের আধিপত্য বোঝাতে একটা তথ্য দিই। কিংয়ের যখন ফিফটিও হয়নি, রিচার্ডস ছিলেন নব্বইয়ের কোটায়। তারপর ফিল এডমন্ডসের বলে তিনি যখন ডিপ স্কয়ার লেগে ডেরেক রেন্ডালের হাতে ধরা পড়লেন, রিচার্ডস তখনও ছিলেন নব্বইয়ের ঘরেই!
ধারাভাষ্যকার টনি কোজিয়ারের ভাষায়, “It was a complete carnage at Lord's. It didn't matter who was bowling, King kept despatching them to the ropes. And what a knock it turned out to be.”
কিংয়ের বিদায়ের পর স্বরূপে হাজির হলেন ভিভও। খেললেন ১১ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ১৫৭ বলে ১৩৮ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। উইজডেনের বিচারে যেটি ওয়ানডের সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ইনিংস!
উল্লেখ্য, কিং আউট হওয়ার পর ভিভ ছাড়া শেষ পাঁচ ব্যাটসম্যানের মিলিত অবদান ছিল ৫ রান! ৫, ০, ০, ০ এবং ০*! নির্ধারিত ৬০ ওভার শেষে উইন্ডিজের স্কোর গিয়ে দাঁড়াল ৯ উইকেটে ২৮৬।
২৮৭ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বয়কট-ব্রিয়ারলির উদ্বোধনী জুটির শুরুটা ছিল শম্বুক গতির। ব্রিয়ারলি তাও কিছুটা চালিয়ে খেলছিলেন, কিন্তু দুই অঙ্ক ছুঁতেই ১৭ ওভার লাগিয়ে ফেলা বয়কট বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন গাভাস্কারের সেই ৩৬ রানের বিতর্কিত ইনিংসের কথা!
৩৮ ওভারের উদ্বোধনী জুটিতে আসল ১২৯ রান। ব্রিয়ারলি ১৩০ বলে ৬৪ আর বয়কট ১০৫ বলে ৫৭। জয়ের জন্য শেষ ২২ ওভারে চাই আরও ১৫৮ রান। ক্রমশ বাড়তে থাকা আস্কিং রেটের সাথে তাল মেলাতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ইংল্যান্ডের ইনিংস। ‘বিগ বার্ড’ জোয়েল গার্নারের প্রলয়ঙ্করী এক স্পেলে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে ছত্রখান! ১১ বলের জাদুকরী স্পেলে মাত্র ৪ রান দিয়ে গার্নার নিলেন ৫ উইকেট! যার চারটিই ছিল ক্লিন বোল্ড!
একতরফা ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেল ৯২ রানের অনায়াস জয়। কিন্তু তারপরও একে ধ্রুপদি ম্যাচের মর্যাদা দিয়ে থাকেন অনেকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
উইন্ডিজ: ৬০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৮৬ (রিচার্ডস ১৩৮*, কিং ৮৬, এডমন্ডস ২/৪০)
ইংল্যান্ড: ৫১ ওভারে ১৯৪ অলআউট (ব্রিয়ারলি ৬৪, বয়কট ৫৭, গার্নার ৫/৩৮)
ম্যাচসেরা: ভিভ রিচার্ডস।
১৯৭৯ বিশ্বকাপে উইন্ডিজের সাফল্যের মূল কারিগর ছিল গার্নার-হোল্ডিং-ক্রফট-রবার্টসে গড়া সেই বিখ্যাত 'পেস চতুষ্টয়'। চারজনের মিলিত অবদান ছিল ৩১ উইকেট; গার্নার ৮, হোল্ডিং ৮, ক্রফট ৮, রবার্টস ৭!
এবারে চলুন এক নজরে দেখে নিই ১৯৭৯ বিশ্বকাপের উল্লেখযোগ্য কিছু পরিসংখ্যান।
ব্যাটিং:
• সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৯৩/৬, বিপক্ষ পাকিস্তান।
• সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক: গর্ডন গ্রিনিজ (উইন্ডিজ) ৬২.৩২ গড়ে ২৫৩ রান; দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ভিভ রিচার্ডস (উইন্ডিজ) ১০৮.৫ গড়ে ২১৭ রান।
• ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস: ভিভ রিচার্ডস ১৩৮*, বিপক্ষ ইংল্যান্ড।
• সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি: ১টি করে গর্ডন গ্রিনিজ ও ভিভ রিচার্ডস।
• সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরি: ২টি করে যথাক্রমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ডন গ্রিনিজ, পাকিস্তানের মাজিদ খান ও আসিফ ইকবাল, ইংল্যান্ডের মাইক ব্রিয়ারলি এবং গ্রাহাম গুচ।
বোলিং:
• সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি: মাইক হেনড্রিক (ইংল্যান্ড) ১০ উইকেট; এছাড়া ইংল্যান্ডের ক্রিস ওল্ড, পাকিস্তানের আসিফ ইকবাল এবং নিউজিল্যান্ডের ব্রায়ান ম্যাককেকনি নিয়েছিলেন ৯টি করে উইকেট।
• সেরা বোলিং: অ্যালান হার্স্ট (অস্ট্রেলিয়া) ৫/২১, বিপক্ষ কানাডা।
• ৫ উইকেট: ২টি, জোয়েল গার্নার (৫/৩৮) এবং অ্যালান হার্স্ট (৫/২১)।
উইকেটকিপিং:
• সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: ডেরেক মারে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), ৭টি।
• এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: ৩টি করে ডেরেক মারে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), বিপক্ষ পাকিস্তান এবং ওয়ারেন লিস (নিউজিল্যান্ড), বিপক্ষ ভারত।
ফিল্ডিং:
• সর্বোচ্চ ক্যাচ: ৪টি করে যথাক্রমে আলভিন কালীচরণ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), আসিফ ইকবাল (পাকিস্তান) এবং মাইক ব্রিয়ারলি (ইংল্যান্ড)।