বিপিএলের ডানায় চড়ে সারাদেশে তারুণ্যের উৎসব
ছবি: সংগৃহীত
আন্দোলন তখনও শেষ হয়ে যায়নি। চারদিকে ভয়, হাহাকার তবে তাঁরা ছিলেন অকুতোভয়। তীর হারা এক ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে নৌকার বাঁকা বৈঠা ধরেছিলেন সাহসী বীরেরা। ২৬ জুলাই- হাতে হাতকড়া সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা, সেই হাতে পানির বোতল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি গায়ে জড়িয়ে থাকা ঢাকা কলেজের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে এভাবেই নিয়ে আসা হয়েছিল আদালত পাড়ায়। এমন ছবি দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেদিন মানুষ আত্মচিৎকার করেছে, হাহাকারে পুড়েছে। একযোগে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বয়কটের ডাকও আসে। না, দেশের ক্রিকেট শেষ হয়ে যায়নি। তবে আগ্রহ যে খানিকটা কমেছে সেটা নতুন করে হয়ত বলতে হবে না। সেটার একটা বড় কারণ অবশ্য পারফরম্যান্স।
আমাদের আলোচনা অবশ্য বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ঘিরে নয়। কত শিশু, কিশোর, তরুণ প্রাণ বিসর্জন আর কতশত মানুষের আত্মত্যাগে এমন এক স্বপ্নের দুয়ার খুলেছে সবার সামনে। দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো ক্রীড়া ক্ষেত্রেও হাজারটা দুয়ার খুলে দিয়েছে। কদিন আগে জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নিহত আর আহত ব্যক্তিদের স্মরণ করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আয়োজন করেছে ‘বাংলাদেশ ২.০ চ্যালেঞ্জ কাপ’। ধুলোয় জমে পড়া ফুটবল যখন এমন কিছু করে দেখায় সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পিছিয়ে থাকার সুযোগ কই?
বিপিএলের হাত ধরে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’কে শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে দিতে চায় বিসিবি। দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। শুরুটা হয়েছে বিপিএলের থিম দিয়ে। ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’- ‘মোরা আকাশের মতো বাধাহীন’ এমন সব স্লোগানে। আয়োজনে কমতি না রাখতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসকেও সম্পৃক্ত করেছেন তারা। মাস কয়েক আগে শেষ হওয়া প্যারিস অলিম্পিকের ডিজাইন করা একজনের হাতে বিপিএলের দায়িত্ব। স্বপ্নটা তাই একটু বেশিই!
প্রথমবারের মতো বিপিএলে দেখা মিলবে মাসকটের! এমনটা জানা ছিল আগে থেকেই। অবশেষে ১লা ডিসেম্বর রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে উন্মোচিত হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত সেই মাসকট। শীতের সকালের রোদ খানিকটা পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। হোটেলের প্রধান ফটক থেকে একটু ভেতরে ঢুকতেই বড় ফেস্টুনে লেখা ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই।’ বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের ‘থিম সং’ এও থাকবে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের লেখা লাইনটা। তারুণ্যের উৎসবের শুরুটা হয়েছে বিপিএলের মাসকট উন্মোচনের মধ্য দিয়ে।
শীতের আবহে পুরো শহর জড়িয়ে যাওয়ার সকালে এমন এক আয়োজনের সাক্ষী হতে এসেছিলেন ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, নাজমুল হোসেন শান্ত, মুশফিকুর রহিম, জাহানারা আলম, নিগার সুলতানা জ্যোতি ও সালমা খাতুন। শুধু ক্রিকেটারই নয় এদিন জমকালো আয়োজনে চোখে পড়েছে ফুটবলার তপু বর্মন ও ফয়সাল আহমেদ, ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার, বিদ্যুৎ কুমার সাহা, সাবেক অ্যাথলেট সুফিয়া খাতুন, সাবেক টেবিল টেনিস তারকা জোবেরা রহমান, সাবেক শুটার আসিফ হোসেন খান ও অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা।।
এমন দিনের সাক্ষী করতে ডেকে নেয়া হয়েছে ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বিএম কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। আনন্দে আত্মহারা শিক্ষার্থীরা অবিশ্বাস্য চোখে নাম মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে দেখে নিয়েছেন নিজেদের ক্রিকেট তারকাদের। কেউ কেউ ছবি তুলে রেখেছেন আজন্ম এক স্মৃতি হিসেবে। ঘণ্টাখানের অনুষ্ঠানে জুলাই-আগষ্টের উপর ভিত্তি করে দেখানো হয়েছে একটি প্রামাণ্যচিত্র। আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধসহ আরও বেশ কয়েকজন শহীদের এবং তাদের পরিবারের গল্প চিত্রায়ন করা হয়েছে। তারুণ্যের উৎসবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, কাবাডি কিংবা অন্যান্য স্পোর্টসকে।
ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পাশাপাশি প্রতিভা অন্বেষণে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, আন্তঃ স্কুল ও কলেজ প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, স্কিল প্রতিযোগিতা ও জুলাই-৩৬ বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছেন তারা। এ ছাড়া যুব ও উদ্যোক্তা সমাবেশ অনুষ্ঠান, বিভিন্ন কর্মশালা, জনসচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রম, আর্ট গ্যালারিতে জুলাই বিপ্লবের চিত্র প্রদর্শনী, অনুদান ও বৃত্তি প্রদান, বর্জ্য-শূন্যতা প্রচারে চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার প্রদান, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্পেইন, কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টি বিষয়ক অলিম্পিয়াডের মতো আয়োজনও চোখে পড়বে আগামী আড়াই মাসে। যার শুরুটা হয়েছে বিপিএলের মাসকট উন্মেচন করে।
অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে যাওয়ার পর ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদরা মিলে উন্মোচন করেন বিপিএলের মাসকট। নাম ডানা ‘৩৬’। যার গড়ন, ব্যবহৃত রং ও অঙ্গভঙ্গি উপস্থাপন করে স্বাধীনতা, শান্তি, মুক্তি, তারুণ্য, প্রাণবন্ততা, উৎসব এবং সীমাহীন সম্ভাবনাকে। এখানে ডানা শব্দটি পাখা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। ডানা ৩৬ মাসকটটি - ডানা বা পাখা প্রসারিত করা একটি সাদা পায়রা, যা শান্তির প্রতীক এবং প্রতিপাশে ১৮টি করে মোট ৩৬টি রঙিন পালক উপস্থাপন করে ৩৬ শে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় স্মৃতিকে।
যা প্রতিটি স্বপ্নবাজ, উদ্যমী, অপ্রতিরোধ্য তরুণকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। ডানা’র স্বপ্নময় চোখ ও উজ্জ্বল হাসিতে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আনন্দ এবং ক্রিকেট মাঠের অফুরন্ত সম্ভাবনা। এমন আয়োজনে নতুন এক বিপিএলের শুরুর আভাস বাংলাদেশের ক্রিকেটে। যেখান থেকে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হিসেবে দেখছেন দেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।