|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
ফিরে যাওয়া যাক ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারিতে। সেই বছরের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে বাদ দিয়েই দল ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশ দলের নির্বাচকরা। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) পাওয়া চোটে বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় দেশ সেরা এই পেসারের।
পরবর্তীতে জানা যায় অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবং প্রধান কোচ জেমি সিডন্সের চাওয়াতেই বাদ দেয়া হয় ফিটনেস না থাকা মাশরাফিকে। এই 'ফিটনেস' নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এরপর এক যুগ কত দৃশ্যের অবতারণা হবে সেটা কেউ জানত না। দল ঘোষণার পর মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মাশরাফির কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে ওঠে।
এরপর ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে সেই মাশরাফিই বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন। হয়ে ওঠের দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়কও। ২০১৫ বিশ্বকাপে মাশরাফির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া জয়টি ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপটি ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশার। সাউথ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় পেলেও বাকি ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে ছিল বাজে।
যদিও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে স্বপ্নের মতো বিশ্বকাপ কাটিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। ৬০৬ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের ফলে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ারও দাবিদার ছিলেন এই অলরাউন্ডার। তবে দল সেমিফাইনাল বা ফাইনালে পৌঁছাতে না পারায় অন্যদের সঙ্গে পেরে ওঠতে পারেননি তিনি।
সেই বিশ্বকাপেই চোট দেখিয়ে বড় দলের বিপক্ষে খেলতে না চাওয়ার গুঞ্জন ছিল এক পেসারের বিরুদ্ধে। এমনকি আরেক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দলের প্রয়োজনে না নিজের জন্য স্বার্থপর ইনিংস খেলার। সেই ক্রিকেটারের সঙ্গে সাকিবের বাকবিতণ্ডার খবরও বিশ্বকাপ শেষে গণমাধ্যমে এসেছিল। দুটো ঘটনার মূলেই ছিল সেই ফিটনেস। দুই ক্রিকেটারই নিজেদের ফিটনেসের অবস্থা লুকিয়ে বিশ্বকাপে খেলেছিলেন বলে গুঞ্জন আছে।
সেই বিশ্বকাপের আগে চোটের কারণে ছিটকে গিয়েছিলেন পেসার তাসকিন আহমেদ। দল ঘোষণার পর তাসকিন সেদিন গণমাধ্যমের সামনেই কেঁদেছিলেন। ইনফর্ম তাসকিন সেই বিশ্বকাপে খেলতে পারলে ফলাফল অন্যরকমই হতে পারতো বাংলাদেশ দলের। সেই তাসকিন নিজেকে আমুল বদলে ফেলে চার বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের নেতা হিসেবে যাচ্ছেন।
এবার ফেরা যাক বর্তমানে। সব ঠিক থাকলে পাশের দেশ ভারতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল তামিম ইকবালের। যদিও নানা ঘটনা প্রবাহ, নাটকীয়তা, স্বপ্নভঙ্গের পর বিশ্বকাপেই খেলা হচ্ছে না এই ওপেনারের। এখানেও রয়েছে সেই 'ফিটনেসে' ঘাটতির বিষয়টি।
সর্বশেষ আফগানিস্তান সিরিজে হুট করেই অবসরের ঘোষণা করে আলোড়ন ফেলে দেন তামিম। পরে জানা যায় পুরো ফিট না হয়ে খেলতে নামায় অধিনায়কের ওপর নাখোশ ছিলেন প্রধান কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। এ নিয়ে বোর্ড সভাপতির কাছেও জবাব চেয়েছিলেন কোচ। এ ছাড়া দলের উচ্চ পর্যায়ে তাকে নিয়ে সমালোচনার বাষ্প ছড়িয়ে দেয়া, তার চোটকে সন্দেহের চোখে দেখা, অধিনায়কত্ব নিয়েও অনিশ্চয়তাও তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার অন্যতম কারণ ছিল।
অবশ্য অবসরের একদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ আর মাশরাফি বিন মুর্তজার মধ্যস্থতায় অবসর থেকে ফিরে আসেন তামিম। কদিন পর বিসিবি সভাপতির সঙ্গে আলোচনা শেষে তামিম জানান তিনি আর অধিনায়কত্ব করবেন না, চোটের কারণে খেলবেন না এশিয়া কাপেও। এরপর তিনি পিঠের চোট কাটিয়ে উঠতে ইংল্যান্ডে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তিনি। নেন বেশ কয়েকটি ইনজেকশনও। লক্ষ্য বিশ্বকাপের আগে ফিট হয়ে ফেরা।
তামিম ফিরলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। বৃষ্টির কারণে প্রথম ওয়ানডেতে ফিরলেও ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ব্যাটিংয়ে নেমে তামিম করলেন ৫৮ বলে ৪৪। এমন পারফরম্যান্সের পর তামিমকে নিয়ে শঙ্কা দূর হওয়ার কথা ছিল। অথচ ম্যাচ শেষে তামিম নিজেই জানালেন এই রান পেলেও ইনিংস জুড়ে স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন, ছিল অস্বস্তিও।
এরপর থেকেই তামিমের বিশ্বকাপ নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। সেই ধোঁয়ার কুন্ডুলি আরও বিস্তৃত হয় ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে। এদিন মধ্যরাতে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও প্রধান কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহে। জানা যায় হাফ ফিট তামিমকে নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন কোচ-অধিনায়ক।
সেই জল্পনা-কল্পনা সত্যি হয় ২৬ সেপ্টেম্বর দল ঘোষণার পর। দলে জায়গা হয়নি তামিমের। আগে থেকেই জানা ছিল বিশ্বকাপে খেলতে হলে ব্যথা ম্যানেজ করেই খেলতে হবে এই ওপেনারকে। তাই তামিমকে নিয়ে বিশ্বকাপ দল গড়া হবে নাকি তামিমকে ছাড়াই এই বিষয়টি পুরোপুরি ছিল নির্বাচক-কোচ-অধিনায়কের হাতে। তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই হয়তো তামিমকে ছাড়া বিশ্বকাপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
কদিন আগেই তামিম তার ভেরিফাইড ফেসবুকে পেজে একটি ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, 'আমার খুব ফেভারিট একটা গান - অর্থহীনের 'চাইতে পারো' । এটা যখনই শুনি চার্জড আপ হয়ে যাই।' বিশ্বকাপ দলে থেকে বাদ পড়ার পর নিজের প্রিয় এই গান শুনেই হয়তো নিজেকে কিছুটা চাঙ্গা করতে চাইবেন।
এই গানের মধ্যে একটা লাইন আছে, 'চাইতেই পারো চেষ্টা করে দেখতে, কে আছে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে'। গত এক দেড় বছরের ঘটনা প্রবাহে সবাই জেনে গেছেন সাকিব আর তামিমের মধ্যকার পুরোনো সেই বন্ধুত্ব এখন অতীত। তাই তামিমের ফ্রেন্ডলিস্টে সাকিব এখনও টিকে আছেন কিনা সেটা জানা যায়নি।
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপের আগে দল সাজাতে যে বিড়ম্বনায় পড়েছেন তিনি বলতেই পারেন 'ঘরে সুখ নাই, বাইরে সুখ নাই'। কদিন আগে একটি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে এই গানের তালেই নাচতে দেখা গিয়েছিল সাকিবকে। বর্তমান পরিস্থিতি দেশের দুই সেরা ক্রিকেটারকেই এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছে। সেই বিন্দুর নাম দেয়া যায় 'চাইতেই পারো' কিংবা 'ঘরে সুখ নাই'।