|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
কাউন্ট অব মান্টে ক্রিস্টো, বলা হয়ে থাকে ক্লাসিক এক উপন্যাস। আলেকজান্দ্রে ডুমাসের লেখা সেই উপন্যাসে বিনা অপরাধে কারাগারে যেতে হয়েছিল এডমন্ডকে। বিনা অপরাধে কারাবন্দি হওয়া এডমন্ড পালানোর উপায় খুঁজতে গিয়ে দিনের পর পর, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর সুড়ঙ্গ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। তবে নিজে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি এডমন্ড। তাতে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তখনই ফরাসি পাদ্রী ফারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় এডমন্ডের।
হতাশায় ডুবে থাকা এডমন্ডকে আশার বাণী শুনানোর সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষিতও করেছিলেন ফারিয়া। সেটা কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে বেরিয়েছিলেন এডমন্ড। কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টোর গল্পের সঙ্গে রিচার্ড গ্লিসনের জীবনের গল্পের মিল না থাকলেও ফারিয়াকে মেলাতে পারেন জেমস মিডলব্রকের সঙ্গে। ল্যাঙ্কাশায়ারের প্রায় ৩৫ বর্গ কিলোমিটারের ব্ল্যাকপুল শহরে জন্ম গ্লিসেনের। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ল্যাঙ্কাশায়ারের জার্সিতে খেলার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ইংল্যান্ড দল পর্যন্ত। তবে শুরুর পথেই হোঁচট খান গ্লিসন। মাত্র ১১ বছরের বয়সে ট্রায়াল দিলেও সুযোগ মিলেনি তার। ব্ল্যাকপুলে শহরটা বরাবরই উৎসব প্রিয়। উৎসবের সময়টাতে অন্যান্য ক্রীড়াযজ্ঞের সঙ্গে ক্রিকেটটাও হরহামেশাই খেলা হয়। তেমনই এক উৎসব উদযাপনের সময় সুযোগ পেয়েছিলেন গ্লিসন। তবে সেটা ক্রিকেটার হিসেবে নয়, মাত্র ১৬ বছর বয়সি গ্লিসন সেদিন ছিলেন দলের স্টাফ হিসেবে।
বয়স যখন ২২ বা ২৩ পেরিয়ে যায় তখন কাম্বারল্যান্ডের হয়ে মাইনর কাউন্টি ক্রিকেট খেলা শুরু করেন গ্লিসন। ২০১৩ সালে নর্থ্যান্টস সেকেন্ডসের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেও সেটা কাজে লাগাতে পারেননি। এরপর ক্রিকেকটা গ্লিসনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। খেলার বাইরে থাকতে হয় ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তবে মাইনর কাউন্টি খেলায় বেডফোডশায়ারের হয়ে খেলা মিডলব্রকের সঙ্গে পরিচয়টা আগে থেকেই ছিল গ্লিসনের।
কোচকে বলে গ্লিসনকে নর্থহ্যাম্পটনশায়ারে খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মিডলব্রক। মাত্র দুই ম্যাচ খেলে চলে যান ডানহাতি এই পেসার। বয়স ২৭ পেরিয়ে যাওয়া লগ্নে হওয়ায় ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন গ্লিসন। সেই সময়টায় ল্যাঙ্কাশায়ারের একাডেমি কোচিং শিখেছেন। এর আগে অবশ্য ব্রয়লার ফার্ম ও মাছ শিকারির দোকানে চাকরি করেছেন। এ ছাড়া বাগানের মালি হিসেবেও কাজ করেছেন গ্লিসন। তবে পুরো গ্রীষ্ম মৌসুমে নর্দান লিগে ৫০ উইকেট নেয়ায় ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় গ্লিসনের।
২৭ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া গ্লিসন নিজের প্রথম ম্যাচেই শন মার্শ ও মিচেল মার্শের উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। গ্লিসনের পারফরম্যান্স নজর কেড়েছিল প্রধান কোচ ডেভিড রিপলির। দলকে টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টের শিরোপাও জেতান ডানহাতি এই পেসার। ২০১৬ সালের মৌসুমের মাঝের দিকে সাদা বলের ক্রিকেটে দারুণ বোলিং করায় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) সুযোগ হয় গ্লিসনের। সেবার শহীদ আফ্রিদি, বাবর আজম, শারজিল খান, মোহাম্মদ শেহজাদ, দাসুন শানাকার সঙ্গে রংপুর রাইডার্সে খেলেছিলেন ডানহাতি এই পেসার। তবে তিন ম্যাচের বেশি খেলার সুযোগ হয়নি তার।
রংপুরের জার্সিতে তিন ম্যাচ খেলা গ্লিসন নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। যেখানে এক ম্যাচে ৩০ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। ব্যাট হাতে তিন ম্যাচে গ্লিসনের রান ১। দেশে ফিরে ২০১৭ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাজিমাৎ করেন গ্লিসন, নেন ৪০ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের পর ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে খেলার সুযোগ মেলে তার। ২০১৮ সালে তার সঙ্গে চুক্তিও করে ল্যাঙ্কাশায়ার। ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করার পরও ২০১৯ মৌসুমে নেন ৫৬ উইকেট।
এমন পারফরম্যান্সে সুযোগ মিলে বিগ ব্যাশ, আবুধাবি টি-টেন লিগ ও দ্য হান্ড্রেডে। এর মধ্যে বিগ ব্যাশে খেলেছেন মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে। ২০২০ সালে করোনার সময়টায় ডাক পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের তিন ফরম্যাটের জন্য বিবেচিত ৫৫ ক্রিকেটারের প্রাথমিক ক্যাম্পে। তবে সেখান থেকে জাতীয় দলের জার্সি জড়ানোর সুযোগ হয়নি গ্লিসনের। সেসময় ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে গ্লিসন জানিয়েছিলেন, ‘কখনও হাল ছেড়ো না, স্বপ্নকে তাড়া করো।’
নিজের সেই স্বপ্নকে তাড়া করেছেন, শেষ পর্যন্ত স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখবার সময় এসেছে গ্লিসনের। ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে প্রথমবার ডাক পেয়েছেন ৩৪ বছর বয়সি এই পেসার। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার বিবেচনায় আছেন এমন পেসারদের মাঝে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি ২০ উইকেট নিয়েছেন গ্লিসন। অথচ পিঠের চোটের কারণে সর্বশেষ দুই মৌসুমে বেশিরভাগ সময়ই মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাকে।
এতটা পথ পেরিয়ে আসা গ্লিসনের ক্রিকেটারের বাইরে আরও বেশি কিছু পরিচয় রয়েছে। ডানহাতি এই পেসারের টুইটারের বায়োতে লেখা রয়েছে নিজের কর্মদক্ষতার কথা। ক্রিকেটারের সঙ্গে গ্লিসনের পরিচয় ইসিবির লেভেল থ্রি কোচ, কোচিং ও স্পোর্টস পারফরম্যান্সে বিএ (অনার্স), ল্যাঙ্কাশায়ারের একাডেমি কোচ। এত সবকিছুর বাইরে গ্লিসন একজন প্রভাষক। মায়ারস্কো কলেজের ক্রিকেট প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন গ্লিসন।
নিজেদের শিক্ষক ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত মায়ারস্কো কলেজও। গ্লিসনের ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পাওয়ার খবর শেয়ার করে মায়ারস্কো কলেজ টুইটারে লিখেছে, ‘যখন আপনাদের শিক্ষক ইংল্যান্ড দলে ডাক পেয়ে যান! এ খবর শুনে আমরা আকাশে উড়ছি, রিচার্ড গ্লিসন!’ খবরটা শোনার পর হয়তো গ্লিসনও উড়ছে। একটা সময় ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চাওয়া গ্লিসন হয়তো এও বলছেন, ‘নেভার গিভ আপ, কিপ ফ্লোয়িং ইউর ড্রিম।’