|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
ক্রিকেটকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলেন অনেকে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটকে। পরতে পরতে লড়াই, সংগ্রাম, হতাশা আর হার জিতের গল্প লেখা থাকে বলে। মুহূর্তে যেমন বদলে যায় ম্যাচের চিত্রনাট্য, জীবনেরও। ক্রিকেট কখনো দেয় দু হাত ভরে, কেড়ে নিতেও কার্পন্য করে না প্রায়ই। ঠিক জীবনের মতো?
নবদ্বীপ সাইনির কথাই ধরুন। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে সুপার ওভারে মাত্র ৭ রান দিয়ে নায়ক বনে গেছেন যিনি। যার চতুর বোলিংয়ে এবারের আইপিএলে দ্বিতীয় জয় তুলে নিয়েছে ব্যঙ্গালুরু। অথচ আজ থেকে ৭ বছর আগেও ক্রিকেট বল কখনো হাতে নিয়েই দেখেননি এই তরুণ।
সাল ২০১৩, শীত আসবে আসবে করছে তখন। কুয়াশারা উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। হরিয়ানার এক গ্রামে হিন্দি এক পত্রিকা হাতে নিলেন নবদ্বীপ। এরপরই গেলেন চমকে। গৌতম গম্ভীর, ভিরেন্দর শেওয়াগ, বিরাট কোহলিরা খেলবেন দিল্লির হয়ে। অনুশীলন করবেন ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে।
আগে-পরে আর কিছু ভাবলেন না ২০ বছরের তরুণ। তার হিরোরা আসছেন খুব কাছে। রক্তে-মাংসে তাদের বাস্তবে কেমন দেখায় দেখতে হবে। উঠে গেলেন বাসে। ছুঁটলেন ফিরোজ শাহ কোটলার উদ্দেশ্যে। এক বন্ধুর বাসায় থাকবেন সেখানে, দেখবেন নিজের ক্রিকেট নায়কদের।
স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর ঘোর ভাঙলো নবদ্বীপের। স্বপ্ন পরিণত হলো জেদে। গেটে সিকিউরিটি গার্ড আটকে দিয়েছেন। যাওয়া যাবে না নায়কদের কাছে। সাইনি মুষড়ে পড়লেন না। বয়স কেবল ২০, তার এখনো অনেক কিছু করার বাকি। সেটাও বুঝে উঠতে পারেননি তখনো। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, দিল্লির নেট বোলার হয়ে উঠার।
এমনিতে ক্রিকেট খেলতেন নবদ্বীপ। জোরে বল করতে পারতেন। খেপ খেলতে যেতেন ম্যাচ প্রতি ২০০ রুপিতে। হরিয়ানা ঘুরে ঘুরে খেলতেন। জিততেন প্রাইজ মানিও। তবে সিকিউরিটি গার্ডের ঢুকতে না দেয়াটাই জেদ বাড়িয়ে দিলো নবদ্বীপের।
পরের বছর এক ক্লাবে নাম লেখালেন। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে নয়, নেট বোলার হয়ে দিল্লির পক্ষে রঞ্জি খেলা তারকাদের সঙ্গে হাত মেলাতে। যোগাড় করলেন জীর্ণ দুই সাদা বুট জোড়া। নবদ্বীপের কল্পনা সত্যি হলো দ্রুতই। নেট বোলার হিসেবে সুযোগ পেয়ে গেলেন ভাগ্যগুণে।
হঠাৎ অনুশীলনে ভেন্যু বদলেছে। কিন্তু জানানো হয়নি দলের নেট বোলারকে। ডাকা হলো নবদ্বীপকে। ক্রিকেটার সুমিত নারওয়াল তাকে দেখেছিলেন করনাল প্রিমিয়ার লিগে, মুগ্ধ হয়েছিলেন বোলিং দেখে। তিনিই সুযোগ করে দিলেন দিল্লির হয়ে নেটে বোলিং করার।
নিজের রঙিন কল্পনার বাস্তব রূপে ভড়কে গেলেন না নবদ্বীপ। ভড়কে দিলেন গৌতম গম্ভীরকে। প্রথমবার লাল বল হাতে নিয়ে গতিতে বারবার পরাস্ত করতে থাকলেন তার 'নায়ককে'। আর প্রতিবারই বললেন, 'দুঃখিত'। যাকে দেখতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন সিকিউরিটি গার্ডের কাছে, তাকে পরাস্ত হতে দেখে যেন হেরে যাচ্ছেন তিনি নিজে।
নবদ্বীপ তখনো জানতেন না তার কল্পনার দৈর্ঘ্য কত সীমাবদ্ধ। তার স্বপ্নের আকাশ ছোঁয়া যাবে কত সহজে। ছোটবেলায় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রচুর বাঘের সিনেমা দেখতেন। নিজে বাম হাতে সেরকম ট্যাটু করেছেন। তেমনই হুঙ্কার ছেড়ে করা গতির বলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গম্ভীর নিজে। তাতে নবদ্বীপের ভাগ্য বদলে গেলে মুহূর্তে, ক্রিকেট ম্যাচের মতো।
চিত্রনাট্যের বদলে কত সময় লাগে, সেটা টের পাওয়ার আগেই হয়তো নবদ্বীপ দেখলেন তিনি কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছেন। রঞ্জি দল দিল্লির অধিনায়ক তখন গম্ভীর, নির্বাচকদের কাছে সুপারিশ করলেন নবদ্বীপের নাম। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেলেন ২০১৩-১৪ রঞ্জি ট্রফিতে।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। লাগামহীনভাবে ছুঁটেছে তার সাফল্যের ঘোড়া। দিল্লির হয়ে রঞ্জির ফাইনাল খেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পেরিয়েছেন একশ উইকেটের মাইলফলক। প্রতিনিধিত্ব করেছেন ভারতের জাতীয় দলের হয়েও। সবখানেই রেখেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর।
যার সবশেষ উদাহরণ চলতি আইপিএলে। মঙ্গলবার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ম্যাচ গড়ালো সুপার ওভারে। অধিনায়ক বিরাট কোহলি ভরসা রাখলেন নবদ্বীপ সাইনির ওপর। তিনি প্রতিদান দিলেন মাত্র ৭ রান দিয়ে।
তাতে এবারের আইপিএলে দ্বিতীয় জয় পেয়ে গেল রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। কখনো ভারতের বয়স ভিত্তিক দলে না খেলা এক পেসারের কল্যাণে। জীবন এমনই। মাঝেমধ্যে চমকে দেয় খুব প্রবলভাবে। স্বপ্ন দেখা থামিয়ে দিলে, হাজির হয় কল্পনার সীমা ছাড়ানো এক সুন্দর বাস্তবতা নিয়ে।
আবার কখনো রঙিন বাস্তবতা দুঃস্বপ্ন হয়ে যায় মুহূর্তেই। নবদ্বীপ সাইনিই তো উদাহরণ প্রথম কথাটার। যিনি কখনো বয়সভিত্তিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেননি। ২০ বছর বয়স অবধি হাতে নেননি ক্রিকেট বলও। তিনি তাহলে কীভাবে চাপান কোটি তরুণের স্বপ্নের, লড়াইয়ের ভারতীয় জার্সি? এতো জীবনের প্রতিচ্ছবিই। মুহূর্তেই বদলে যাওয়া চিত্রনাট্য। কোনো রোমাঞ্চ ছড়ানো টেস্ট ম্যাচের মতো?