|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
দুই-একটি বছর নয়; সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকও পেরিয়ে যায় অপেক্ষায়। সুরাইয়া খানমের অপেক্ষা আর শেষ হয় না। ছোট ভাইয়ের জন্য বড় এই বোনের অপেক্ষা শেষ হয়নি আজও। ফিরে আসেননি আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন বাংলাদেশের এই সূর্য সন্তান।
হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগে শহীদ জুয়েলের জীবন ছিল ক্লাইমেক্সে ভরপুর। কখনও হাতে ক্রিকেট ব্যাট তো কখনও মেশিন গান। প্রিয় মাতৃভূমিকে হায়নাদের হাত থেকে মুক্ত করতে ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাইফেল-মেশিন গান। আজ এই শহর তো কাল আরেক শহরে। কিন্তু শেষ যে শহরে গেছেন শহীদ জুয়েল, সেখান থেকে ফেরেন না কেউ-ই। ফেরেননি তিনিও।
৪৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে বড় বোন সুরাইয়া খানমের। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি বছরের নিয়মিত আয়োজন বিজয় দিবস (শহীদ জুয়েল একাদশ বনাম শহীদ মুশতাক একাদশ) ম্যাচের দিন ছোট ভাইয়ের অনেক কথাই ক্রিকফ্রেঞ্জিকে জানালেন সুরাইয়া খানম।
ক্রিকফ্রেঞ্জির পাঠকদের জন্য সুরাইয়া খানমের পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ প্রতি বছর এমন আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনটা আপনাদের কাছে কেমন লাগে? কোন কোন স্মৃতিগুলো এখনও বেশি মনে পড়ে?
সুরাইয়া খানমঃ তারা এই দিনটাকে মনে রেখেছে, সারা বছর আর কোনো অনুষ্ঠান হয় না। খেলোয়াড় হিসেবে সে (জুয়েল) যুদ্ধ করেছে, এটা যে প্রতিবছর মনে করে এই জন্য আমরা ক্রিকেট বোর্ডের কাছে সন্তুষ্ট। ভালো লাগে, মনে হয় আমার ভাইরা হারিয়ে যায়নি। খেলার মাধ্যমে বছরে একবার স্মরণ করে।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনার সঙ্গে উনার ছেলেবেলা কেমন ছিল?
সুরাইয়াঃ আমরা পিঠাপিঠি ভাই-বোন। আমার পরই ওর জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই জুয়েল ক্রিকেট খেলতো (ব্যাট-বল)। এটাই ওর প্রাণ ছিল মনে হয়। আগের দিনে হরতাল হলে বাইরে যেতে পারতো না। তখন বাসার সামনে (টিকাটুলি যেখানে আমাদের বাসা ছিল) সেখানে ব্যাটিং করতো। আমাকে বলতো বোলিং করতে। একবারে ভালো তো পারতাম না। ও খেলতো, খেলাটাই ওর কাছে সবকিছু ছিল। তারপর মোহামেডান, আজাদ বয়েজ ক্লাবে খেলতো। আমরা দেখেছি জুয়েলের মুখ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল খেলা। পড়ালেখার চেয়ে খেলার প্রতি টান বেশি ছিল। যুদ্ধের সময় তো ভারত চলে গেল, ট্রেনিং নিলো। এরপর ঢাকায় এসে অনেকগুলো অপারেশন করে। প্রথম যখন ও ঢাকায় ফিরে বাড়িতে আসে, আমরা ওকে কেউ চিনতে পারিনি। লুঙ্গি পরা, দাড়ি হয়ে গেছে। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ (অস্ত্রসহ)। ও বেশি বাসায় থাকতো না। হয়তো মানা ছিল। মাঝে মধ্যে আসতো। অপারেশন করতো আবার ভারত চলে যেত। আবার আসতো এভাবে গেছে। ফার্মগেটে যে অপারেশনটা হয় সেটায় জুয়েল ছিল।
সেই অপারেশনে ৯-১০ জনের মতো (পাকিস্তানি আর্মি) মারা যায়। এরপর সে যখন বাসায় আসে কেমন যেন হয়ে গেছিলো। সে সময় আমরা বোনরা বাসায় ছিলাম। ও ভেবেছে যে আর্মিদের মেরেছি বাসায় রেইড পড়বে। আমাদের বাসাটা একটু ভিতরে ছিল, কিন্তু ওরা তো বের করবেই। খালি বলছিল আমাদের (বোনদের) দেশে পাঠিয়ে দাও, দেশে পাঠিয়ে দাও। আমরা গ্রামে (বিক্রমপুর) চলেও গিয়েছিলাম (বোনরা)। এই প্রথম ওকে একটু অন্যরকম দেখেছিলাম। এরপর ও যে খাটে ঘুমাতো সেখানে দেখি একটু উঁচু উঁচু। উঠিয়ে দেখি অস্ত্র। আরেকবার সে অনেকগুলো অস্ত্র নিয়ে আসে। আমাদের বাসায় অনেকগুলো ঘর ছিল, মাঝে যে ঘরটা ছিল সেখানে আমার বাবা-মা সারারাত পাহারা দিয়েছে (অস্ত্রগুলোকে)। এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। ও যেমন সাহসী ছিল, তেমন সৌখিনও ছিল। সব সময় সুন্দর ভাবে থাকতো। লেখাপড়া করত, জগন্নাথ থেকে বিএসসি পাশ করেছিল। পাশ করার পর ও চাকরি করেছিল কিছুদিন। সাত্তার গ্লাস ফ্যাক্টরি থেকে ওকে স্কলারশিপ দেয়া হয়েছিল। গ্লাস টেকনোলজি করার জন্য জুয়েলকে বিদেশে পাঠাবে। সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, কিন্তু তখনই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পরে আর যেতে পারেনি। চট্টগ্রামে আরেকটা চাকরি করেছিল (নাম মনে নেই)। কিন্তু ও সবসময় খেলাধুলা নিয়েই থাকতো।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ তিনি কখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে ভারত যাবেন? মাসটার কথা কি মনে আছে আপনার?
সুরাইয়াঃ ২৫শে মার্চ কালরাত্রির সময় মুশতাককে যখন মেরে ফেলা হয়, এরপরই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে যুদ্ধে নামবে। ভারত যাবে। আমাদের পারায় জুয়েলের যে বন্ধুবান্ধব (ফতেহ আলীসহ অনেকেই) ছিল ওরা সবাই আমাদের বাসায় এসে একটা সিঁড়ির মতো জায়গায় মিটিং করতো। আমরা বুঝতাম যে মিটিং করছে বা কবে যাবে। এর মধ্যে দুই একবার যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু যেতে পারেনি। শেষের দিকে গেছে। মে মাসের দিকে।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ সেখান থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন কবে?
সুরাইয়াঃ আমার নির্দিষ্ট তারিখ তো মনে নেই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার ১-২ মাস পরই সে দেশে ফিরে আসে।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ কোনো অপারেশন সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলেছিলেন?
সুরাইয়াঃ না, জুয়েল আমাদের এই ব্যাপারে কোনোদিন কিছু বলতো না। কোনো আলোচনা করতো না। যা আলোচনা হতো, সব আজাদদের বাসায় হতো। ওদের যে দলটা ছিল সেখানে। আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের বাসায় ওরা বৈঠক করতো। কিন্তু অপারেশন সম্পর্কে কখনো বাসায় কিছু বলতো না। কারণ একটা ভয় ছিলো।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ শহীদ জুয়েল তো আপনার ছোট ছিলেন, আপনার অনেক কাছেরও ছিলেন উনি। আপনি উনাকে সাহায্য করেছেন, যুদ্ধের সময়ের এমন কোনো স্মৃতি মনে আছে?
সুরাইয়াঃ না, তখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমি সিলেটে চলে গিয়েছিলাম। আমার ছোট বোনটাও অনেক ছোট। ওর এতো কিছু মনে নেই। আমার যে আর দুই বোন আছে ওরা বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল বাসায়।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ক্রিকেট নিয়ে উনার স্বপ্নটা কেমন ছিল?
সুরাইয়াঃ ওর সব সময় ইচ্ছে ছিলো বড় ক্রিকেটার হওয়ার। মাঝে মধ্যে সে করাচিতে গিয়েও খেলেছে। ওর ইচ্ছে ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার কিন্তু তখন বাংলাদেশিদের এতো সুযোগ দিতো না। সে সময় পাকিস্তানিরাই খেলতো। ওর অনেক আশা ছিল। ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিল। ভালো খেলতো, অনেক ভালো খেলতো। করাচিতে যখন খেলেছে, সেখানেও অনেক ভালো খেলেছে। সে সময় করাচির উর্দু পেপারগুলো আমদের বাসায় ছিল, ওখানে ওকে নিয়ে লিখা হয়েছিল। জুয়েলের অনেক আশা ছিল। যখন ওর হাতে গ্রেনেড ফেটে যায় (আশুগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের অপারেশনে) তখন ও আলমদের বাসায় ছিল। সেখানে ডাক্তার দেখতো ওকে। সেখানে চিকিৎসা হয়েছে ওর। সে তখন ডাক্তারকে বলতো, আমার হাতটা যে এমন হয়ে গেল আমি কি আর জীবনে খেলতে পারবো না। এই হাতটা দিয়ে খেলতে পারব কিনা।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ উনাকে ধরে নিয়ে গেল কীভাবে?
সুরাইয়াঃ জুয়েল, আলমদের বাসায় ছিল ইস্কাটনে। ওখান থেকে বের হয়েছে এটা বলে যে, অনেকদিন আম্মার সঙ্গে দেখা হয় না, একটু দেখা করে আসি। এটা বলে সে আবার আজাদদের বাসায় গেছে (মগবাজার)। ওখানে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো। ওইখানে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়, তখন আজাদের মা ওদের ওখানে থেকে যেতে বলে। ওইদিন ওরা সেখানে ফ্লোরিং করে থেকে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে। তখন রাজাকাররা খবর পেয়ে রেইড দিয়ে ওকে-ওদের ধরে নিয়ে যায়। এটা আগস্ট মাসে ছিল।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ উনাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটি আপনারা কীভাবে পেলেন?
সুরাইয়াঃ জুয়েলকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাতে রাখা হতো, সকাল ১০টার দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। এমপি হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে ওদের নির্যাতন করা হতো কথা বের করার জন্য। একদিন ভোরের দিকে ক্যাপ্টেন রোকসানার (প্লেন চালাতেন যিনি) বাবা রমনা থানায় গিয়ে ওকে দেখতে পায়। তখন সে বলে আমার বাবাকে একটু খবর দেবেন। আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে এসেই উনি আমার বাবাকে খবর দেন যে ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আব্বা অনেক চেষ্টা করেছেন ওকে ছাড়ানোর জন্য, অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছেন, কিন্তু পারেনি। ওকে রোজ নিয়ে যাওয়া হতো। তখন আবার আমি দেশে ছিলাম কিন্তু থাকতে পারছিলাম না।
খুব অস্থির লাগছিলো আমার। যেহেতু পিঠাপিঠি ভাই-বোন ছিলাম একটা টেলিপ্যাথিও কাজ করে। অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার তখন বিয়ে হয়েছে, একটা বাচ্চা আছে। গ্রাম থেকে লঞ্চে করে আসা যায়। আমার এক মামা আছে, আমি তাঁকে বললাম যে আমাকে লঞ্চে উঠিয়ে দিতে বা ঢাকায় দিয়ে আসতে। তখন সে আমাকে বলে যে এই গন্ডগোলের মধ্যে ঢাকা যাওয়া যাবে না। তখন আমি বলি আমাদের লঞ্চে উঠিয়ে দিতে। এরপর আমরা ঢাকা আসি। বাসায় এসে দেখি মা-বাবা কান্নাকাটি করছেন। বাবা কাঁদতেও পারছেন না ভালোভাবে। কারণ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, কাঁদলে আশেপাশে মানুষ আছে, এটাও তো জানাতে পারছে না। আব্বা প্রতিদিন সকাল বেলা উঠে রমনা থানায় যেতেন। সেখানে বাঙালি পুলিশরা জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতেন। ওর বাঁচার অনেক ইচ্ছা ছিল। আব্বাকে বলেছিল যে, চেষ্টা করেন আমাকে বাচাঁতে পারেন কিনা। আব্বা চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনি ঢাকায় আসেন কবে? আপনার বাবার সঙ্গে শহীদ জুয়েলের শেষ দেখা কবে হয়েছিল?
সুরাইয়াঃ আমি সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ ঢাকায় আসি, আব্বা তখন জুয়েলের সঙ্গে দুইবার দেখা করেছে। কিন্তু সেদিন বাবার সঙ্গে গিয়ে আমরা ওকে পাইনি। পুলিশরা বলেন যে জুয়েলকে নিয়ে গেছে আর আনেনি। হয়তো ওইদিনই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা তো নির্দিষ্ট তারিখটা জানি না, আশায় ছিলাম যে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানে। দেশ ভাগাভাগি হওয়ার পর সারা ক্যান্টনমেন্ট খুঁজেও ওকে বা ওর লাশ পাওয়া যায়নি। তাও আমরা আশা করেছি ও আসবে। অনেকের কাছে শুনেছি জাহাজে করে অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গেছে। আশা করেছি কোনোদিন হয়তো আসতে পারবে বা আসবে। অনেক বছর আমরা আশায় ছিলাম, যে জুয়েল আসবে।
জুয়েল আমাদের পরিবারের ভরসা ছিল। উঠতি বয়স ওর তখন। বাবা-মা ভেবেছিল ও চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে। কারণ বোনরা সব ছোট। জুয়েলের শোকে বাবা প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। অনেক দিন বিছানায় থেকে মারা যান তিনি। আম্মা কান্নাকাটি করে শোকটা কমিয়েছিলেন। কিন্তু আব্বা পারেননি। আমার মা এরপর অনেক কষ্ট করেছেন, বোনদের পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের একটা বাড়ি ছিল, ওই বাড়ির ভাড়া দিয়ে চলতো সব।
ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনাদের পরিবার বা আপনি এখন বাংলাদেশের খেলা দেখেন?
সুরাইয়াঃ প্রতিবছর তো এখানে আসি। এ ছাড়া দেখা হয়। এখানের চেয়ে টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখতে ভালো লাগে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে আসা হয়নি। টিকিট পাওয়া যায় না। বিসিবিকে বললে তখন হয়তো দেয়। দুই-একবার দিয়েছিলো। আমার মতে টিভিতে দেখলেই ভালো দেখা যায়। মাঠে দূর থেকে চেনাও যায় না, বোঝাও যায় না। টিভিতে ভালো বোঝা যায়।