|| দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ||
মহা ধুমধাম করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো।
জেমস, সনু নিগম, কৈশাল খের, সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফরা মঞ্চ মাতালেন। আতশবাঁজি পুড়লো। লেজার শো হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন ঘোষনা করলেন। কোথাও কোনো ঘাটতি ছিলো না।
তারপরও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএলে কোথায় যেনো একটা বিষাদের সুর। কোথায় যেনো একটা অভাব।
আন্দ্রে রাসেল অবশেষে সেই বিষাদের সুরটা ধরতে পারলেন। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রাজাই তো নেই। রাজার সিংহাসন পড়ে আছে, মুকুট পড়ে আছে, সেই রাজ্যে নতুন করে উৎসব শুরু হলো; কিন্তু আমাদের রাজা নেই।
হ্যা, সাকিব আল হাসান নেই!
সাকিব আল হাসানকে ছাড়া বিশ্বের কোথাও ক্রিকেট জমে না। এই বিশ্বকাপটার কথাই ধরুন না কেনো। কতো শত তারকা। বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, জো রুট, স্টিভেন স্মিথ, বেন স্টোকস। মনে হচ্ছিলো, এরাই বুঝি বিশ্বকাপটা আলোকিত করে রাখবেন। কিন্তু সেখানেও রাজা সাকিব।
ব্যাটে-বলে এমন পারফরম্যান্স করলেন যে, লোকে বলতে বাধ্য হলো, ২০১৯ বিশ্বকাপ আসলে সাকিব আল হাসানের বিশ্বকাপ।
শুধু কী এই বিশ্বকাপ?
আইপিএল, সিপিএল, ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি; দুনিয়ার কোন প্রান্তে সাকিবকে ছাড়া ক্রিকেট আলোকিত হয়? হয় না। বাংলাদেশে তো এটা আরও বেশী। সাকিব আল হাসান ছাড়া গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট যেনো অপরিচিত এক ব্যাপার। এই দেশটির সবচেয়ে বড় ক্রিকেটীয় ব্র্যান্ড সাকিব।
সাকিবকে ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় দলের হাল কতোটা শোচনীয়, সেটা সম্প্রতি শেষ হওয়া ভারত সফরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ব্যাটে, বলে কোথাও বাংলাদেশ এতোটুকু প্রতিরোধ গড়তে পারেনি ভারতের বিপক্ষে। অথচ এই ভারতীয়রাও কয়েক মাস আগে অবধি সব পরিকল্পনা করছিলো সাকিবকে আটকানো নিয়ে। কিন্তু সেই সাকিবই নেই।
সাকিবের না থাকাটা বিপিএলের অর্থে আরও ভয়ানক।
বিপিএলের শুরু থেকে এই খেলাটার সত্যিকারের রাজা তিনি। প্রতিটা আসরে সাকিবকে আলাদা করে চেনা গেছে। দু বার এই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। রেকর্ড সাক্ষী দেবে যে, বিপিএল আসলে সাকিব আল হাসানের টুর্নামেন্ট।
বিপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী, ৭৬টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড সাকিবের। এবার তাকে টপকে যাবেন মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফিরা অনেকেই। কিন্তু টপকানো সহজ হবে না সাকিবের রেকর্ড। ১০৬ উইকেট নিয়ে বিপিএলের ইতিহাসের সফলতম বোলার সাকিব। ৭৩ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন মাশরাফি।
শুধু তো উইকেটে নয়; রানের দিক থেকেও সাকিব আছেন সেরাদের কাতারে। এই টুর্নামেন্টে করেছেন ১৪৮৩ রান। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এবারের আগ পর্যন্ত সাকিবের চেয়ে বেশী রান আছে কেবল তিন জন ক্রিকেটারের-তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ।
এরকম সাকিবকে আমরা মিস করবো। এরকম সাকিবকে বিপিএল মিস করবে। রাসেল ঢাকায় পৌছেই সাকিবকে মিস করার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, ‘পুরো বিপিএল সাকিবকে মিস করছে, সে খুব ভালো খেলোয়াড়। স্মার্ট বোলার, দারুণ হিটার। দুর্দান্ত এক বিশ্বকাপ পার করে এল। এখনো সে টগবগে।’
অথচ সাকিবের কোনো ইনজুরি নেই, সাকিব ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দেননি। এখনও টগবগ করে বেড়াচ্ছেন; এখনও অনেক ক্রিকেট বাকী তার। তারপরও সাকিবকে এবারের বিপিএল শুধু নয়, এক বছরের জন্য সব ধরণের ক্রিকেট মিস করতে হচ্ছে সামান্য এক ভুলের জন্য।
একবার বিপিএল খেলা অবস্থায় তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো এক ভারতীয় বাজিকরের। আগারওয়াল নামের সেই বাজিকর সাকিবকে কয়েকবার ফিক্সিংয়ের ইঙ্গিত দিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন হোয়াটসঅ্যাপে। আইসিসির নিয়ম হলো, ফিক্সিংয়ের কোনো প্রস্তাব পেলে সাথে সাথে সেটা দেশের বা আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে জানাতে হবে। সেটাই করতে ভুল করেছেন সাকিব। তিন বার প্রস্তাব পেলেও তিনি জানাননি আকসুকে।
আর এসব নিয়েই তদন্তে নেমেছিলো আকসু। সেই তদন্তে অবশ্য দারুন সহায়তা করেছিলেন সাকিব। নিজের ফোনালাপ আকসুর হাতে তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সবই করেছেন।
এমনিতে আকসুর আইনে এই ভুলের শাস্তি আরও মারাত্মক। কিন্তু সাকিব সব ধরণের সহায়তা করায় তাকে দুই বছরের জন্য সব ধরণের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে আইসিসি। এর মধ্যে এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা। মানে, প্রথম বছরে নতুন কোনো অন্যায় না করলে এক বছরেই শেষ হবে নিষেধাজ্ঞা। সেই একটা বছর পার করছেন এখন সাকিব।
সাকিব এই এক বছর পার করছেন না; যেনো ঘন্টা গুনে গুনে সময় কাটছে বাংলাদেশের।
এই বাংলাদেশের একটি পাগল সাকিব ভক্ত প্রতিদিন ফেসবুকে ক্ষন গননা করেন, সাকিবের নিষেধাজ্ঞার কয়টা দিন গেলো। সেই সংখ্যা ধরে কিছু একটা লেখা লেখেন। সকলে প্রার্থনা করেন, দ্রুত যেনো কেটে যায় এই অন্ধকার সময়।
রাসেল নিজেও বলছিলেন, ‘আমিও এক বছর নিষেধাজ্ঞার মাঝে ছিলাম। কাজেই আসল জায়গায় নজর রেখে শক্তভাবে ফিরে আসার ব্যাপার মাত্র।’
সারা বাংলাদেশ এখন সেই সময়ের ব্যাপারের দিকে চেয়ে আছে। এবারের বিপিএলে হয়তো অনেক রানের উৎসব হবে, অনেক উইকেট শিকারের প্রতিযোগিতা দেখা যাবে। তার মধ্যে কিছু চোখ খুজে ফিরবে তাদের সাকিব আল হাসানকে। আর অপেক্ষা চলবে আগামী বিপিএলের; যখন রাজা আবার ফিরে এসে বুঝে নেবে নিজের সিংহাসনটা।