|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
কোচ কখনও চিরস্থায়ী নন। কোনো দলের দায়িত্ব নেয়ার পর গুরু-শিষ্যদের মধ্যে সম্পর্কটা যখন জোরালো হতে থাকে, তখন একটি সংবাদই যথেষ্ট সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে। চাপে পড়ে পদত্যাগ কিংবা ব্যর্থতার দায়ে বরখাস্ত। বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী কোচ স্টিভ রোডসের ক্ষেত্রে সেটি ‘মিচুয়্যাল সেপারেশন’। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় এই তৃতীয় টার্মটি প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশি কোচের কপালে জুটেছে। এর আগে যারা বাংলাদেশের কোচ হয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে কারোর বিদায় ছিল হুটহাট আবার কারো বিদায় ছিল অশ্রুসিক্ত।
এমনও কোচ ছিলেন, যার বিদায়ের পর মনে হয়েছে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তবে প্রায় সব কোচের বিদায়েই ছিল বিতর্ক। দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশকে ঠিক পথে রেখেও কোনো কোনো কোচ বিদায় নিয়েছেন মন ভার করে। বিতর্কিত বিদায় শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্ম লগ্নের সেরা কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে দিয়ে। ফিরে দেখা যাক গর্ডন গ্রিনিজ থেকে স্টিভ রোডস, কার বিদায় কীভাবে হয়েছে।.
গর্ডন গ্রিনিজ (১৯৯৬-৯৯)
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা কোচদের তালিকায় উপরের দিকে থাকবে গর্ডন গ্রিনিজের এর নাম। তাঁর হাত ধরেই ছোট্ট বাংলাদেশ ক্রিকেটে জয় পেতে শিখেছে। ১৯৯৬ সালে টাইগারদের দায়িত্ব নিয়েই বাজিমাত করেন ক্যারিবিয়ান এই কোচ। গ্রিনিজের তত্ত্বাবধানেই ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয় এবং পরের বছর প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে জেতে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে (১৯৯৯) অংশ নিয়েই স্কটল্যান্ড ও পরাশক্তি পাকিস্তানকে হারায় আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দল।
গ্রিনিজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এতোটাই অন্তঃপ্রাণ ছিলেন যে, কথিত আছে শুকাতে নিজের তোয়ালে নিয়ে নেমে পরেছিলেন মালয়েশিয়ার মাঠে। এই মানুষটির প্রস্থান হয়েছিল অত্যন্ত বাজেভাবে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর গৌরবের দিনে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অকৃতজ্ঞতার সেরা উদাহরণ দিয়ে একপ্রকার অপমান করে চুক্তি শেষ হওয়ার মাত্র একদিন আগে বিদায় দেয়া তাঁকে হয়েছিল।
গ্রিনিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস এতো দ্রুত চাননি তিনি। খেলোয়াড়দের মাঝে গ্রুপিং সৃষ্টি করাসহ আরও কিছু অজ্ঞাত অভিযোগ তোলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জেতার পর বাংলাদেশ সরকার গর্ডন গ্রিনিজকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গর্ডনকে দেওয়া হয়েছিল একটি পাসপোর্ট। এতোকিছুর পরও গ্রিনিজ পাসপোর্টটি ফেলে দেননি। বুক পকেটে রেখে দিয়েছিলেন যত্ন করে। সবকিছু ভুলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন ক্যারিবীয় এই কোচ। সেবার বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে ভিসা ছাড়াই টাইগারদের ডেরায় পা রেখেছিলেন গ্রিনিজ। গত বছর ঘটা করে তাকে সম্মাননা প্রদান করে সেই অপমানের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ব করেছে বিসিবি।
এডি বারলো (১৯৯৯-২০০০)
এডি বারলোর নিজ দক্ষিণ আফ্রিকা। বিদায়ের সময় তাঁর কান্নায় ভেঙে পড়া দেখে অনেকেই হয়তো বোঝেননি বাংলাদেশ তাঁর মাতৃভূমি নয়। পারফর্মেন্স, পরিসংখ্যানে বারলোর চেয়ে অনেক ভালো কোচ বাংলাদেশে এসেছেন, তবে বাংলাদেশ নিয়ে আবেগে তাকে কেউই ছাড়িয়ে যেতে পারেননি না।
বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। স্থায়ীভাবে থাকতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু হঠাৎ মস্তিকে রক্তক্ষরণ হয়ে হারিয়ে ফেলেন চলা ফেরা করার শক্তি। যখন বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলতে নামার শুভক্ষণে, বারলো তখন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে হুইল চেয়ারে সময় কাটাচ্ছিলেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট দেখেছেন হুইলচেয়ারে বসেই। ২০০১ সালে তাঁকে বিদায় দেয়া হয়।
ট্রেভর চ্যাপেল (২০০১-০২)
বিখ্যাত গ্রেগ চ্যাপেল ও ইয়ান চ্যাপেলের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল। খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তাঁর বাংলাদেশ ইনিংস। চ্যাপেলের কোচিং পদ্ধতি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বলা হয়, তাঁর আগমন বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোনো সুফল বয়ে আনেনি, বরং ক্ষতি হয়েছে। ছাত্রদের ভুলগুলো আড়াল করা, ভাষাগত সমস্যা, বুলবুল-আকরামদের মতো প্রতিভাবানদের দল থেকে বের করে দেয়ার কারণে তাঁর চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। দেশে ও দেশের বাইরের সিরিজে বাজে পারফরমেন্সের কারণে তাঁকে ছেড়ে দেয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
মহসিন কামাল-আলি জিয়া (২০০২-০৩)
বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ধ্বংস করতেই কি এসেছিলেন পাকিস্তানি ২ কোচ মহসিন কামাল ও তার বন্ধু আলী জিয়া? সেটা জানা যায়নি, তবে ব্যাটসম্যানদের শেখানো 'সোজা খেলো নীতি' ও টানা হতাশাজনক পারফরমেন্সে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে বিধ্বস্ত এক বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছিলেন এই দুই পাকিস্তানি। স্বাভাবিক নিয়মেই গিয়েছিল তাদের চাকুরি। তবে তাদের অস্বাভাবিক, প্রশ্নবিদ্ধ কোচিং পদ্ধতি নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল ওপেন সিক্রেট।
ডেভ হোয়াটমোর (২০০৩-২০০৭)
শ্রীলঙ্কাকে ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ডেভ হোয়াটমোর। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ। তিনি বাংলাদেশ দলের অনেক বড় বড় জয়ের সাক্ষী। ভাঙাচোরা একটি দলকে তিনি শক্তিশালী করে তুলেছিলেন নিজ হাতে। আনকোরা একটি দলকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিশ্ব দরবারে।
২০০৫ সালের শুরুতে এই অস্ট্রেলিয়ানের অধীনেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো টেস্ট ম্যাচ জেতে। ওই বছরই পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে হারায় বাংলাদেশ। যার ফলে গোটা ক্রিকেটবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। এ ছাড়াও ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতকে মতো দলকে হারিয়ে সুপার এইটে উঠেছিল হোয়াটমোরের বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের বিদায়ের পরপরই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
জেমি সিডন্স (২০০৭-১১)
জেমি সিডন্স বাংলাদেশের অন্যতম সফল একজন কোচ। তার অধীনে টাইগাররা অসাধারণ পারফরমেন্স করলেও বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্ব, প্রিয় খেলোয়াড়দের বাড়তি সুবিধা দেয়াসহ বোর্ডের নানা অসংগতির প্রতিবাদ করায় তাঁকে বিদায় করা হয়। বাংলাদেশকে সাফল্যের মন্ত্র পাইয়ে দেয়া এই কোচও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ার তাঁর চাকরি হারান। ২ বছর পর ব্যাটিং কোচ হিসেবে ফিরতে চাইলেও তাকে প্রত্যাখ্যান করে বিসিবি। এরপর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যেকোনো সময় বাংলাদেশের কোচ হয়ে ফিরতে রাজি তিনি।
স্টুয়ার্ট ল (২০১১-১২)
সিডন্সের বিদায়ের পর মাত্র ৩ মাস বাংলাদেশের কোচ ছিলেন স্টুয়ার্ট ল। সেই সময় টাইগারদের নিয়ম নীতিতে কড়া আইন জাড়ি ছিল ল'র। সেরা অলরাউন্ডার সাকিবকে বসিয়ে মুশফিককে অধিনায়ক করায় বিতর্কিত হন তিনি। ২০১৩ পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও 'পারিবারিক কারণ' দেখিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ান দেশে ফিরে যান। এরপর আর কোনোদিন বাংলাদেশে পা রাখেননি তিনি।
রিচার্ড পাইবাস (২০১২)
ইংলিশ বংশোদ্ভুত দক্ষিণ আফ্রিকান রিচার্ড পাইবাসের সঙ্গে বিসিবির কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল না। কোচ হয়ে বিসিবির বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তাই হঠাৎ করে চারমাস পর নিজ দেশে চলে যান। যদিও হাথুরুসিংহের বিদায়ের পর বাংলাদেশের কোচ হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন তিনি। বিসিবির পছন্দের তালিকায় থাকলেও খেলোয়াড়দের আপত্তির কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর কোচ হয়ে আসা হয়নি।
শেন জার্গেনসেন (২০১২-২০১৪)
স্টুয়ার্ট ল ও রিচার্ড পাইবাসের সহকারী হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর ২০১২ সালে টাইগারদের প্রধান কোচ করা হয় শেন জার্গেনসেনকে। তবে বোর্ডের প্রতি চাপা ক্ষোভ ও অভিমানে তিনিও বেশিদিন স্থায়ী হননি। বিসিবি তাকে রেখে দেয়ার কোনো চেষ্টা করেনি। কেন তাঁর চলে যাওয়া, সেটাও ভালো করে জানা যায়নি। তবে তার টুইটার, ফেসবুক ঘাটলেদেখা যায়, নিয়মিতই তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন। শীষ্যদের সাফল্যে আপ্লুত হন জার্গেনসেন।
চান্দিকা হাথুরুসিংহে (২০১৪-২০১৭)
২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন চান্দিকা হাথুরুসিংহে। বিসিবির সঙ্গে ৪৯ বছর বয়সী হাথুরুসিংহের চুক্তি ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর চলাকালীন তিনি বিসিবি সভাপতি বরাবর তার পদত্যাগপত্র পাঠান।
সিরিজ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তিনি সরাসরি চলে যান অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিদায় বলেন হাথুরুসিংহে। বিদায়কালে শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাকিব আল হাসানের টেস্ট সিরিজ না খেলাকে নিজের পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে নিজ দেশ শ্রীলঙ্কার প্রধান কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। সেখানেও সুখে নেই হাথুরুসিংহে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বোর্ডের সঙ্গে তাঁর ঝামেলার খবর প্রায় শিরোনাম হয়।
স্টিভ রোডস (২০১৮-২০১৯)
হাথুরুসিংহের বিদায়ের পর হন্যে হয়ে কোচ খুঁজছিল বিসিবি। বিসিবির পছন্দের কেউই বাংলাদেশের কোচ হতে রাজি হচ্ছিলেন না। এরপর 'ডিরেক্টর অব কোচেস' হিসেবে কোচ খোঁজার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতের বিশ্বকাপজয়ী কোচ গ্যারি কারস্টেনকে। তাঁর কাছে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন ফিল সিমন্স, রিচার্ড পাইবাস এবং স্টিভ রোডসরা। এই তিনজনের মধ্যে থেকে ইংলিশম্যান রোডসকেই যোগ্য মনে করেন কারস্টেন। তাঁর পরামর্শে রোডসকে কোচ করা হয়। বাংলাদেশে আসার আগে তার অভিজ্ঞতা ছিল কেবল ইংলিশ কাউন্টির দল উস্টারশায়ারের কোচ হিসেবে কাজ করা। জাতীয় দল বলতে ইংল্যান্ডের কোচিং স্টাফ ছিলেন। সেই দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশেও সফর করেছেন তিনি। জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল। নিজের সেরাটা দিয়ে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
রোডসের অধীনে বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফটাও উপরের দিকে ছিল। কোচ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের স্বাদ দিয়েছেন তিনি। তাঁর অধীনে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ দল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে দুইবার করে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে। এসব সাফল্যও তার চাকরি পোক্ত করেনি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার কারণে বিসিবির সঙ্গে পারষ্পরিক বোঝাপড়ায় দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। কথিত আছে সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে বেশ কিছু ম্যাচে পিচ নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, গেম প্ল্যান ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণেই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।