‘পরিশ্রমটাই শুধু আমার হাতে আছে’

ছবি: ক্রিকফ্রেঞ্জি

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||
বাংলাদেশেও অনার্স বোর্ড চান মিরাজ
১৫ ঘন্টা আগে
ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফর্মার নাঈম হাসান জাতীয় দলের হয়ে টেস্টেও শুরুটা করেছিলেন দারুণভাবে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে টেস্ট দলের নিয়মিত সদস্যও ছিলেন ডানহাতি এই অফ স্পিনার। তবে কয়েক বছরের ক্যারিয়ারে প্রায়শই ভুগতে হয়েছে চোটের কবলে পড়ে। চোট কাটিয়ে সবশেষ এনসিএলে স্পিনে বাজিমাত করেছিলেন নাঈম।
চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে ৩৬ উইকেট নেয়ার পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্ট সিরিজ দিয়ে আবারও বাংলাদেশ দলে ফেরেন তিনি। খেলেছেন কিউইদের বিপক্ষে দুই টেস্টেই। নিজের ফেরা, কঠিন সময়ের গল্প এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছেন ক্রিকফ্রেঞ্জিকে। একান্ত সাক্ষাৎকারে নাঈমের সঙ্গে কথা বলেছেন ক্রিকফ্রেঞ্জির প্রতিনিধি আবিদ মোহাম্মদ।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে অনেকদিন পর জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। নিজের ফেরাটা নিয়ে যদি কিছু বলতেন...
নাঈম: আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর চাওয়া ছিল... তাই জাতীয় দলে ফেরা হয়েছে। অনেকদিন পর ফিরেছি। তবে চেষ্টা ছিল অনেক, যখন শেষ সিরিজটা খেললাম তখনও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো হয়েছিল... মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ারও হয়েছিলাম। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল, আমি নিয়মিত অনুশীলনও করেছিলাম। সব সময় একটা প্রক্রিয়া মেনে চলার চেষ্টা করেছি। ভাবনা ছিল যে খেলাটা খেলব সেটা যেন ভালো হয়। ভালো খেললে জাতীয় দলের দরজা আবারও খুলে যাবে এটা বিশ্বাস ছিল। আল্লাহ সুযোগটা করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: জাতীয় দলের বাইরে থাকাটা তো কঠিন। আপনারও নিশ্চয় সেই সময়টা কঠিন ছিল। তখন কি ধরনের প্রক্রিয়া মেনে চলতেন?
নাঈম: সত্যি কথা বলতে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল, আল্লাহকে বলতাম। আমার যে কাজগুলো ছিল রুটিন, প্রতিদিন সকাল সকাল উঠে পরা, নামাজ পড়ে মাঠে যাওয়া... প্রতিদিন একই রুটিন মেনে চলেছি। আমার চিন্তা ছিল এটাই আমার কাজ। একইভাবে চলতে হবে। খাওয়া-দাওয়ায় অনেক পরিবর্তন এনেছি, আমার স্ত্রী আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। বিশেষ করে খাবারের ক্ষেত্রে।
আমি বাংলা টাইগার্সে ছিলাম, তখন আমার স্ত্রী প্রেগনেন্ট ছিল। কিন্তু তারপরও আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অনেক সচেতন ছিল সে। আমি সকালে ফজর পড়ে উঠে যেতাম, সেখান থেকে ক্যাম্পে যেতাম এরপর অনুশীলন শেষে জিম করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম... নামাজ পড়ে ঘুমায় যায়। এশার নামাজ শেষে এই ধরেন ৮টা থেকে ৯টার ভেতর আমি ঘুমায় যেতাম। আবার সকালে উঠে একই নিয়ম মেনে চলতাম, একই রুটিন এখন পর্যন্ত মেনে চলছি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিজের পরিবর্তনের কথা বললেন। কখন উপলব্ধি করলেন নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার কিংবা কিভাবে পরিবর্তনটা হলো
নাঈম: সত্যি বলতে কি... কাউকে অনুকরণ নয়। আমি ইসলামিক দিকে যেভাবে জীবন পরিচালনা করতে হয়, সেটাই আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছিলাম। নবীজি বলেছেন, ফজরে যে ব্যক্তি ওঠে নামাজ আদায় করে কাজে বের হয়ে যায় তার দিনে এমনিতেই বরকত থাকে। আমি যখন ফজরের সময় উঠি তখন এশার নামাজ পড়ে আর চোখ খোলা রাখা সম্ভব হয় না। মাগরিবের পর রাতের খাবার, এরপর এশার নামাজ তারপরই ঘুমিয়ে যাওয়া। এটাই মেনে চলছি, এরপর দেখলাম আমার খেলার দিকই নয়, সবদিক দিয়েই ভালো হচ্ছে। মাথাও খুব ভালো কাজ করে ফজরের সময় উঠলে।
আগে নামাজ পড়তাম, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া... দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া এতোকিছু মেনে চলতাম না আরকি। দিপু আর আমি রুমমেট ছিলাম, আমরা সেখানে সুন্দর মেনে চলেছি... এরকম প্রতিনিয়ত মেনে চলা হত না। এই ধরেন ২ মাস পর আবার খেই হারিয়ে ফেলতাম। আবার শুরু করতাম আবার আগের মতো হয়ে যেত। এখন এটা হয় না, বাংলা টাইগার্সের ক্যাম্পে যাওয়ার আগে শুরু করেছিলাম এরপর চার মাস যখন টানা করেছি দেখি আমার সবদিকে ভালো লাগতো, দুশ্চিন্তা থাকতো না। খুব ভালো লাগতো, মাথা ভালো কাজ করত... ফিটনেসেও ভালো হচ্ছিল।
আমার ওজন ৭৪ কেজি এখন, শরীরের চাহিদা অনুযায়ী আমার প্রোটিন নিতে হয় ১৫০ গ্রাম। দেখা যেত আমি অনেক সময় প্রোটিন কম নিচ্ছি কিন্তু অনুশীলন করছি, পরিশ্রম করছি কিন্তু শরীরে সেটা লাগছে না। আবার দেখা যায় কার্বহাইড্রেড নিচ্ছি বেশি, পেট ভরানোর জন্য। এরপর একজন নিউট্রশনিস্ট আমাকে একটা রুটিন দেয় সেখানে এসব হিসেব করে দেয়া আছে। এটাই মেনে চলছি, লাভও হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার এই পরিবর্তনটা এনেছি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: সামনে হয়ত আরও প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। আগে হয়ত হতাশ হতেন এখন তো মনে হয় এমন হবে না। সবগুলো ব্যাপারই ইতিবাচক থাকবে..

নাঈম: রিজিকের মালিক তো আল্লাহ, যা আছে কপালে তাই হবে। কিন্তু আমার হাতে আছে পরিশ্রম। আমার লক্ষ্য অনুযায়ী আমি পরিশ্রম করতে থাকব। চেষ্টা থাকবে দেশের হয়ে বড় কিছু করার। সামনে যে সুযোগই আসুক না কেন তা যেন কাজে লাগাতে পারি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিজের লক্ষ্যের কথা বললেন? আপনার লক্ষ্যটা আসলে কি? ৩০০-৪০০ উইকেট নিতে চান, এমন কিছু?
নাঈম: সবার তো ইচ্ছা থাকে বিশ্বমানের খেলোয়াড় হওয়ার। এখন তো একেবারে তা হতে পারব না। ছোট ছোট করে আমাকে এগোতে হবে। আমার লক্ষ্য থাকবে হলো দলের জন্য ম্যাচ জেতা বা দলের যা প্রয়োজন তা পূরণ করা। চাইলেই তো ৩০০-৫০০ উইকেটের চিন্তা এখনই করতে পারব না, এটা নিজের ওপরই চাপ তৈরি করবে।
এখন আমার চেষ্টা প্রক্রিয়া মেনে চলা আর যখন খেলা আসবে দলের যা প্রয়োজন তা অনুযায়ী খেলা। দেখা যায় আমরা চিন্তা করি এই ম্যাচে ১০ উইকেট নিতে হবে বা অনেক বড় কিছু করতে হবে... এরকম চিন্তা করলে আসলে হয় না। প্রক্রিয়া মেনে চললে হওয়ার থাকলে এমনেই হবে। প্রক্রিয়া মেনে চললে হওয়ার থাকলে এমনেই হবে। এত বড় চিন্তা করলে প্রক্রিয়া মেনে চলা কঠিন হয়ে যায়। তখন আমরা ওইদিকেই ছুটি, প্রক্রিয়া আর মানা হয় না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: ১০ বছর আগের কথা চিন্তা করলে ক্রিকেটাররা এত বেশি প্রক্রিয়ার কথা বলতো না। কিন্তু এখন প্রায় সবাই এই কথাটা বলে। আপনারা নিজেরা কিভাবে এটার সঙ্গে আসলে পরিচিত হলেন কিংবা নিজেদের মাঝে প্রক্রিয়ার বিষয়টি ঢোকালেন?
নাঈম: তারাও একটা প্রক্রিয়া মেনে চলতো। একেকজনের প্রক্রিয়া একেক রকম। প্রক্রিয়া মেনে চলা ছাড়া তো তারা ম্যাচ খেলতো না। তাহলে ওরা উইকেট কেমনে নিতো? তাদের পরিকল্পনা থাকতো নিশ্চই। এখন যারা ক্রিকেট খেলতেছে তারা প্রক্রিয়াটা এক রকম রাখে। কার প্রক্রিয়াটা কি সে জানে এবং তা মেনে চলে। আগেও প্রক্রিয়া মেনে চলতো কিন্তু তখন আমরা শুধু পারফরম্যান্স দেখতাম। প্রক্রিয়া মেনে চলা ছাড়া ভালো খেলা সম্ভব না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নিয়মিত টেস্ট খেললেও গেল কয়েক বছরে খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ হয়নি আপনার...
নাঈম: যখন করোনার পর খেলা শুরু হয় তখন শুরু করতে না করতেই আমার ইনজুরি হয়। সেটায় আমি অনেক ভুগেছি, অস্ত্রোপচার হয়, কোনভাবে সেটা ঠিক মতো হচ্ছিলো না। এটার জন্য অনেক ভুগতে হয়েছিল, অনেক চিকিৎসার পর আল্লাহর রহমতে ভালো হয়। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিরলাম, আবার আঙুল ভেঙে যায়। চোট নিয়েই বেশিরভাগ সময় ভুগতে হয়েছে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিউজিল্যান্ডে বিপক্ষে নিজের ফেরার সিরিজে পারফরম্যান্সে কতটা সন্তুষ্ট?
নাঈম: আমার চেষ্টা একটাই দলের জন্য যা করা যায় তাতেই আমার সাফল্য। ঢাকা টেস্টে যদি আরও ২/১ টা উইকেট বের করতে পারতাম দ্বিতীয় ইনিংসে তাহলে ম্যাচ জিতে যেতে পারতাম। যদিও বোলিং বেশি করা লাগেনি। তবে ম্যাচটা জিততে পারলে আরও বেশি ভালো লাগত।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এবারের এনসিএলটা আপনার বেশ ভালো গেছে। মাথায় কি এমনটা ছিল যে এনসিএলে ভালো করতে পারলে জাতীয় দলে সুযোগ পাব আবার...
নাঈম: জাতীয় দলে ডাক পাব এমন কোন ভাবনা ছিল না, আমার চেষ্টা ছিল যেখানেই খেলি না কেন ভালো খেলার। যদি জাতীয় দলে ফেরার ভাবনা মাথায় নিয়ে খেলতাম তাহলে আরও বেশী চাপে পড়ে যেতাম। তখন ঐযে প্রক্রিয়াটা মেনে চলা হত না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এবার তো হ্যাটট্রিকও করেছিলেন। সেটা নিয়ে যদি কিছু বলতেন...
নাঈম: কোন পরিকল্পনা ছিল না, একদম সিম্পল বোলিং করেছি... হয়ে গিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ...।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনাকে হয়ত এখন টেস্টে বেশি বিবেচনা করা হয়। আপনি কি অন্য দুই সংস্করণ নিয়ে ভাবছেন?
নাঈম: আমার চিন্তা ভাবনা আছে, সামনে বিপিএল আছে। যদি সুযোগ আছে তখন নিজের শতভাগ দিব ইনশাআল্লাহ। আমি আগেও কয়েকটা ওয়ানডে সিরিজের স্কোয়াডে ছিলাম কিন্তু অভিষেক হয়নি। ২০১৯ বিশ্বকাপের স্ট্যান্ড বাই ছিলাম। সবাই আসলে দিনে দিনে উন্নতির চেষ্টা করে, চিন্তা করে। আমিও তাই করছি। দেখি সামনে আল্লাহ কি রেখেছেন, উনার চেয়ে ভালো তো কেউ পরিকল্পনা করতে পারেন না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: সব ক্রিকেটারের তো একজন আইডল থাকে। আপনি কাউকে অনুসরণ করতেন?
নাঈম: শুরুতে তো নাথান লায়নকে অনুকরণ করতাম। সাকিব ভাইকেও খুব কাছ থেকে দেখেছি, উনি ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে নিজেকে যেভাবে তৈরি করেছিলেন ওইটা দেখে অনেক কিছু বুঝেছি। মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাইরা ইসলামিক দিক দিয়ে অনেক কিছু মেনে চলেন, এটাও চাই ওনাদের মতো মেনে যেন চলি।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি বাংলাদেশের নাথান লায়ন হয়ে উঠতে চান কিনা.. তার কাছাকাছি যেতে চান কিনা?
নাঈম: সবারই তো ইচ্ছা থাকে বড় খেলোয়াড় হওয়ার। ওরা তো বিশ্বমানের, এখন ভালো খেললে তো ওদের কাছাকাছি যাওয়ার তো ইচ্ছে আছেই।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশের হয়ে যখন খেলেন তখন আপনাকে মিরাজের সঙ্গে জুটি বেঁধে বল করতে দেখা যায়। আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা করেন কিনা...
নাঈম: তাইজুল ভাই, মিরাজ ভাই, মুশফিক ভাই, শান্ত ভাই এরা সবাই অনেক সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে বলতে হলে চট্টগ্রামের অধিনাক মুমিনুল ভাইর কথা বলতেই হয়। উনি অনেক অনেক বেশি সাহায্য করেছেন। এনসিএলে থাকতেন, উনি না থাকলে আমার জন্য সব এতো সহজ হত না। উনার পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা.. উনাকে পেয়ে আমার অনেক উপকার হয়েছে।
উনি অনেক সাহায্য করেন। বিশেষ করে পরিকল্পনা করতে বা কিভাবে কি করতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। শুধু আমিই না, দলের সবাই। ম্যাচ জেতার জন্য অনেক ক্ষুধার্ত থাকেন। খেলা নিয়ে ভাবেন, আগামী দিন কি করব তা নিয়ে আলোচনা করেন। আমাদের অনেক কিছু উনি পরিবর্তন করেছেন। ব্যাটিং নিয়েও অনেক সাহায্য করছেন।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: ব্যাটিংয়েও কি আলাদা করে কাজ করতেছেন?
নাঈম: হ্যাঁ, ব্যাটিংয়েও মনোযোগ দিচ্ছি। বাংলা টাইগার্স ক্যাম্পে ব্যাটিংয়ে অনেক অনুশীলন করিয়েছে। ব্যাটারদের সাথে ব্যাটিং করিয়েছে, বাবুল স্যার, সোহেল স্যার...উনারা অনেক হেল্প করেছেন। টাইগার্স ক্যাম্পে অনেক সাহায্য পেয়েছি, এই ক্যাম্পটা আমার অনেক কাজে এসেছে।
মাঝে জাতীয় দলে ঢুকার আগে হেরাথও আমাকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমি ৭দিনের মতো অনুশীলন করি, বোলিং নিয়ে কাজ করেছে। টিমের সঙ্গে আমাকে রাখতো হেরাথ, অনেক কাজ করেছে আমাকে নিয়ে। কিছু কিছু ভ্যারিয়েশন চেষ্টা করছি। দিনে দিনে কিভাবে আরও উন্নতি করা যায় সেটাই করার চেষ্টা করছি।