এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা-চারে যাদের ব্যাটে আলোর ছোঁয়া
ছবি: ব্যাটিংয়ে এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে সেরা পাঁচ, ক্রিকফ্রেঞ্জি
জীবন, খেলা কিংবা লড়াইয়ে জয়ই তো শেষ কথা। তবে এসবের বাইরে গিয়ে সমর্থকরা যেন আক্ষেপের মাঝিবিহীন নৌকায় ভেসে বেড়ান। বিদেশির ভীড়ে ঘরোয়া কিংবা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিজেদের প্রমাণের সুযোগ না পাওয়াই সমর্থকদের এমন হতাশার কারণ। পুরোপুরি স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে আয়োজিত জাতীয় ক্রিকেট লিগ টি-টোয়েন্টি তাই আড়ালে থাকাদের জন্য নিজেদের প্রমাণের, মেলে ধরার কিংবা জড়তা কাটিয়ে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর মঞ্চ। অভিজ্ঞরা ব্যাটে-বলে যেমন পারফর্ম করেছেন, তেমনি পাল্লা দিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই জমিয়েছেন তরুণরাও।
৮ দল, ১৪ দিন এবং ৩২ ম্যাচের এনসিএল টি-টোয়েন্টি শেষে চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ঘরে তুলেছে রংপুর বিভাগ। আকবর আলী, আলাউদ্দিন বাবু, মুকিদুল ইসলামরা নিজেদের সবটা উজার করে দিয়েছেন রংপুরের জন্য। রানার্স আপ হওয়া ঢাকা মেট্রোর উত্থানের পেছনের চরিত্রগুলো নাইম শেখ, আবু হায়দার রনি, রাকিবুল হাসানরা। তবে টুর্নামেন্ট শেষে দেখা নেয়া যাক এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে আলো ছড়ানো ব্যাটার ও বোলারদের পারফরম্যান্স।
ব্যাটার নাইমের অধিনায়কত্বেও ছক্কা
এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে সেরা ব্যাটার হয়েছেন নাইম শেখ, ক্রিকফ্রেঞ্জি
বিপিএলের সবশেষ আসরে দুর্দান্ত ঢাকার হয়ে ৩১০ রান করেছিলেন নাইম। ২৫.৮৩ গড় ও ১১৯.৬৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা বাঁহাতি ব্যাটার হাফ সেঞ্চুরিও পেয়েছিলেন দুটি। তবে তাকে নিয়ে যেন খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে পারছিলেন না সমর্থকরা। সবশেষ প্রথম শ্রেণির এনসিএলে প্রত্যাশা মেটাতে না পারায় হতাশা বেড়েছিল আরও খানিকটা। তবে মাসখানেকের ব্যবধানে পুরো দৃশ্যপট বদলে ফেলেছেন নাইম। ২০১০ সালের পর প্রথমবার হওয়া এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে নিজের জমিয়ে রাখা পারফরম্যান্সটা সামনে এনেছেন ঢাকা মেট্রোর জার্সিতে।
১০ ম্যাচে ৩১.৬০ গড় ও ১৩৫.০৪ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩১৬ রান। বাঁহাতি ওপেনারের চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি আর কোন ব্যাটার। প্রায় বছরখানেকের ব্যবধানে নাইমের পারফরম্যান্সে স্পষ্ট গড় ও স্ট্রাইক রেটের উন্নতি। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ১১ ছক্কার সঙ্গে মেরেছেন ৩৫ চার। ছয়ে একটু পিছিয়ে থাকলেও চারের বেলায় নাইমের ধারেকাছে নেই কেউ। দুইয়ে থাকা হাবিবুর রহমান সোহান মেরেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ চার। ব্যাটার নাইম আলো ছড়িয়েছেন নেতৃত্ব গুনেও।
২০ ওভারের টুর্নামেন্টের আগে মিরপুরে ট্রফি উন্মোচন ও সিলেটে ক্যাপ্টেনস মিটের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যেখানে কালো ও লালের মিশেলে বানানো জার্সিতে মেট্রোর প্রতিনিধি ছিলেন নাইম। বাঁহাতি এই ব্যাটারের অধিনায়ক হওয়ার খবরে অনেকে খানিকটা হচকিয়ে গিয়েছিলেন। তবে বোলিং পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানো কিংবা লিডারশিপে বেশিরভাগ সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করেছেন তিনি। ব্যাটে যেমন পারফর্ম করেছেন, অধিনায়কত্বেও তেমনি ছক্কা মেরে মেট্রোকে ফাইনালে তুলেছিলেন।
জিসানের ছক্কার ঝড়ে বল উড়ে
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই যেন বাংলাদেশের একরাশ হতাশা। মারকুটে ব্যাটিংয়ে সেই গ্লানি মুছে দিতে পারেন তরুণরা। এমন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারকে আলোর পরশ দিতে বিসিবির প্রচেষ্টা এনসিএল টি-টোয়েন্টি। বিসিবি যা চেয়েছিল জিসান আলম যেন সেটাই করে দেখিয়েছেন। টুর্নামেন্টের প্রথম দিনেই চা বাগানের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সিলেট স্টেডিয়ামে ছক্কার বৃষ্টি নামিয়েছিলেন তরুণ এই ওপেনার। সিলেট বিভাগের হয়ে ৫৩ বলে করেছিলেন ১০০ রান। শুরুটা সেঞ্চুরি দিয়ে করা জিসান শেষ করেছিলেন রাজশাহীর বিপক্ষে ৩২ বলে ৬০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ছক্কায় সবার উপরে জিসান আলম, ক্রিকফ্রেঞ্জি
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দাপুটে ব্যাটিংয়ে ৪০.১৪ গড় ও ১৫৮.৭৬ স্ট্রাইক রেটে করেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮১ রান। এক সেঞ্চুরির সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরিও পেয়েছেন দুটি। এনসিএল টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বেশি ২৬ ছক্কা এসেছে জিসানের ব্যাট থেকেই। দুইয়ে থাকা সোহান সমান ম্যাচে মেরেছেন ১৭ ছক্কা। ঘরোয়াতে আলো ছড়িয়ে বিপিএলের প্রস্তুতিটা বেশ ভালোভাবেই সেরেছেন তিনি। বিপিএলে দুর্বার রাজশাহীর জার্সিতে ছন্দ ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতের ভাবনায় জিসানকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতেই পারেন সমর্থকরা।
ঘরোয়ায় নুরুল হাসান সোহানের দৌড় চলছেই
উইকেটকিপার হিসেবে সবসময়ই সবার পছন্দের শীর্ষে নুরুল হাসান সোহান। তবে ‘ফিনিশার’ সোহানের ব্যাটিং নিয়ে আছে খানিকটা সমালোচনা। ২০২২ সালের নভেম্বরের পর থেকেই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে নেই ডানহাতি এই ব্যাটার। সবশেষ কয়েক মৌসুমে বিপিএল কিংবা অন্য সংস্করণের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্মারদের একজন তিনি। তবুও জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়তে পারেন না সোহান। এনসিএল টি-টোয়েন্টি তাই সোহানের জন্য আবারও প্রমাণের মঞ্চ, জাতীয় দলে ফেরার চাবিকাঠি।
গ্লোবাল সুপার লিগে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারা সোহান অবশ্য এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৮ ম্যাচে ৫৩.৩০ গড় ও ১২৬.০৭ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ২৬৬ রান। খুলনার টপ অর্ডারদের ব্যর্থতায় সত্যিকারের ফিনিশার অবশ্য হয়ে উঠতে পারেননি সোহান। একটা হাফ সেঞ্চুরি, ২০টা চার ও ১০টা ছক্কায় টুর্নামেন্ট শেষ করেছেন তিনি। তবে ভূমিকাটা যেহেতু ফিনিশার ডানহাতি ব্যাটারকে মনোযোগ দিতে হবে স্ট্রাইক রেটে। সেটা করতে পারলেই সোহানের ঘরোয়ার দৌড়ে চলতে পারে জাতীয় দল পর্যন্তও।
স্বপ্নের পরিধি বাড়িয়ে বিপিএলের মঞ্চে হাবিবুর
আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছেন হাবিবুর রহমান সোহান, ক্রিকফ্রেঞ্জি
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যেমন মারকুটে, হার্ড হিটিং ব্যাটিং চাই হাবিবুর রহমান সোহান যেন সেটারই প্রতিচ্ছবি। তবে চার-ছক্কায় পটু তরুণ এই ব্যাটারের সমস্যাটা ধারাবাহিকতায়। বিপিএলের সবশেষ মৌসুমে খুলনা টাইগার্সের হয়ে নিজের ছক্কা মারার স্কিলটা জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে সেটা আরও খানিকটা জ্বলজ্বল করে জ্বালিয়েছেন তরুণ এই ওপেনার। ৭ ম্যাচে ২৬ চারের সঙ্গে মেরেছেন ১৭ ছক্কা। তাঁর চেয়ে বেশি ছক্কা আছে কেবল জিসানের।
টপ অর্ডার ব্যাটার হিসেবে যেমন স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং চাওয়া সেটাই যেন করেছেন হাবিবুর। ১৬০.৮৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা হাবিবুর ৩৭ গড়ে করেছেন ২৫৯ রান। দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটারদের তালিকায় আছেন চারে। ঢাকা ক্যাপিটালসের হয়ে বিপিএল খেলতে নামার আগে নিজের কিংবা সমর্থকদের স্বপ্নের পরিধিটা বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বিপিএলে ভালো করতে না পারলেও নিজের স্বপ্নের আরও একটু কাছে যাওয়ার কিংবা ছুঁয়ে দেখার সুযোগও মিলতে পারে হাবিবুরের।
যুব এশিয়া কাপ টু বিপিএল, ভায়া এনসিএল টি-টোয়েন্টি
এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে আলো ছড়িয়ে বিপিএলে আজিজুল হক তামিম, ক্রিকফ্রেঞ্জি
বাংলাদেশের কোন ঘরোয়া টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটারদের তালিকায় তামিমের নামটা থাকবে সেটা তো বোধহয় অবধারিতই। তবে পুরো নামটা যদি আজিজুল হক তামিম হয় তাহলে তো বোধহয় আপনি একটুখানি হচকিয়ে যাওয়ারই কথা। সেরা পাঁচের শেষের ব্যাটার এমন একজন যাকে হয়ত কেউ প্রত্যাশাই করেনি। প্রথমবার স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমেই নিজের জাত চিনিয়েছেন।
সবশেষ যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন আজিজুল। অধিনায়কত্বেও দেখিয়েছিলেন মুন্সিয়ানা। এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে অবশ্য অধিনায়ক হয়ে নামতে হয়নি। তরুণ বাঁহাতি ব্যাটারের কাজটা ছিল শুধুই রান করা। এনামুল হক বিজয়, ইমরুল কায়েস, মোহাম্মদ মিঠুন, নুরুল হাসান সোহানদের মতো তারকাদের ভীড়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠেছেন আপন মহিমায়। খুলনার হয়ে পুরো টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে ২৩৭ রান করেছেন আজিজুল।
২২.৮০ গড়ে রান তোলা এই তরুণ ব্যাটিং করেছেন ১৩৫.৭১ স্ট্রাইক রেটে। ধারাবাহিকতার ছাপ রেখে বিপিএলে দলও পেয়েছেন তিনি। খেলবেন ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন রংপুরের হয়ে। কদিন আগে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় চোটে পড়েছেন সৌম্য সরকার। টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে তাই ম্যাচ পাওয়ার নিশ্চয়তাও পাচ্ছেন আজিজুল। সেটা কাজে লাগাতে পারলেই সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে তাঁর।