সাক্ষাৎকার

আফ্রিদি ছয় মারতো, আমিও মারতাম: সাব্বির

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
Publish Date: 16:16 Monday, April 20, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির গোটা দেশ। সকল ধরণের টুর্নামেন্ট বন্ধ থাকায় অখন্ড অবসর পেয়েছেন ক্রিকেটাররা। অবসরের এই সময়টা কেউ জিম করে কিংবা মুভি দেখে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন। অন্যান্যদের মতো অফুরন্ত অবসর পেয়েছেন জাতীয় দলের হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমানও। সম্প্রতি ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ২৮ বছর বয়সী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। যেখানে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের নানা দিক সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ করোনা পরিস্থিতিতে জনজীবন অচল, মাঠের খেলা বন্ধ। হুট করেই সবার জীবন বদলে যাওয়ার এই সময়টাকে কিভাবে দেখছেন?

সাব্বির রহমানঃ জীবনটা তো আসলে এতো সহজ নয়, বিশেষ করে খেলোয়াড়দের জন্য। আমরা মাঠের মানুষ, মাঠেই থাকি কিন্তু এই মুহূর্তে খেলছে পারছি না। সবাইকে বাসাতেই থাকতে হচ্ছে। আবার এখানে একটা ইতিবাচক দিক আছে। সেটা হলো, আমাদের এই পেশাতে পরিবারকে সময় দিতে পারি না। খুব সহজে এমন সময় পাওয়া যায় না। এটা একটা দিক যে একসঙ্গে সবাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, পরিবারকে সময় দিচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। 

ক্রিকফেঞ্জিঃ এই পরিস্থিতিতে ফিটনেস ধরে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে ফিট রাখতে কি করছেন? 

সাব্বিরঃ ফিটনেস ধরে রাখতে বা ঠিক রাখতে বাসায় যতটুকু সম্ভব হচ্ছে করছি। সাইক্লিং করছি, পুশ আপ দিচ্ছি বা ডাম্বেল আছে সেগুলা দিয়ে ব্যায়াম করছি। সুযোগ পেলে সিড়ির ওপরে রানিং করছি। এভাবেই নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিসিবির ট্রেইনাররা আমাদের পার্সোনালিভাবে যেভাবে ট্রেইন করতো ওইভাবেই চেষ্টা করছি, সেগুলা ফলো করছি।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ৬ মাসের বেশি হয়ে গেছে জাতীয় দলের বাইরে আছেন। দলে ফিরতে কতটুকু মরিয়া হয়ে আছেন? 

সাব্বিরঃ জাতীয় দলে ফেরার জন্য তো অবশ্যই চেষ্টা করছি। তবে একটা জিনিস হলো একজন ক্রিকেটার যখন সবকিছু থেকে ব্রেক পায় তখন এই বিষয়টি অনেক ইতিবাচক ভাবে কাজে আসে। এই কঠিন সময়গুলোতে অনেক কিছু বোঝা যায়। নিজের আবেগ, মানসিকতা কিংবা ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অনেক গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার একটা সময় পাওয়া যায়। জীবনটাকে আরও সুন্দরভাবে কিভাবে গোছানো যায় সেটা নিয়েও পরিকল্পনা করা যায়। বিরতিটা আমাকে সাহায্য করছে পরবর্তী ১০ বছর নিয়ে ভাবার, আমি কি চাই, জীবনকে কোথায় নিতে চাই এসব পরিকল্পনা করার। বিষয়টাকে সম্পূর্ণ ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছি। প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় লিগে খেললে আবারও ফিরে আসার সুযোগ পাবো।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এবারের প্রিমিয়ার লিগটা আপনার জন্য বড় একটা সুযোগ ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে এক রাউন্ড পরই খেলা স্থগিত হয়ে গেল। ফেরার সুযোগটা কি হাতছাড়া হয়ে গেল?

সাব্বিরঃ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম। স্থগিত হওয়ায় বড় ক্ষতিটা আমারই হয়েছে। সুযোগ ছিল জাতীয় দলে ফেরার। তবে একটা ইতিবাচক ব্যাপার হলো, আমি সহ কেউই খেলতে পারছে না। কারণ আমি যে পজিশনে ব্যাটিং করতে চাই সেই জায়াগটা জাতীয় দলে খালিই আছে বা সেখানে জায়গাটা ফিরে পাওয়ার সুযোগ আছে। তাই এটা একটা ইতিবাচক দিক বলতেই হবে ব্যক্তিগতভাবে যদি চিন্তা করি। সামনে যে টুর্নামেন্টই হোক সেখানে এই সুযোগটুকু কাজে লাগানোর জন্য নিজের শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করব।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা একেবারে পাকা করতে না পারার আক্ষেপটা কতটুকু?

সাব্বিরঃ এখানে আমার নিজের দোষ আছে। কারণ অনেক ইনিংস বড় করতে পারিনি। সুযোগ পেয়ে ফেলে দিয়ে এসেছি। আবেগ নিয়ে খেলেছি, অপরিপক্ব ছিলাম, অনেক কিছু বুঝতে পারিনি। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছি। এখন চেষ্টা করি পরিস্থিতি বোঝার, সেভাবেই খেলতে। তখন যদি এভাবে চলতাম জাতীয় দলে হয়তো পাকাপোক্ত জায়গা থাকতো আমার। ওই যে বললাম যদি বড় জায়গায় যেতে চান তাহলে আপনার একটা বিরতি প্রয়োজন। সেটা পেয়েছি, এখন সামনের দিকে শুধু এগিয়ে যেতে চাই। নিজের ভবিষ্যত নিজের হাতে, সবকিছু নিজেকেই গড়তে হবে। এটা শিখেছি, এখন সামনে সুযোগের অপেক্ষায় আছি। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ হার্ড হিটিংয়ের জন্য কাকে ফলো করতেন? কোনো সময় মনে হয়েছিলো যে আমি একজন হার্ড হিটিং ব্যাটসম্যান হবো?

সাব্বিরঃ আমি যে হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান হবো এটা কোনো দিন চিন্তাই করিনি। ফলো করি আফ্রিদিকে, ও ছয় মারতো, আমিও ছয় মারতাম। সব সময় চেষ্টা করতাম ছক্কা হাঁকানোর। মনে আছে যখন ছোট ছিলাম তখন আমি বড় শট খেলতে পারতাম না। আমাকে খেলতেও নিতো না। এমনকি টেনিস বলেও মারতে পারতাম না। একদিন আচমকা টেনিস বলে ছয় বলে ছয় ছক্কা মেরে বসছিলাম। ওইখান থেকেই আত্মবিশ্বাস বাড়ে, যে আমিও ছয় মারতে পারি। সেখান থেকেই মনে হয়েছে যে আমি হার্ড হিটার হতে পারবো। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনার ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো পজিশন পাননি। একেক সময় একেক পজিশনে খেলতে হয়েছে। এই বিষয়টি কি নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছিল আপনার জন্য? ব্যক্তিগতভাবে কোন পজিশনে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

সাব্বিরঃ আমি যে কোয়ালিটির ব্যাটসম্যান বা যেভাবে আমি খেলি আমার সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যকর পজিশন হচ্ছে তিন নম্বর কিংবা ছয় বা সাত। অনেক সময় ম্যানেজম্যান্টের সিদ্ধান্তের কারণে আমার ওপর-নীচে একেক পজিশনে খেলতে হয়েছে। কিছু সিদ্ধান্ত তো আমার একার নয়, মানুষের থেকেও আছে। দলের কথাও ভাবতে হয়। এটা একটা বড় কারণ যে ক্যারিয়ারটাকে ঠিকভাবে গড়তে পারিনি এখনও। যদি একটা নির্দিষ্ট পজিশনে খেলতে পারতাম তাহলে হয়তো আমার ক্যারিয়ারটা আরেকটু বড় এবং ভালো হতো। এতো বছরে অনেক কিছু শিখেছি। তবে যা চলে গেছে তা নিয়ে ভাবতে চাই না আর। ভবিষ্যত নিয়েই ভাবনায় আছি। এসব পেছনে ফেলে ভালো ভাবে সব পজিশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। গড়ের দিকেও মনোযোগ দিতে চাই, সেটাও বাড়াতে চাই।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ২০১৫ এবং ২০১৯ দুটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। বড় মঞ্চে চাপ নেয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বকাপে তরুণ হিসেবে খেলেছেন এবং পরের বিশ্বকাপে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। এই দুটি বিশ্বকাপের সঙ্গে আরও বড় বড় টুর্নামেন্টে খেলার যে চাপ সেগুলো নিতে শিখেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলি কি সামনে ভালো করতে সাহায্য করবে?

সাব্বিরঃ ২০১৫ বিশ্বকাপ যখন খেলি তখন তো তরুণ ছিলাম। পরেরটাই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছি। আপনি যখন একটা বাসায় একবার যাবেন এরপর আবার গেলে আপনার জানা থাকবে সেই বাসায় কোথায় কি আছে। তৃতীয়বার গেলে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন। দ্বিতীয় বার যখন বিশ্বকাপ খেলতে গেছি, প্রথমবারের মতো লাগেনি। একটু চাপ নিয়ে খেলেছি কারণ অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর একটা চাপ, বা সবার আস্থা অর্জন করার একটা বিষয় ছিল। পরের বিশ্বকাপে যদি খেলার সুযোগ পাই তাহলে চেষ্টা করবো আগের দুই বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর। এসব জায়গা থেকে একটা জিনিস শিখেছি যে কিভাবে ইনিংস লম্বা করতে হয়, যদিও আমি ব্যর্থ হয়েছি অনেক ক্ষেত্রে। সেটা নিজের ভুলের কারণেই বলবো। আপাতত পরবর্তী ১০ বছরের পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছি। সামনে ভালো কিছুই আসবে।  

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আজকের সাব্বির হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কার?

সাব্বিরঃ অবশ্যই আমার বাবা-মার। উনারা যদি আমাকে সুযোগ না দিতেন এতদূর আসতে পারতাম না। আবার তারা আমাকে শাসন না করলে খেলার জন্য বাসা থেকে পালাতামও না। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ অনেকজন অধিনায়কের অধীনেই খেলেছেন। জাতীয় দল বলেন, বিপিএল বলেন বা প্রিমিয়ার লিগ বলেন। কোন অধিনায়কের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছেন?

সাব্বিরঃ আমার অভিষেক হয় মাশরাফি ভাইয়ের অধীনে। বেশীরভাগ সময় উনার অধীনেই খেলেছি আমি। টেস্ট খেলেছি সাকিব ভাই-রিয়াদ ভাইয়ের অধীনে। একেক অধিনায়কের অধীনে একেক রকম অভিজ্ঞতা ছিল। এটা বলবো না যে কারও অধীনে আমার খেলা খারাপ হয়েছে। সবাই কম বেশি সাপোর্ট করেছেন আমাকে। তবে মাশরাফি ভাইয়ের অধীনে বেশি সফল ছিলাম, উনি বড় ভাইয়ের মতো আমাকে বেশি দেখেশুনে রাখতেন। 

ক্রিকফেঞ্জিঃ দেশের হয়ে ১১টি টেস্ট খেলেছেন। ২ বছরের বেশি সময় ধরে এই ফরম্যাটের বাইরে আপনি। লঙ্গার ভার্সনে ফেরার ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছেন? 

সাব্বিরঃ আমি ১১টা টেস্ট যেহেতু খেলেছি তার মানে টেস্ট খেলার মানসিকতা আছে আমার। কারণ আগে যখন খেলেছি তখন সবাই বলতো সাব্বির ওয়ানডে,টি-টোয়েন্টির খেলোয়াড়। কিন্তু আমি বড় দলের সঙ্গে টেস্ট খেলেছি। গড় খারাপ হলেও ৪টা হাফ সেঞ্চুরি আছে। যদি জাতীয় লিগ বা বিসিএলে ভালো খেলতে পারি তাহলে টেস্টে ফেরার বড় একটা সুযোগ থাকবে আমার জন্য।

ক্রিকফেঞ্জিঃ ক্যারিয়ারে তো অনেক কোচের অধীনে খেলেছেন। জাতীয় দলে চান্দিকা হাথুরুসিংহের সময় অভিষেক হয় আপনার। এরপর লম্বা সময় তাঁর কোচিংয়ে ছিলেন, বিশ্বকাপ খেলেছেন স্টিভ রোডসের অধীনে। বিপিএলেও দেশি-বিদেশি কোচদের পেয়েছেন। কাকে সবার আগে রাখতে চান? 

সাব্বিরঃ আমাকে জাতীয় দলে নিয়ে আসেন হাথুরুসিংহে। অনেক বেশি ম্যাচ খেলিয়েছেন। বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে বড় বড় টুর্নামেন্টে আমাকে নিয়ে গেছেন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি সাপোর্টটা আমি তাঁর থেকেই পেয়েছি। একজন ভালো বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে আমকে অনেক গাইড করেছেন। স্টিভ রোডসও ভালোভাবে গাইড করেছেন। তাঁর অধীনে শেষ একবছর খেলেছি আমি। নিউজিল্যান্ড সিরিজ এবং বিশ্বকাপে। এছাড়া আরও অনেক কোচের অধীনে খেলেছি। তবে জাতীয় দলের এই দুজন কোচই খুবই ভালো ছিলেন এবং অনেক বেশি সাপোর্ট করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সাপোর্টটা আমি হাথুরুর কাছ থেকেই পেয়েছি। মানসিক দিক হোক বা খেলার দিক থেকে হোক। রোডসকেও বাদ দিবো না। সেও সহযোগিতা করেছে অনেক।

ক্রিকফেঞ্জিঃ বিবাহিত জীবন মানুষকে বদলে দেয়, অনেকেই বলেছে। আপনার ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন এসেছে?

সাব্বিরঃ বিবাহিত জীবনে অনেক ডিসিপ্লিন। যেটা আগে আমার মধ্যে ছিল না। কারণ আমার খেয়াল রাখা বা বুঝিয়ে রাখার মতো কেউ ছিল না। নিজের মতো চলাফেরা করতাম। ঢাকাতে একা থাকতাম, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে জীবন কাটাচ্ছিলাম। তরুণ ছিলাম, আবেগ বেশি ছিল। কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিজের কথা শুধু ভাবলে হয় না। এর প্রভাব খেলার মাঠেও পড়েছে। একজনকে ভালো সময় এবং খারাপ সময় প্রতিনিয়ত পাশে পাচ্ছি।