|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
অপেক্ষা একদিনের। ৯ নভেম্বর, ২০০০।
সময় থমকে দাঁড়ায় না। বয়ে চলে বহমান নদীর মতো। দূর কিংবা কাছের অতীতেও ফিরে যাওয়া যায় না আর। তবুও কল্পনার সীমানায় কখনো কখনো চেষ্টা করা যায় সুখস্মৃতি ফিরে পাওয়ার। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুণ এমন এক দুনিয়ার। যেখানে হাতে হাতে মোবাইল নেই। ফেসবুক নেই। নেই ইন্টারনেট। আপনি খেলা দেখেন খুব। মূলত ফুটবল, টুকটাক ক্রিকেট।
এই দিনে আপনার কাছে যেটি নেই, সাদা পোশাকের ক্রিকেটে দেশের ক্রিকেটারদের কেমন দেখায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে; সে অভিজ্ঞতা। তবে আপনি এই মুহূর্তে উত্তেজনায় কাঁপছেন, রোমাঞ্চে নাচতে চাইছেন।
কারণ আপনার আর কিছু ঘণ্টার প্রতীক্ষা, অল্প কিছুক্ষণের প্রহর গোণা। এরপর? এরপর আপনার দেশ টেস্ট আঙিনার সদস্য হয়ে পড়বে পাকাপাকিভাবে। আপনি এমন এক দেশে বাস করবেন, যেটা ক্রিকেট নামক একটা খেলার সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাটটা খেলে।
সেই দিন। ১০ নভেম্বর, ২০০০
এই দিনটা কি আলাদা? আপনার স্মৃতি কি তাই বলে? কেন বলুন তো? মনে করতে পারছেন না? মনে করুন এক শীতের সকালের কথা। এই ঋতুর অন্য দিনগুলোর মতোই। হালকা অথবা ঘন কুয়াশা। শহর আর গ্রামের পার্থক্যে বদলে যায় যার গভীরত্ব। সূর্য উঠি উঠি করেও উঠে না।
কুয়াশা ভেদ করে ধীরে ধীরে। নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় যখন পুরো। আপনি এন্টিনা ঘুরালেন অথবা চালু করলেন রেডিও। বহু কষ্টে ধরালেন বিটিভি অথবা বাংলাদেশ বেতার।
তখন ঘড়িতে সময় সাড়ে নয়টা। সৌরভ গাঙ্গুলী দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার দেশের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও। তারা দুজন টস করলেন। বাংলাদেশ জিতলো, ব্যাটিং নিলো। ব্যাট হাতে ইনিংস উদ্বোধনে নামলেন শাহরিয়ার হোসেন-মেহরাব হোসেন অপি।
কতকিছু বদলে গেল। দিনটার কথা কি মনে পড়েছে? বুঝতে পেরেছেন নয় আর দশ নভেম্বর, দুই হাজারের মাঝখানকার বিশাল ফারাক? একদিনের ব্যবধানে আপনার দেশের কেউ টেস্টে টস করেছেন। ব্যাটিংয়ে নেমেছেন, রান করেছেন। সাদা পোশাকের অভিজাত ফরম্যাটে। আপনি এখন টেস্ট খেলা দেশের লোক।
অপেক্ষা, অপেক্ষা...অবসান; ১০ জানুয়ারি, ২০০৫
৩৪ টেস্ট। ৩ টা ড্র-ই সম্বল। বাকিগুলোতে হার, সংখ্যাটা; ৩১। প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা এরপর হতাশা। এই যেন নিয়তি। একটার পর একটা ম্যাচ যায়। জয় আর আসে না। ক্রিকেটার বদলায়, বদলে যায় মাঠ কিংবা দেশ। কখনো কখনো চলে যাওয়া হয় খুব কাছে, নিঃশ্বাস দূরত্বে। কেবল পাওয়া হয় না জয়টা।
১০ জানুয়ারি ২০০৫। দুপুর ১২টা ৫৩। এমফুফু খেললেন, ক্যাচ তুলে দিলেন মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে। 'আশার ফুল' সেটা ধরলেন। এরপর ভৌ দৌড়ে ছাড়িয়ে যেতে চাইলেন সব।
আনন্দের সীমারেখা আজ তিনি নতুন করে লিখতে চান যেন। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় এলো। পাঁচ বছর দুই মাস পর। সবাই যেন চিৎকার করতে চাইলো, 'অপেক্ষা, অপেক্ষা; অবসান।'
প্রসঙ্গ সাকিব আল হাসান
ডিসেম্বর, ২০১১। তীব্র শীতে আপনি হয়তো কাবু হয়ে আছেন তখন। খেজুরের রস কিংবা পিঠা হাতে থাকতে পারেন আনন্দেও। আপনার দেশের একটা ছেলে ক্রিকেটে খুব ভালো করছে। তার নাম সাকিব আল হাসান।
পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে দারুণ খেলেছে। প্রথম ইনিংসেই ব্যাট হাতে করেছে ১৪৪ রান, বল হাতে পেয়েছে ছয় উইকেট। আপনি খুশি হয়েছেন। কিছুদিন বাদে টিভি খুলে বসেছেন। হঠাৎ চোখ আটকে গেছে।
আপনি ভাবছেন ভুল দেখছেন কিংবা আপনার ভ্রম হয়েছে। আদতে তেমন কিছু ঘটেনি। আপনি ঠিক দেখছেন। সাকিব আল হাসান নামের এক ক্রিকেটার, অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছেন। তার দেশের নাম বাংলাদেশ।
তিনি আগে-পরে আরও কীর্তি গড়েছেন। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে ধরাশায়ী করেছেন সাদা পোশাকে। বেন স্টোকসকে তার স্যালুট দেয়া ছবিটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত ছবি কিনা, সেটা নিয়ে তর্ক করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে ওই অনুভূতিটা নিশ্চয়ই আলাদা হয়ে থেকেছে?
বেন স্টোকস, স্যালুট...'আপনাদের হারিয়ে দিলাম'
সাকিব আল হাসানের প্রসঙ্গ ওপরে এসেছে। তার স্যালুটেরও। বেন স্টোকসকে যখন তিনি এই স্যালুট দিচ্ছেন, তখনো নিশ্চিত নয় কিছুই। তবে এটুকু নিশ্চিত, দেশ দাঁড়িয়ে ক্রিকেটের অন্যতম বড় জয়ের সামনে।
সেটা পূরণ হওয়ার বার্তাটা যেন সাকিব দিয়ে দিলেন আগেভাগে। আর তিনটা বল দরকার তখন, উইকেট পাওয়া বল। এরপর? স্বপ্নের পাখি উড়াল দেবে সীমানা প্রাচীর ভেদ করে। ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়ে দেয়ার কল্পনাতেই এসেছে ক'জনের?
৩০ অক্টোবর, ২০১৬ সাল। হলো তেমন কিছুই। চতুর্থ দিনের খেলা চলছিল। ৪৫ তম ওভারের তৃতীয় বল। মিরাজ বল করলেন, স্টিভেন ফিন এলবিডব্লিউ হলেন। আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা আঙুল তুললেন। আর এতেই বাংলাদেশ পেলো ১০৮ রানের জয়। আর দুই ইনিংস মিলিয়ে মিরাজের অর্জন ১২ উইকেট।
সাদা পোশাকে রঙিন স্মৃতি খুব একটা নেই। সেই দায় কিছুটা হলেও ঘুঁচলো ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই স্মরণীয় মুহূর্তে আপনি কি করছিলেন? আপনার কি দুই হাজার সালে এন্টিনা ঘুরানো সেই দিনটার কথা মনে পড়েছিল?
আভিজাত্যের ক্রিকেটে প্রতাপশালী অজি বধ
প্রথম ইনিংসে তামিম ৭১ রান করলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে সাত রান বেশি। সাকিব প্রথম ইনিংসে ৮৪ রান করলেন, দুই ইনিংস মিলিয়ে দশবার উড়ে যেতে চাইলেন আকাশে, উইকেট তুলে নিয়ে। তিনি জানেন তিনি পাখি হতে পারবেন না, তবুও।
তাইজুল তিন উইকেট পেলেন দ্বিতীয় ইনিংসে। আগের ইনিংসে তার সমান পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। আপনি এতক্ষণ যা পড়লেন, সব ব্যক্তিগত অর্জন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, ঘরের মাঠে, ২০১৭ সালে। বিন্দু বিন্দু জল মিলে সিন্ধু গড়ে উঠলো।
টেস্টের চতুর্থ দিন চলছে। এক বল বাদেই শুরু হবে ৭১তম ওভার। বছর খানেক আগের পুনারাবৃত্তি হলো যেন। আগেরবার বোলার ছিলেন মিরাজ, ব্যাটসম্যান ফিন। এবার তাইজুল আর হ্যাজিলউড। ব্যাটসম্যানের পায়ে বল লাগতেই তাইজুল বসে পড়লেন। হাত তুললেন, আবেদন জানালেন আউটের। নাইজের লং আঙ্গুল তুলে দিলেন। আউট!
বাংলাদেশ হারালো অস্ট্রেলিয়াকে। টেস্টে। সাকিব জড়িয়ে ধরলেন তাইজুলকে। তামিম সাকিবকে। সতীর্থরা সবাই একে-অপরকে। আপনি?
শততম টেস্ট
কলম্বো, শ্রীলঙ্কা। ১৫ মার্চ, ২০১৭। একশ। কোনো ব্যাটসম্যানের রান না, বোলারের উইকেট সংখ্যাও না। বাংলাদেশের টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি। এই শতকের শুরুতে অভিষেক, সতেরো বছরের মাথায় টেস্ট খেলার শতক। এ যেন অন্য রকম তৃপ্তি।
অথচ এমন উপলক্ষ্যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নেই, মুমিনুল হকও। প্রথম ইনিংসে ৩৩৮ করলো শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশও জবাব দিলো শক্তভাবে। ৪৬৭ রান করে। সাকিব সেঞ্চুরি করলেন। মোসাদ্দেক, সৌম্য মুশফিক করলেন হাফ সেঞ্চুরি।
দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১৯ রানে গুঁটিয়ে গেল শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ লক্ষ্যে পৌঁছালো ৪ উইকেট হাতে রেখে। এতক্ষণ যা পড়লেন, তাতে বড্ড তাড়াহুড়ো, ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
অথচ তার পরতে পরতে মিশে আছে সংগ্রামের গল্প, আছে লড়াই জয়ের আনন্দ। বিদেশের মাটিতে শততম টেস্ট, সেটাতেও জয়। এর চেয়ে বেশি বোধ হয় কিছু চাওয়ার ছিল না।
আক্ষেপ ও আজ। ১০ নভেম্বর, ২০২০
মুলতান, ফতুল্লা কিংবা অন্য কিছু। হবে হবে করেও হয়নি, এমন পাওয়া যাবে অনেক। জিততে জিততেও হেরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য রঙিন পোশাকে আছে, সাদা পোশাকেও। বিশ বছর পর পেছনে তাকালেও সেসবই বেশি ভেসে উঠে চোখে। আজ আক্ষেপ কাব্যগুলো জমা থাক মনের গহীনে।
নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কাঠামোও ছিল না। আজ যা আছে, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের মাটিতে জয় আছে, বাইরে গেলে এখনো যবুথুবু অবস্থা। বিশ উইকেট নেয়ার মতো বোলার নেই। ভালো মানের পেসারের অভাব বাইরে লড়াই করার মতো। নেই লেগ স্পিনার।
তবুও। প্রথম টেস্টের পর বিশ বছরের স্মৃতিচারণ করলে কেমন লাগে? সব সীমাবদ্ধতা ভুলে গেলে দেশের ক্রিকেটে সেই টেস্ট খেলাটা কি জরুরি মনে হয়? টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে বারবার উঠা প্রশ্ন মনে হয় অমূলক।
বাংলাদেশ সব আক্ষেপ দূর করুক। রঙিন পোশাকের মতো সাদা পোশাকেও উড়ুক স্বপ্ন ঘুড়ি। একটা প্রজন্ম বড় হয়ে গেছে মাঝখানে। শিশুরা কৈশোর পেরিয়েছে, যুবকরা আছে বৃদ্ধ হওয়ার পথে। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটও হাঁটছে যৌবনের পথে। টেস্টের বিশ বছরে কিছু আক্ষেপ, স্মরণীয় জয় আর প্রসঙ্গ সাকিব আল হাসানকে রেখে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাই তো সবচেয়ে কাম্য।