|| সিডনি থেকে আবিদ মোহাম্মদ ||
চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নাম শুনলেই যেন ভেসে উঠে এক কঠোর মুখচ্ছবি। এই কঠোর মানুষটির হাত ধরেই ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ধারাবাহিকতার সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল বাংলাদেশ। বিশেষ করে ওয়ানডে ও ঘরের মাঠে টেস্টের ফলাফল কথা বলে এই কোচের পক্ষেই। তবে নানা কারণে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যায় লাল-সবুজের দেশটির সবচেয়ে সফল এই কোচের।
সময়ের পালাক্রমে এই হাথুরুসিংহের দেখা মিলল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। নিউ সাউথ ওয়েলস ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির কোচ এখন তিনি। যার হাত ধরে একাধিক ক্রিকেটার লাল-সবুজ জার্সি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, সেই কিনা এখন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার তৈরির কারিগর। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় অবশেষে ক্রিকফ্রেঞ্জিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন নান বিষয় নিয়ে।
খোলাসা করেছেন বিসিবির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া থেকে শুরু করে আবারও বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ভাবনা নিয়ে। পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশ দল ও চলমান টি-টয়েন্টি বিশ্বকাপে কেমন করতে পারে সাকিব আল হাসানের দল তাও জানিয়েছেন এই লঙ্কান।
পাঠকদের সুবিধার্থে হাতুরুসিংহের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার সময়ে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য পেয়েছে। আবারও কোচ হয়ে বাংলাদেশে ফেরার ইচ্ছে আছে ?
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে: হাসি..। আমি তো চাই। তবে এখন না। দেখি সময় কি বলে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: তাহলে কি ধরে নিতে পারি আগামী বছর ফিরছেন?
হাথুরুসিংহে: হতে পারে, নাও হতে পারে... কারণ এখনও আমার ছেলেটা ছোট। ওর বয়স ১৫ বছর। ওকে আরও কিছু সময় দিতে হবে। সে ক্রিকেট ভালোবাসে। তাকে তৈরি করার ব্যাপার আছে। আমি হয়তো না বলব না। কারণ আমি ওখানে (বাংলাদেশে) যেতে চাই। দুই পক্ষের জন্যই উপযুক্ত সময়ে যেতে চাই।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: তাহলে সঠিক সময়টা কখন আসবে?
হাথুরুসিংহে: আসলে আমি ঠিক সময় বলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সময়কে বোঝাচ্ছি। উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে, যখন লাভজনক সময় মনে হবে তখন বেছে নেব। এটা সঠিক সময় না। প্রতিশ্রুতি বলতে বড় কিছুকে বোঝাচ্ছি। কারণ এটা দিলে সেটাকে পুরোপুরি পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ অন্যতম সেরা ক্রিকেটজাতি। ক্রিকেট নিয়ে ওখানে কতটা আবেগ সেটা জানি। শতভাগ দিতে না পারলে অন্যায় করা হবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আগামী বছর তো ওয়ানডে বিশ্বকাপ আছে, এর আগে বিসিবি তো আপনাকে চাইতেই পারে?
হাথুরুসিংহে: এটা অনেকটাই অসম্ভব এখন। এই মুহূর্তে দলে স্থায়ী কোচিং ইউনিট রয়েছে। নতুন যোগ হয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য। ওয়ানডে বিশ্বকাপের মাত্র ১০ থেকে ১২ মাস বাকি আছে। এত কম সময়ে যে কারো জন্য বড় পরিবর্তন করা কঠিন। বাংলাদেশের ওয়ানডে দলটা ভালো করছে। আশা করি ভারত বিশ্বকাপে ভালো করবে। কারণ কন্ডিশন বাংলাদেশের মতোই।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: কোচ হিসেবে বিসিবি আপনাকে পছন্দের তালিকায় প্রথমে কেন রাখে?
হাথুরুসিংহে: সত্যি বলতে আমি জানি না। তারা প্রথম যখন বললো জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে যোগ দিতে আমি খুবই খুশি ছিলাম। তখন আমি বড় কিছু ছিলাম না। আমাকে সেভাবে প্রমাণ করতে হয়নি। হ্যাঁ, আমি শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের কোচ ছিলাম। জাতীয় দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেছি। চার বছর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কাজ করার পর সাইথইস্ট ব্লুজের সহকারী ও ব্যাটিং কোচ ছিলাম।
এরপর সিডনি থান্ডার্সের কোচ ছিলাম। সিডনির হেড কোচ হওয়ার পর আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশের কোচ হওয়ার পর কিছু সাফল্য আমাকে সাহস দিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এজন্য যে আমার মতো একজন অপরিচিত কোচকে নিয়োগ দিয়েছিল।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতখানি দেখছেন? পাশাপাশি এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের উন্নতি কেমন দেখছেন?
হাথুরুসিংহে: বিশ্বকাপ নিয়ে জানতে চাইলে সেটা একরকম। অন্যটা হলো টি-টোয়েন্টিতে কেন প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। বিশ্বকাপটা চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাদের সাফল্য নেই। এখানে কন্ডিশন কঠিন। অন্য দলগুলো স্কিল এবং গেমের মেজাজ বুঝে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো খেলতে পারে। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোন স্টাইলে খেলা উচিৎ সেটা বুঝতে হবে। নিজেদের সামর্থ্য বুঝে খেলার কৌশল বেছে নেবে।
কারণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনেক এগিয়ে গেছে। আইপিএল ভারতের টি-টোয়েন্টি দলটাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজ্যিান্ডের ক্রিকেটাররা আইপিএল খেলে। তারা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশ, ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতেও ভালো খেলে। এখান থেকে তারা আত্মবিশ্বাস পায়। তারা জানে কিভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে হয়। জিনিসগুলো ধরতে বাংলাদেশের কিছুটা সময় প্রয়োজন।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: সাকিব আল হাসানই কি বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার না অন্য কারও মাঝে সেটা দেখতে পান?
হাথুরুসিংহে: কঠিন প্রশ্ন। সাকিব আল হাসান একজনই তৈরি হয়েছে। এই যুগের সেরা ক্রিকেটার সে। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। লম্বা সময় ধরে খেলছেন। সাকিবের মতো আর একজনকে খুঁজে পেতে বাংলাদেশকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে সাকিবের মতো কেউ হবে না আমি বলতে পারি।
তারা হয়তো ভিন্ন সুপার স্টার পাবে, কিন্তু সাকিবের মতো কাউকে পাবে না। ২০০৭ সালের দিকে লক্ষ্য করেন কতজন ক্রিকেটার এসেছিল বাংলাদেশ দলে। মুশফিক, তামিম, সাকিব একসঙ্গে খেলেছে। পাঁচ থেকে সাত বছর লেগেছে এই ক্রিকেটারদের কাছ থেকে ফল পেতে। এখন যেমন লিটন, মুস্তাফিজ, তাসকিন ভালো করছে। তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলে। সে কারণেই বলছি বাংলাদেশ সুপার স্টার ক্রিকেটার পাবে কিন্তু সাকিবের মতো কাউকে পাবে না।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পুরনো শিষ্যদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়?
হাথুরুসিংহে: হ্যা, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: পরামর্শ চাইতে যোগাযোগ করেন নাকি গল্প করতে?
হাথুরুসিংহে: অনেক কথাই হয়। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার নিয়ে কথা হয়। মাঝে মধ্যে ক্রিকেট নিয়েও এটা ওটা জানতে চায়। আমি কি করছি সেটাও জানতে চায়। আরও অনেক কিছু নিয়েই কথা হয়।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনাকে তো গত বছর বিসিবি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কেন গ্রহণ করেননি? আর হুট করে বিসিবির চাকরি ছেড়েছিলেন কেন?
হাথুরুসিংহে: আমরা সব সময় রেজাল্ট দিতে পারব না। আমরা প্রসেস শেখাতে পারি। কোচরা সিস্টেম গড়ে তোলা এবং সেরা সুযোগ সুবিধা ক্রিকেটারদের জন্য নিশ্চিত করতে পারে। যাতে তারা সেরাটা করতে পারে। আমি তখন চাকরি ছেড়েছিলাম চুক্তির শেষের দিকে পৌঁছে গিয়েছিলাম। এছাড়া আমার দেশের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম। সে কারণেই চাকরিটা ছেড়েছিলাম। এছাড়া কিছু ছিল না। আর এখন চাকরি নিতে পারিনি উপযুক্ত সময় না আসায়।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার সময়ে বলেছিলেন মুমিনুল হক দেশের মাটিতে ভালো খেলোয়াড়। বিদেশে ভালো করবে না। শততম টেস্টে বাদ দিয়েছিলেন। এরপর সে অধিনায়ক হয়েছে। এখন আবার দলের বাইরে। এখন সবাই বলছে হাথুরু ঠিক বলেছিল।
হাথুরুসিংহে: তার সামর্থ্য নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। শততম টেস্টের আগে সে ছন্দে ছিল না। আমরা যেভাবে খেলতে চেয়েছিলাম সেটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মুমিনুলকে বিশ্রাম দিতে হয়েছিল। এটা ছিল ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত। মোসাদ্দেক, সাব্বির রহমান তখন ভালো করছিল। তারা অন্যরকম ক্রিকেটার ছিল। মুমিনুল সত্যিই খুব ভালো ক্রিকেটার। তার ব্যাটিং রেকর্ড খুবই ভালো। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশকে সে লম্বা সময় সার্ভিস দেবে।
ক্রিকফ্রেঞ্জি: সাত বছর আগে বাংলাদেশ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল। সাত বছর পরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ। আপনি খেলা দেখতে যাবেন?
হাথুরুসিংহে: প্রথমত আমার হাতে অনেক সময় নেই। পরশু সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলার দিন আমাকে একাডেমিতে অনুশীলন করাতে হবে। কাল (আজ) অনুশীলন করিয়ে একটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করব। আর এবারে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দুই তিনটা ম্যাচ জিততে পারলেই দারুণ কিছু অর্জন হবে। তাদের ফর্ম এবং টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স খুব বেশি ভালো না। তবে তাদেরকে স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে হবে পরের দুই ম্যাচে। বেশি চাপে ফেলা ঠিক হবে না।