শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম

খেলা নয়, সবজি চাষ হয় শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে

শান্ত মাহমুদ

শান্ত মাহমুদ
প্রকাশের তারিখ: 15:43 রবিবার, 01 সেপ্টেম্বর, 2019

|| সিনিয়র ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট ||

শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম- আগে পিছে জায়গার নাম না দিলে অনেকেই হয়তো বলতে পারবেন না স্টেডিয়ামটি কোথায় অবস্থিত। এখানে কোন খেলা হতো, সেটাও হয়তো নিশ্চয়ই এখন কঠিন প্রশ্ন। উত্তর না দিতে পারায় ভক্তকুলকে দুষে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি এখন কেবলই স্মৃতির পাতায়। আর স্মৃতির পাতা না উল্টাতে উল্টাতে স্টেডিয়ামটির গল্প শ্যাওলাজমা অতীত হয়ে গেছে। যদিও বগুড়ার এই স্টেডিয়ামে শ্যাওলা জমার সুযোগ নেই। কারণ এখানে নিয়মিত সবজি চাষ হচ্ছে।

যেহেতু সবজি চাষ হচ্ছে, তাই পানি দেয়া হচ্ছে, পড়ছে রাসায়নিক সারের ছিটাও। যারা ক্রিকেটের খবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে হায় হায় শুরু করে দিয়েছেন। নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, এই মাঠেই প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছিল না বাংলাদেশ? আপনার উত্তর শতভাগ সঠিক। কিন্তু এই মাঠে এখন আর ক্রিকেটের ছোঁয়া নেই। ১৩ বছর ধরে‘পতিত’ পড়ে থাকা শহীদ চান্দুর বুকে চালানো হচ্ছে কাঁচির আচর, ফলানো হচ্ছে মৌসুমি সবজি।

ক্রিকেট মাঠ সবুজ হয়। কম হলেও শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে সবুজের ছোঁয়া আছে। তবে ঘাসের চেয়ে সবজির সবুজই এখানে বেশি। আন্তর্জাতিক মানের এই স্টেডিয়ামটির খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। অনাদরে, অবহেলায় বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম। অথচ এই স্টেডিয়াম নির্মাণে কী বিপুল অর্থই না ব্যয় করা হয়েছে! ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর একটি টেস্ট ও ৫টি ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মাঠে। এর মধ্যে চারটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ।

অজানা কারণে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে অভিষেকের বছরেই। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের পর আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে, এর মধ্যে একবারের জন্যও জ্বলে ওঠেনি বগুড়ার এই স্টেডিয়ামটির ফ্লাডলাইট। তবে এখানে যে ম্যাচ হয়নি, তা নয়। এখানে ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছে প্রায় প্রতি বছরই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচ না থাকায় তেমন কোনো পরিচর্যা হয়নি স্টেডিয়ামটির।

ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে প্রেসবক্স, গ্যালারি, ভিআইপি গ্যালারির অবস্থা পরিত্যক্ত কারখানার মতো। গ্যালারির চেয়ার ভাঙা, বেশিরভাগ রুমেই নেই কাঁচ। দেখে বোঝার উপায় নেই এটাই এক সময় আন্তর্জাতিক ম্যাচের ভেন্যু ছিল। অবশ্য একটা পাশে পরিচর্যায় থাকেন কর্মীরা, তবে সেটা সবজি চাষের।  

সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ স্টেডিয়ামটির নিরাপত্তা। স্টেডিয়ামে কারো কোনো নজর না থাকায় আশেপাশেই গড়ে উঠেছে অনেক বাড়িঘর। এখানে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করছেন স্টেডিয়াম চত্ত্বর। বাড়িঘর ও দোকানপাটের কারণে স্টেডিয়ামে প্রবেশের রাস্তাটিও হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ। 

স্টেডিয়ামটির কেন এই অবস্থা, এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো কেউ নেই শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে। কারণ স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণে কাউকে দায়িত্বে রাখা হয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ এখানে আয়োজন করা হলেও স্টেডিয়ামের সংস্কার বা দেখভালের দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) কানে তোলেনি। যে কারণে প্রতিনিয়তই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম।

অথচ এই স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়ার জন্য কী তড়িঘড়িই না করা হয়েছিল! তাড়াহুড়ো করে বগুড়া জেলা স্টেডিয়ামকে রূপান্তরিত করা হয় শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে। আইসিসির নির্দেশনামাফিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে স্টেডিয়ামটির।

টেস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করার ১৪ দিন পর ওয়ানডে অভিষেকও হয় শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের। কিন্তু সব আয়োজন এক বছরেই শেষ। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিষেক হওয়া স্টেডিয়ামটিতে সর্বশেষ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে একই বছরের ৫ ডিসেম্বর। এরপর লম্বা সময় পেরিয়ে গেলেও স্টেডিয়ামটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের তেমন কোনো চেষ্টাই দেখা যায়নি।

অন্যদের কাছে স্টেডিয়ামটির গুরুত্ব সেভাবে না থাকলেও বগুড়াবাসীর কাছে যে বিষয়টি তেমন নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। যে কারণে বগুড়ার কয়েকজন প্রবীণ ক্রিকেট সংগঠক স্টেডিয়ামের সংস্কার করিয়ে এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এই পথে প্রধান বাধা বিমানবন্দর না থাকা। বগুড়ায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ না হওয়ার এটাই যে প্রধান কারণ, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন।

যে কারণে বিসিবি ও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন। তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামেরঅবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাইলে সেটা দ্রুত করতে হবে। যেন আরও ক্ষতি না হয়। আর এটা সম্ভব না হলে সেই পুরোনো জেলা স্টেডিয়াম হিসেবেই বগুড়াবাসীকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এতে অন্তত সব ধরনের খেলাধুলা আয়োজন করা যাবে এই মাঠে।’

শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে বিমানবন্দরই অবশ্য একমাত্র বাধা নয়। এই মাঠের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। ২০০৭ সালে এই স্টেডিয়ামকে ‘ডি’ গ্রেডের সার্টিফিকেট দিয়েছিল আইসিসির একটি পরিদর্শন দল। এই দুটি কারণে এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন বন্ধ থাকতেই পারে। কিন্তু স্টেডিয়ামটি দিনে দিনে কেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?