বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাস

সৈয়দ সামি

সৈয়দ সামি
প্রকাশের তারিখ: 22:01 শনিবার, 13 জুলাই, 2019

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট || 

ফাইনালের আবহাওয়াই অন্যরকম। যেখানে থাকবে স্নায়ুচাপ, চরম নাটকীয়তা কিংবা একপেশে দাপট। রবিবার ক্রিকেটের তীর্থ ভূমি লর্ডসে দ্বাদশ বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারও এরকম কিছুরই অপেক্ষায় ক্রিকেটবিশ্ব। ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। দুই দলই নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে এবারের বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে।

বিশ্বকাপের আগের ফাইনালগুলোও ছিলো নাটকীয়তার ভরপুর। এক নজরে দেখে নেয়া যাক আগের ১১টি ফাইনাল কেমন ছিলো।

ক্যারিবীয়দের ইতিহাস (১৯৭৫)

মাত্র ১৮টি ওয়ানডে ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়। সেবার বিশ্বকাপ আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি; বাণিজ্য বৃদ্ধি ও খেলাটির জনপ্রিয়তা বাড়ানো। ইংল্যান্ড ছাড়া ক্রিকেট খেলার মতো খুব বেশি ভেন্যু ছিল না কোথাও। তাছাড়া সে সময় ক্রিকেটের সবকিছুই ছিল ইংল্যান্ডকেন্দ্রিক; তাই সেখানেই আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপ।

ইংল্যান্ডের ৬টি ভেন্যুতে আটটি দলকে নিয়ে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রুডেন্সিয়াল অ্যাসিউরেন্স কোম্পানির নামে নামকরণ করা হয় প্রুডেন্সিয়াল কাপ! তখনকার ৬টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা ও ইস্ট আফ্রিকাকে নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়।

এখন ওয়ানডে ক্রিকেট ৫০ ওভারের হলেও সে সময় ৬০ ওভারের ছিল। প্রথম রাউন্ডে আটটি দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। গ্রুপের সেরা দুটি দল সেমিফাইনালে অংশ নেয়। পুরো আসরজুড়ে ছড়ি ঘোরানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেবার শিরোপা জেতে।

ফাইনালে আগে ব্যাটিং করে নির্ধারিত ৬০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৯১ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে কেইথ বয়েসের বোলিং তাণ্ডবে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে যায় ২৭৪ রানে। ১৭ রানের জয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের স্বাদ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।


ওয়েস্ট ইন্ডিজের টানা দ্বিতীয় শিরোপা (১৯৭৯)

প্রথম বিশ্বকাপের মতো দ্বিতীয় বিশ্বকাপটিও প্রতিলিপির মতো ছিলো। টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের ছয়টি ভেন্যুর সঙ্গে বিশ্বকাপেরও আয়োজক ছিল প্রুডেন্সিয়াল। মজার ব্যাপার হলো সেবারও শিরোপা জেতে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ফাইনালের নায়ক ছিলেন ভিভ রিচার্ডস। তাঁর ১৩৮ রানের অপরাজিত ইনিংসের সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৮৬ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে স্বাগতিক ইংল্যান্ড গুটিয়ে যায় ১৯৪ রানে। ৯২ রানে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।


অঘটনঘটনপটিয়সী (১৯৮৩)

১৯৮৩ বিশ্বকাপ ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। ‘বি’ গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচেই হট ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারের মুখ দেখে নবাগত দুই দল জিম্বাবুয়ে এবং ভারতের বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত চলেছে অঘটন পর্ব।

‘বি’ গ্রুপে খেলা অস্ট্রেলিয়া খাদের কিনারা থেকে উঠে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে। এই গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠে ভারত। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে ভারতকে জেতাতে বড় ভূমিকা রাখেন অধিনায়ক কপিল দেব। 

অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেউই হয়তো ভাবেনি ফাইনালে তারা ভারতের বিপক্ষে হেরে যাবে। আগে ব্যাটিং করে ১৮৩ রানে অল আউট হয় ভারত। জবাবে মদনলাল ও মহিন্দর অমরনাথের বিস্ময়কর বোলিংয়ের সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গুটিয়ে যায় ১৪০ রানে। ৪৩ রানে ম্যাচ জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তোলে ভারত।

অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নযাত্রার শুরু (১৯৮৭)

আগের তিনটি বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হলেও সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চতুর্থ বিশ্বকাপের আসর বসে ভারত এবং পাকিস্তানে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয় ম্যাচের পরিধিতে। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ তখন থেকেই শুরু হয়। অনেক নাটকীয়তা সত্ত্বেও দুই স্বাগতিক দলকে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয় অ্যাশেজের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া।

তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ইংল্যান্ড তাদের শিরোপা খরা ঘোচানোর সুযোগ পেয়েছিল সেবার। তবে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা অস্ট্রেলিয়ার সামনে ৭ রানে হার মানে ইংলিশরা। আগে ব্যাট করে ৫ উইকেটে ২৫৩ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৪৬ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। ৭ রানের জয়ে প্রথম শিরোপা জেতে অজিরা। 

আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান (১৯৯২)

রঙিন পোশাক, ফ্লাড লাইটের আগেও টুকটাক পরীক্ষা ওয়ানডে ক্রিকেটে চালু হয়েছিল। তবে ১৯৯২-এর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত রঙিন পোশাকে খেলা শুরু হয়। সেই সঙ্গে খেলোয়াড়দের জার্সির পেছনে নাম লেখা, সাদা বল, ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন এবং দুই প্রান্তে দুই নতুন বলের নিয়ম চালু হয় এই বিশ্বকাপেই। এই বিশ্বকাপ দিয়েই নতুন এক যুগে প্রবেশ করে ওয়ানডে ক্রিকেট।

৯টি দল অংশ নেয়ায় সব দলকে নিয়েই একটি গ্রুপে করা হয়। সেখান থেকে সেরা চার দল খেলে সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালে বৃষ্টি আইনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ১ বলে ২২ রানের লক্ষ্য এখনও সবার কাছে বিস্ময় হয়ে আছে!

ফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত খেলা পাকিস্তান। আগে ব্যাটিং করে ইমরান খান এবং জাভেদ মিয়াঁদাদের জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ২৪৯ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তান। জবাবে ওয়াসিম আকরাম ও সাকলাইন মুস্তাকের বোলিং তোপে ২২৭ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। দারুণ জয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে পাকিস্তান।

লঙ্কাকাণ্ড! (১৯৯৬)

১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে। এই বিশ্বকাপের আগে যেকোনো দল প্রথম ১৫ ওভারে ৪০-৫০ রানকেই যথষ্ঠ মনে করতো। তবে সেই ধারণাকে বদলে দিয়ে ভারত, কেনিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লঙ্কানরা তোলে ১১৭, ১২৩ ও ১২১ রান।

ধারাবাহিকভাবে দারুণ খেলে ফাইনালে জায়গা করে নেয় দলটি। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিং করে ২৪১ রানের পুঁজি পায়। জবাবে অরবিন্দ ডি সিলভার ১০৭ রানের অপরাজিত ইনিংসে ৭ উইকেটের বড় জয় পায় শ্রীলঙ্কা। সেবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে লঙ্কানরা।

আবারও অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব (১৯৯৯)

তিন আসর পর বিশ্বকাপ আবারও ফিরে আসে ইংল্যান্ডে। এখানেও চ্যাম্পিয়ন দলের নাম অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অপ্রতিরোধ্য পাকিস্তান। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের নিয়ে গড়া অজিদের বোলিং আক্রমণের সামনে ওয়াসিম আকরামের পাকিস্তান গুটিয়ে যায় মাত্র ১৩২ রানে। মার্ক ওয়াহ-অ্যাডাম গিলক্রিস্টরা এ লক্ষ্য পেরিয়ে যান ৮ উইকেট হাতে রেখেই। দাপুটে জয়ে দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া।

অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া (২০০৩)

২০০৩ বিশ্বকাপকে বলা যেতে পারে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য বিস্তারের আরেকটি ধাপ। এই বিশ্বকাপে তাদের বিপক্ষে কোনো দলই দাঁড়াতে পারেনি। সেই আধিপত্যের বড় একটা নজির দেখা যায় ফাইনালেই। সেবার ভারতের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া।

১৪০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়ার বড় সংগ্রহ নিশ্চিত করেন অধিনায়ক রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভারত অলআউট হয় ২৩৪ রানেই। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা তিনটি, এবং ব্রেট লি ও অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস দুটি করে উইকেট নেন।

আলোচিত ক্যারিবীয় দীপপুঞ্জ (২০০৭)

ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ২০০৭ বিশ্বকাপ অনেক কারণেই সবার মনে দাগ কেটে থাকবে। আয়ারল্যান্ডের কীর্তি, বব উলমারের মৃত্যু, দর্শক বিতর্ক, ভারত-পাকিস্তানের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় এবং ভুল আম্পায়ারিংয়ের জন্য এই বিশ্বকাপটি অন্য আসরগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল।

আগের দুই বিশ্বকাপের মতো সেবারও দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করে ফাইনালে জায়গা করে নেয় অস্ট্রেলিয়া। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। আগে ব্যাট করে ২৮১ রানের বেশি করতে পারেনি অজিরা। জবাবে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ইনিংস থামে ২১৫ রানে। বৃষ্টি আইনে ৫৩ রানের জয় নিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে অজিরা।

স্বাগতিকদের প্রথম বিশ্বকাপ জয় (২০১১)

এই বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল পাকিস্তান। কিন্তু লাহোরে ২০০৯ সালে বোমা হামলার জেরে তারা আয়োজক হওয়ার যোগ্যতা হারায়। ফলে বিশ্বকাপটি যৌথভাবে আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ, ভারত এবং শ্রীলঙ্কাকে। বিশ্বকাপের পর্দা ওঠে বাংলাদেশে।

টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাপট দেখিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে ভারত। ফাইনালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো স্বাগতিক কোনো দেশ শিরোপা উঁচিয়ে ধরে।

আগে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ২৭৪ রান। দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলের বড় সংগ্রহ নিশ্চিত করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। জবাবে ৬ উইকেট হাতে রেখেই লক্ষ্য পেরিয়ে যায় ভারত। মহেন্দ্র সিং ধোনি ৯১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসান।

অস্ট্রেলিয়ার মুকুটে পঞ্চম পালক (২০১৫)

অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড যৌথভাবে ২০১৫ বিশ্বকাপ আয়োজন করে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ফাইনালে মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। ব্ল্যাক ক্যাপদের ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া।