বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ দল পরিচিতিঃ ভারত

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 10:44 বুধবার, 29 মে, 2019

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

১৮৪৮ সালে মুম্বাই এর পার্সি সম্প্রদায় ‘’ওরিয়েন্টাল ক্রিকেট ক্লাব’’ নামের ক্লাব গঠন করে, যা ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম ক্রিকেট ক্লাব। ১৯১১ সালে ভারতীয় দল প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে ইংল্যান্ড যায়। টেস্ট খেলুড়ে দল হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৩২ সালে। বলা চলে, ভারতের ক্রিকেট সংস্কৃতি যথেষ্ট গভীর।

সময়ের পালাবদলে বিশ্ব ক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ভারত। আধুনিক ক্রিকেট মানেই ভারত, ক্রিকেটের তুমুল জনপ্রিয়তার দিক থেকে ভারতের ধারেকাছে কেউ নেই। মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে দাপুটে দেশ ভারত। বর্তমানে আইসিসি ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় সেরা দল ভারত। টেস্ট ও টি-টুয়েন্টিতে যথেষ্ট প্রথম ও পঞ্চম অবস্থানে আছে ভারত।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তা পরিস্কার হওয়া যায় বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচ থেকেই। ইংল্যান্ডের ৩৩৪ রানের জবাবে পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে রান করে মাত্র ১৩২। ঐ বিশ্বকাপ তো বটেই। পরের বিশ্বকাপেও প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেয় ভারত। ১৯৮৩ সালে এসে কপিল দেবের ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দেয়। অবিশ্বাস্য ফর্মে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপ ফাইনালে হারিয়ে ইতিহার গড়ে ভারত, অথচ এর আগের দুই বিশ্বকাপে মাত্র একটি ম্যাচে জয় পেয়েছিল দেশটি। ২০০৩ সালে এসে ফের বিশ্বকাপ ফাইনালে জায়গা পায় সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত। তবে রিকি পন্টিংয়ের অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরিতে ভারতকে হারায় অস্ট্রেলিয়া। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ভারত। ২০১১ সালে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে এসে ২৮ বছরের শিরোপার খরা কাটিয়ে ওঠে ভারত। শ্রীলঙ্কাকে ফাইনালে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। এরপর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম ধারবাহিক দল ভারত। ২০১৫ বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে খেলে তারা। হট ফেভারিটের তকমা নিয়ে মাঠে নামবে ২০১৯ বিশ্বকাপেও।

এবারের বিশ্বকাপে বরাবরের মত ব্যাটিং হবে ভারতের শক্তির জায়গা। রোহিত শর্মা, শেখর ধাওয়ানের পর আধুনিক ক্রিকেটের গ্রেট ভিরাট কোহলি গত বিশ্বকাপ থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের ৬০ শতাংশ রান করেছেন। বড় ইনিংস খেলার অবিশ্বাস্য দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা বাকি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের থেকে এই তিন ব্যাটসম্যানকে আলাদা করবে। আর আইসিসি ইভেন্টে এই তিন ব্যাটসম্যানের যুগলবন্ধি অতুলনীয়। লোয়ার মিডেল অর্ডারে আরেক রান মেশিন এমএস ধোনি থাকবেন ম্যাচ শেষ করে আসার দায়িত্বে।

ভারতের শিরোপা জয়ের অন্যতম ভরসার নাম বিশ্বের নম্বর ওয়ান ফাস্ট বোলার জাসপ্রিত বুমরাহ। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতীয় দলের বোলিং আক্রমণে নেতা বনে গেছেন তিনি। দুই রিস্ট স্পিনার কুলদিপ যাদব ও যুগেন্দ্র চাহাল ভারতের বোলিং আক্রমণকে আরও শাণিত করেছে। মোহাম্মদ শামি ও ভুবনেশ্বর কুমাররাও নিজের দিনে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন।

ভারতের স্কোয়াড বিশ্লেষণঃ

ভিরাট কোহলিঃ জীবনের সেরা ফর্ম নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন ভারতের কাপ্তান ভিরাট কোহলি। ক্রিকেট বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বাড়তি চাপ নিয়ে খেলতে হবে কোহলিকে। এখন পর্যন্ত ২২৭ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ৪১টি সেঞ্চুরি ও ৪৯টি ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৩০ বছর বয়সী এই মডার্ন গ্রেট। ৯২ স্ট্রাইক রেট ও ৫৯ গড় যে কোনো ব্যাটসম্যানের ঈর্ষা জাগাতে বাধ্য। বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে নিঃসন্দেহে বোলারদের রাতের ঘুম হারাম করবেন তিনি।

মহেন্দ্র সিং ধোনিঃ ওয়ানডে ক্রিকেটের আধুনিক গ্রেটদের তালিকা করতে গেলে সবার ওপরে থাকবে মহেন্দ্র সিং ধোনির নাম। ৩৪১ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ৫০ ছাড়ানো গড়ে ১০৫০০ রানের মালিক ধোনি ক্যারিবিয়ারের শেষ প্রান্তে এসেও ভারতীয় দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন। মিডেল অর্ডারে ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। উইকেটের পেছনে এখনো ৩৭ বছর বয়সী ধোনির সমকক্ষ কেউ নেই। 

হার্দিক পান্ডিয়াঃ ব্যাটে-বলে বিশ্বকাপে ভারতের এক্স ফ্যাক্টর হতে পারেন অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া। ৪৫ ওয়ানডে খেলা প্রায় ৩০ গড় ও ১১৬ স্ট্রাইক রেটে ৭৩১ রান করা হার্দিক লোয়ার অর্ডারে দ্রুত রান তোলায় পারদর্শী। বল হাতেও যথেষ্ট কার্যকরী তিনি। মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং দিয়ে ইতিমধ্যে ৪৫ ম্যাচে ৪৪ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।

জাসপ্রিত বুমরাহঃ এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের ছোট্ট তালিকা করলে শীর্ষে থাকবেন ভারতের জাসপ্রিত বুমরাহ। মাত্র ৪৯ ম্যাচ খেলেই ৮৫ উইকেটের মালিক বনে গেছেন ২৫ বছর বয়সী বুমরাহ। চারবার ৪ উইকেট ও একবার ৫ উইকেট শিকার করেছেন ছোট্ট ক্যারিয়ারেই। বিশ্বকাপে ইনিংসের শুরু ও শেষে ভারতের ট্র্যাম্প কার্ড হবেন এই ফাস্ট বোলার।

যুগেন্দ্র চাহালঃ লেগ স্পিনারের যুগে ভারতের স্পিন আক্রমণের নেতৃত্ব দিবেন ২৮ বছর বয়সী যুগেন্দ্র চাহাল। ৪১ ওয়ানডে ম্যাচে ৭২ উইকেটের মালিক চাহাল ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়মিত সাফল্য পেয়ে আসছেন। আরেক রিস্ট স্পিনার কুলদিপ যাদবের সাথে জুটি বেঁধে ভারতের বোলিং আক্রমণকে আরও শাণিত করেছেন তিনি।

রোহিত শর্মাঃ ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকেই আইসিসি ইভেন্টে অবিশ্বাস্য ফর্ম ধরে রেখেছেন রোহিত শর্মা। ওয়ানডে ক্রিকেটে দুইশ হাঁকানো এই ওপেনারের জন্য নিজের দিনে আকাশ হচ্ছে সীমানা। উইকেটে একবার জমে গেলে লম্বা চওড়া ইনিংস খেলার অভ্যাস তাঁর। ওয়ানডে ক্রিকেটে ভারতের আধিপত্যের পেছনে কোহলির সাথে কৃতিত্ব রোহিতকেও দিতে হয়। ২০৬ ওয়ানডে খেলে ৮ হাজার রানের মালিক তিনি। নামের পাশে সেঞ্চুরি সংখ্যা ২২টি, ডাবল সেঞ্চুরি ৩টি।

শিখর ধাওয়ানঃ রোহিতের মতই আইসিসি ইভেন্টের মেগা পারফর্মার বাঁহাতি ওপেনার ধাওয়ান। ভারতের শক্তিশালী টপ থ্রি’র তৃতীয় ভিত্তি ধাওয়ান। প্রায় একশ স্ট্রাইক রেটে রান করে আসা ধাওয়ান এক কথায় একজন ম্যাচ উইনার। ১২৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ৫৩৫৫ রানের মালিক তিনি। ১৬টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ইতিমধ্যেই।

দীনেশ কার্তিকঃ ২০০৪ সাল থেকে এমএস ধোনির ছায়ায় ক্যারিয়ার কেটে গেলেও ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছেন কার্তিক। তবে এবারো ধোনির ব্যাকআপ কিপার ব্যাটসম্যানের খোঁজ করতে গিয়েই কার্তিকের নাম সবার ওপরে আসে। তরুণ রিশাব পান্তকে দলে না নেয়ায় নির্বাচকদের অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে কার্তিকের অভিজ্ঞতাকেই বিশ্বকাপে ব্যবহার করতে চায় ভারত। সুযোগ পেলে কেমন করে সেটাই দেখার বিষয়।

বিজয় শঙ্করঃ তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল বিজয় শঙ্কর নাকি আম্বাতি রাইডুকে নিয়ে, কে থাকবেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। ব্যাটে বলে ও ফিল্ডিংয়ে এগিয়ে বিধায় সুযোগ মিলে মাত্র ৯ ওয়ানডে খেলা শঙ্করের। বড় শট খেলার সামর্থ্য আছে এই অলরাউন্ডারের। বিশ্বকাপে মূল একাদশে সুযোগ পেতে হবে হার্দিকের সাথে লড়াই করতে হবে তাঁকে।

লোকেশ রাহুলঃ ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বরের সমাধান হতে পারেন প্রতিভাবান লোকেশ রাহুল। মাত্র ১৪ ওয়ানডে খেললেও ছোট্ট ক্যারিয়ারে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। মূলত ওপেনার হলেও বিশ্বকাপের চাহিদা অনুযায়ী চার নম্বরে খেলতে হতে পারে রাহুলকে।

কেদার যাদবঃ ইনজুরির সাথে লড়াই করে আসছেন কেদার যাদব। বিশ্বকাপের আগে আইপিএলে চোট পান তিনি। তবে মূল আসরের আগে ফিটনেস ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি। ওয়ানডেতে কেদারের রেকর্ড চোখ আটকে যাওয়ার মতন। ৫৯ ম্যাচ খেলে ৪৩ গড় ও ১০২ স্ট্রাইক রেটে ১১৭৪ রান করেছেন তিনি। ২টি সেঞ্চুরি, ৫টি ফিফটিও হাঁকিয়েছেন তিনি। অফ স্পিন দিয়েও অধিনায়ককে সাহায্য করতে পটু তিনি।

ভুবনেশ্বর কুমারঃ ১০৫ ওয়ানডে খেলে ১১৮ উইকেট শিকার করা ভুবনেশ্বর কুমার বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারেন। ইংলিশ কন্ডিশনে নতুন বলে সুইং করাতে সক্ষম বোলাররা এক স্পেলে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। আইপিএলে ভালো ফর্মে না থাকলেও দেশের হয়ে বড় মঞ্চে পারফর্মেন্স দিতে মুখিয়ে থাকবেন তিনি।

মোহাম্মদ সামিঃ ২০১৯ সালে দারুণ ফর্মে আছেন মোহাম্মদ শামি। আইপিএল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিত উইকেট শিকার করে আসছেন। বিশ্বকাপে জাসপ্রিত বুমরাহর সাথে শামিই হবেন নতুন বলের কাণ্ডারি। ৬৩ ওয়ানডে খেলে ১১৩ উইকেট নেয়া এই ডানহাতি ফাস্ট বোলার ২০১৫ সালেও দারুণ বিশ্বকাপ কাটিয়েছিলেন।

রবীন্দ্র জাদেজাঃ বাড়তি স্পিনার হিসেবে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা মিলেছে জাদেজার। বাঁহাতি স্পিন ও সাথে লোয়ার অর্ডার ব্যাটিংয়ে পটু তিনি। একই সাথে বিশ্বের সেরা ফিল্ডারদের একজন। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো পারফর্ম করলেও মূল একাদশে জায়গা মিলবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।

কুলদীপ যাদবঃ বিশ্বকাপে ভারতের তরুপের তাস হতে পারেন চায়নাম্যান কুলদিপ যাদব। ছোট্ট ক্যারিয়ারে ৪৪ ম্যাচ খেলে ইতিমধ্যে ৮৭ উইকেট শিকার করে ফেলেছেন তিনি। চাহালের সাথে জুটি বেঁধে মিডেল ওভারে রান আটকে উইকেট নেয়াকে শিল্পে পরিণত করেছেন এই দুই রিস্ট স্পিনার। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন কুলদিপ। সেখান থেকে পেছনে ফিরতে হয়নি তাঁকে।