বিশ্বকাপ স্পেশাল

ইতিহাসে ১৯৮৩ এর বিশ্বকাপ

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 14:33 সোমবার, 20 মে, 2019

|| বিশ্বকাপ স্পেশাল ||

১৯৮৩ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন করে ইংল্যান্ড। পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় এবারও ছিল লন্ডনভিত্তিক প্রুডেন্সিয়াল অ্যাসিওরেন্স কোম্পানি। অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা আটই ছিল, তবে পরিবর্তন এসেছিল ফরম্যাটে। গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ডাবল-লিগ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ গ্রুপের প্রতিটি দল একে অপরের সঙ্গে খেলেছিল দুবার করে। যে কারণে টুর্নামেন্টের ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাতাশে।

ফরম্যাটের পাশাপাশি নতুনত্ব এসেছিল টুর্নামেন্টের আইন-কানুনেও। প্রথমবারের মতো তিরিশ গজের সার্কেলের ব্যবহার প্রচলিত ওয়ানডে ক্রিকেটের ধারাকেই বদলে দিয়েছিল। তখনকার দিনে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের নিয়মটা ছিল পুরো ৬০ ওভারই অন্তত চারজন ফিল্ডার সার্কেলের ভেতরে রাখতে হবে। এছাড়া ওয়াইড বল ও বাউন্সারের ব্যাপারেও আম্পায়ারদের কঠোর হওয়ার নির্দেশনা ছিল আইসিসির পক্ষ থেকে। ফলে সেবার ম্যাচপ্রতি ওয়াইডের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে ঠেকেছিল! ১৯৭৯ বিশ্বকাপে ম্যাচপ্রতি ওয়াইডের সংখ্যা ছিল যেখানে ৪.৬৪, পরের আসরেই সেটি ৯.৫৯!

১৯৮৩ বিশ্বকাপ আরও একটি কারণে আলাদা। এবারই প্রথম টেস্ট ভেন্যুর বাইরে পা রাখে টুর্নামেন্টটি। মোট ভেন্যুর সংখ্যা ছিল ১৫! সেন্ট হেলেন্স, টন্টন, টানব্রিজ ওয়েলস, গ্রেস রোড, চেমসফোর্ডের মতো এমন কয়েকটি ভেন্যুতে ম্যাচ আয়োজন করা হয়, যেখানে আগে কোনদিন টেস্ট ম্যাচ হয়নি।

উল্লেখ্য, সেবার অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একমাত্র জিম্বাবুয়েই ছিল টেস্ট পরিবারের বাইরে। আগের দুবার সহযোগী দেশ হিসেবে অংশ নেয়া শ্রীলঙ্কা ততদিনে টেস্ট মর্যাদা পেয়ে গেছে। টুর্নামেন্টের ফরম্যাট ঠিক রাখতে তাই কেবল সুযোগ দেয়া হয়েছিল আইসিসি ট্রফির চ্যাম্পিয়ন দলকেই। ফাইনালে উঠেও তাই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয়েছিল তখনকার সাড়া জাগানো দল বারমুডাকে।

গ্রুপ পর্বের সূচনাটা ছিল নাটকীয়তায় ভরা। নাটকীয়তা বললেও কম বলা হয়। টুর্নামেন্টের প্রথম দিনেই দুটি অঘটন! 'বি’ গ্রুপের উদ্বোধনী ম্যাচে দুই হট ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছিল জিম্বাবুয়ে ও ভারত।

জিম্বাবুয়ের জন্য এটি ছিল বিশ্বকাপ তো বটেই, নিজেদের ইতিহাসে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ট্রেন্টব্রিজে প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৬০ ওভারে জিম্বাবুয়ে করেছিল ২৩৯ রান। সর্বোচ্চ ৬৯ রান এসেছিল বাঁহাতি ডানকান ফ্লেচারের ব্যাট থেকে। জবাবে কেপলার ওয়েসেলসের দায়িত্বশীল ৭৬ রানের ওপর ভর করে জয়ের পথেই এগোতে থাকে অস্ট্রেলিয়া। তবে মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত ১৩ রানের হার নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। ব্যাটিংয়ের পর বল হাতেও ৪২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন ডানকান ফ্লেচার।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে 'বি' গ্রুপের আরেক ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আন্ডারডগ ভারতের ৩৪ রানের জয়টাকেও দেখা হয় অঘটন হিসেবেই। কেননা আগের দুই আসর মিলিয়ে ভারতের জয় ছিল মাত্র একটি; তাও দুর্বল পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে! যেখানে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এটি ছিল বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম হার!

যশপাল শর্মার অনবদ্য ৮৯ রানের সৌজন্যে প্রথমে ব্যাট করে ভারত পেয়েছিল ২৬২ রানের লড়াকু পুঁজি। জবাবে গ্রিনিজ-হেইন্সের ব্যাটে শুরুটা ভাল হলেও রজার বিনি, মদনলাল, রবি শাস্ত্রীদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত ২২৮ রানে অলআউট হয় লয়েড বাহিনী।

অবশ্য প্রথম ম্যাচেই হারের ধাক্কাটা তারা সামলে উঠেছিল দারুণভাবে। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে সবার আগে জায়গা করে নিয়েছিল সেমিফাইনালে। আর চারটি জয় নিয়ে তাদের সঙ্গী হয়েছিল কপিল দেবের ভারত। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, বিগত আসরের ন্যায় এবারও অস্ট্রেলিয়ার পারফরম্যান্স ছিল বিবর্ণ। ভারত এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র দুটি ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছিল কিম হিউজের দল।

প্রথম দিন অঘটনের শিকার দুই 'পরাশক্তি' ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয়েছিল নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে। ওই ম্যাচেই বিশ্বকাপ ইতিহাসের তৎকালীন সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়েছিলেন ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার উইন্সটন ডেভিস। মার্শাল, গার্নার, হোল্ডিং, রবার্টসদের দাপটে যার একাদশে জায়গা পাওয়াই দায়!

প্রথমে ব্যাট করে ল্যারি গোমেজের ৭৮ রানের সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৯ উইকেটে ২৫২। জবাব দিতে নেমে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল ২ উইকেট ১১৪। ঠিক তখনই অজি ইনিংসের ওপর দিয়ে বয়ে গেল এক প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন! ৫ ওভারের প্রথম স্পেলে ৩৭ রানে ১ উইকেট পাওয়া ডেভিস ধারণ করলেন রুদ্রমূর্তি! ৩৩ বলের বিধ্বংসী এক স্পেলে গুঁড়িয়ে দিলে অজি মিডল অর্ডার; মাত্র ১৪ রানে তুলে নিলেন ৬ উইকেট! ১১৪/২ থেকে ১৫১ রানে অলআউট অস্ট্রেলিয়া! সব মিলিয়ে তাঁর ম্যাচ ফিগার দাঁড়াল ১০.৩-০-৫১-৭! বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড হিসেবে যেটি টিকে ছিল আরও অন্তত ২০ বছর।

জিম্বাবুয়ে বনাম ভারতের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটি ছিল গ্রুপ পর্বের সবচাইতে আকর্ষণীয় ম্যাচ। সেমিফাইনালে ওঠার আশা জিইয়ে রাখতে সেই ম্যাচে জয়ের কোন বিকল্প ছিল না ভারতের। অথচ প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে মাত্র ১৭ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে তারা! টানব্রিজ ওয়েলসের সিমিং উইকেটে জিম্বাবুইয়ান পেসারদের সর্পিল সুইং-মুভমেন্টে ভারত রীতিমতো কাঁপছিল। সেখান থেকে ভারতের স্কোরটা ২৬৬ রান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বটা ছিল অধিনায়ক কপিল দেবের। ১৬টি চার এবং ৬টি ছক্কার সাহায্যে তিনি খেলেছিলেন ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের 'মহাকাব্যিক' এক ইনিংস! ৯ম উইকেট জুটিতে উইকেটরক্ষক সৈয়দ কিরমানিকে নিয়ে যোগ করেছিলেন ১২৬ রান যেখানে কিরমানির অবদান মাত্র ২৪!

উইজডেনের চোখে গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় চার নম্বরে আছে কপিলের ইনিংসটি। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটিকে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইনিংস বলেও মনে করেন অনেকে।

উইজডেনের ভাষায়, “It was an innings of rare brilliance, the like of which is seen perhaps once in a decade."

বিশিষ্ট ক্রীড়ালেখক অরুণাভ সেনগুপ্তের ভাষায়, “Kapil’s innings was extended to strokes of ingenuity, from the scorching square cut to the searing cover drive to the agricultural pull stroke, in the manner of Lord Nataraj doing the cosmic Tandav dance.”

 

জবাব দিতে নেমে মদনলাল, রজার বিনি, অমরনাথদের জেন্টল মিডিয়াম পেসের সামনে মোটেই সুবিধা করতে পারছিল না জিম্বাবুইয়ানরা। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য থেকে ৩১ রান দূরে থাকতে অলআউট হয় তারা। বর্তমানে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা স্যাম ও টম কারেনের বাবা কেভিন কারেনের ৭৩ রানের ইনিংসটি কেবল ব্যবধানই কমিয়েছিল। ১৭৫ রানের অতিমানবীয় ইনিংসের পর বল হাতে ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন কপিল দেব।

'বি' গ্রুপের তুলনায় 'এ’ গ্রুপের ম্যাচগুলোতে নাটকীয়তা তেমন একটা ছিল না। একমাত্র 'অঘটন' বলতে আগের দুই আসরের সেমিফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট পরিবারের নবীনতম সদস্য শ্রীলঙ্কার জয়।

ডার্বি কাউন্টি গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত গ্রুপের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে সবকটি উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড করেছিল ১৮১ রান। মাত্র ৩২ রানে ৫ উইকেট নিয়ে কিউই শিবিরে ধস নামিয়েছিলেন ডানহাতি পেসার অশান্থ ডি মেল। জবাবে উইকেটরক্ষক ব্রেন্ডন কুরুপ্পু (৬২) এবং রয় ডায়াসের (৬৪*) 'জোড়া' ফিফটিতে শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেটের অবিস্মরণীয় এক জয় তুলে নেয় লঙ্কাবাহিনী।

এদিকে ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে পা রাখে ইংল্যান্ড। একটা মাত্র ম্যাচ তারা হেরেছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল নিউজিল্যান্ডের কাছে। 

এজবাস্টনে স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে কিউইদের জয়টা এসেছিল মাত্র ২ উইকেটের ব্যবধানে। সে যুগের 'স্টাইল আইকন' ডেভিড গাওয়ারের ৯২ বলে ৯৬ রানের স্ট্রোক ঝলমলে ইনিংস (৪ ছক্কা, ৬ বাউন্ডারি) সত্ত্বেও ২৩৪ রানের বেশি করতে পারে নি ইংল্যান্ড। যার পেছনে মূল কৃতিত্বটা ছিল স্যার রিচার্ড হ্যাডলি (৩/৩২) ও ক্রিস কেয়ার্নসের বাবা ল্যান্স কেয়ার্নসের (৩/৪৪) দুর্দান্ত ডেথ বোলিং। ইংলিশরা শেষ ৬ উইকেট হারিয়েছিল মাত্র ৩১ রানে! 

জবাবে ইংলিশ পেসার বব উইলিসের (৪/৪২) তোপে ৭৫ রানের মধ্যেই গ্লেন টার্নার, মার্টিন ক্রো'সহ টপ অর্ডারের ৪ ব্যাটসম্যানের উইকেট হারিয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। অবশেষে জেরেমি কনির ব্যাটে চড়ে ঘুরে দাঁড়ায় দলটি। 'ম্যাচসেরা' কনির ৯৭ বলে ৬৬ রানের হার না মানা ইনিংসের সৌজন্যে ৫ বল বাকি থাকতেই ২ উইকেটের নাটকীয় এক জয় তুলে নেয় ব্ল্যাক ক্যাপসরা। 

'এ' গ্রুপে ইংলিশদের সঙ্গী হওয়ার লড়াইটা ছিল বেশ জমজমাট। গ্রুপ পর্ব শেষে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড দু’দলেরই ছিল সমান তিনটি করে জয়। শেষ পর্যন্ত নেট রানরেটে এগিয়ে থাকায় নিউজিল্যান্ডকে (৩.৯২৭) পেছনে ফেলে শেষ চার নিশ্চিত করেছিল পাকিস্তান (৪.০১৪)।

আগের আসরের তুলনায় এই আসরের সেমিফাইনাল পর্বটা ছিল ম্যাড়মেড়ে। বলা যায় দুটি সেমিফাইনালই ছিল একতরফা।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রথম সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়েছিল ভারত। এদিন উইকেট ছিল কিছুটা স্লো এবং নিচু বাউন্সের। যেখানে বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল ভারতীয় স্পিনার এবং মিডিয়াম পেসাররা। কপিল, অমরনাথ, কীর্তি আজাদদের আটোসাঁটো বোলিং ইংল্যান্ডকে আটকে দিয়েছিল ২১৩ রানে।

জবাবে যশপাল শর্মার ৬১ এবং সন্দ্বীপ পাতিলের 'ঝড়ো' ৫১ রানের (৩২ বলে) সৌজন্যে ২১৪ রানে লক্ষ্যটা সহজেই টপকে যায় কপিল দেবের দল। ব্যাট হাতে ৪৬ রান ও বল হাতে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন মহিন্দর অমরনাথ।

অন্যদিকে লন্ডনের কেনিংটন ওভালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ক্যারিবীয় পেসারদের তোপের মুখে পড়েছিল পাকিস্তান। ৬০ ওভারের সংগ্রাম শেষে স্কোরবোর্ডে জমা করেছিল ৮ উইকেটে মাত্র ১৮৪ রান। ওপেনার মহসিন খানের ৭০ রান ছাড়া বলার মত কিছু ছিল না তাদের ইনিংসে। জবাবে ভিভ রিচার্ডস (৮০*) ও ল্যারি গোমেজের (৫০*) ফিফটিতে ৬ ওভার বাকি থাকতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেয়েছিল ৮ উইকেটের অনায়াসে জয়।

২৫ জুন, ১৯৮৩। লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারত। টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। পেসবান্ধব সবুজ উইকেটে শুরু থেকেই গার্নার, মার্শাল, হোল্ডিং, রবার্টসরা মিলে চেপে ধরেছিল ভারতকে। শেষ পর্যন্ত সবকটি উইকেট হারিয়ে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৮৩ রান। সর্বোচ্চ ৩৮ রান আসে ওপেনার কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের ব্যাট থেকে।

৬০ ওভারে লক্ষ্য মাত্র ১৮৪ রান। ক্যারিবীয়দের টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল কেবলই সময়ের অপেক্ষা!

জবাব দিতে নেমে শুরুতেই পেসার বলবিন্দর সান্ধুর আঘাত। মাত্র ১ রানে বোল্ড হয়ে ফিরে যান ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ। এদিকে স্যার ভিভ রিচার্ডস নেমেই শুরু করেন আক্রমণ। ৭ বাউন্ডারিতে মাত্র ২৭ বলে পৌঁছে যান ৩৩ রানে। কিন্তু মিডিয়াম পেসার মদনলালকে হুক করতে গিয়ে হঠাৎ টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেলেন তিনি। শূন্যে উঠে যাওয়া বলটিকে প্রায় ২০ গজ পেছন থেকে তাড়া করে ডিপ স্কয়ার লেগে অবিশ্বাস্যভাবে লুফে নেন কপিল! ব্যস, তাতেই মোড় ঘুরে যায় ম্যাচের!

ভিভের আউটের পরই যেন মড়ক লাগে ক্যারিবিয়ান ইনিংসে। মদনলাল-রজার বিনির মিডিয়াম পেস আর অমরনাথের স্লো মিডিয়ামে ধরাশায়ী হয় বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ। ৫৭/২ স্কোর থেকে শেষ পর্যন্ত তারা অলআউট হয় ১৪০ রানে। ব্যাট হাতে ২৬ রান এবং ৭ ওভার বোলিংয়ে মাত্র ১২ রানে ৩ উইকেট শিকারে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ম্যাচসেরা হন মহিন্দর অমরনাথ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ভারত: ৫৪.৪ ওভারে ১৮৩ অলআউট (শ্রীকান্ত ৩৮, পাতিল ২৭, অমরনাথ ২৬, রবার্টস ৩/৩২)

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৫২ ওভারে ১৪০ অলআউট (ভিভ রিচার্ডস ৩৩, জেফ্রি ডুজন ২৫, অমরনাথ ৩/১২, মদনলাল ৩/৩১)

ম্যাচসেরা: মহিন্দর অমরনাথ।

মজার ব্যাপার হল, গ্রুপ পর্বের উদ্বোধনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একবার হারালেও খুব বেশি লোক সেটিকে পাত্তা দেয়নি। তারপর যখন ফাইনালে এই দুটি দল মুখোমুখি হল তখনও সবাই ভেবেছিল, এক অঘটন কি আর দু’বার ঘটবে নাকি? কিন্তু সবার অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনের জন্ম দিয়েছিল কপিল দেবের ভারত।

ফাইনালে ব্যাট হাতে (৮ বলে ১৫ রান) জ্বলে উঠতে না পারলেও ৮ ম্যাচে ১২ উইকেট, ১ সেঞ্চুরিসহ ৩৩০ রান এবং ৭টি ক্যাচ নিয়ে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কপিল দেব। অনেকের চোখে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিলের অপরাজিত ১৭৫ রানের ইনিংসটাই ছিল টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। কপিলের ইনিংসটি না থাকলে হয়ত বিশ্বকাপের ইতিহাসটাই অন্যভাবে লেখা হত। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় সেই জয়ের পরই টানা চার ম্যাচ জিতে শিরোপা ঘরে তোলে ভারত।

এবারে চলুন এক নজরে দেখে নিই ১৯৮৩ বিশ্বকাপের উল্লেখযোগ্য কিছু পরিসংখ্যান।

ব্যাটিং:

• সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর: পাকিস্তান ৩৩৮/৫, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।

• সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক: ডেভিড গাওয়ার (ইংল্যান্ড) ৭৬.৮০ গড়ে ৩৮৪ রান; দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ভিভ রিচার্ডস (উইন্ডিজ) ৭৩.৪০ গড়ে ৩৬৭ রান।

• ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস: কপিল দেব ১৭৫*, বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।

• সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি: ১টি করে কপিল দেব (ভারত), ডেভিড গাওয়ার (ইংল্যান্ড), অ্যালান ল্যাম্ব (ইংল্যান্ড), ভিভ রিচার্ডস (উইন্ডিজ), গর্ডন গ্রিনিজ (উইন্ডিজ), জহির আব্বাস (পাকিস্তান), ইমরান খান (পাকিস্তান) ও ট্রেভর চ্যাপেল (অস্ট্রেলিয়া)।

• সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরি: ৪টি, গ্রায়েম ফাউলার (ইংল্যান্ড)।

বোলিং:

• সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি: রজার বিনি (ভারত) ১৮ উইকেট; এছাড়া শ্রীলঙ্কার অশান্থ ডি মেল এবং ভারতের মদন লাল নিয়েছিলেন ১৭টি করে উইকেট।

• সেরা বোলিং: উইন্সটন ডেভিস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ৭/৫১, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।

• ৫ উইকেট: ৮টি, সর্বোচ্চ দুবার ৫ উইকেট নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার অশান্থ ডি মেল (৫/৩২ ও ৫/৩৯)।

উইকেটকিপিং:

• সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: জেফ্রি ডুজন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), ১৬টি।

• এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: ৫টি, সৈয়দ কিরমানি (ভারত), বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।

ফিল্ডিং:

• সর্বোচ্চ ক্যাচ: ৭টি, কপিল দেব (ভারত)।