ক্রিকেট লিজেন্ডস

নিল জনসনঃ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্মের তারকা

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 10:45 রবিবার, 24 মার্চ, 2019

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় 'জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ'। যে সময়টায় জিম্বাবুয়েকে দেখা হত অত্যন্ত সমীহের চোখে, গণ্য করা হত বিশ্ব ক্রিকেটের 'উঠতি পরাশক্তি' হিসেবে; যারা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে পৃথিবীর যেকোন টিমকে হারিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখত। অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, মারে গুডউইন, স্টুয়ার্ট কার্লাইল, ফ্লাওয়ার ব্রাদার্সের মত 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস' ব্যাটসম্যান; হিথ স্ট্রিক, পল স্ট্র্যাং, হেনরি ওলোঙ্গার মত 'উইকেটশিকারি' বোলার আর নিল জনসন, গাই হুইটাল, অ্যান্ডি ব্লিগনটের মত 'জেনুইন' অলরাউন্ডার নিয়ে গড়া দলটা সত্যিকার অর্থেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়।

ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের সেই 'সোনালী প্রজন্মের' অন্যতম কান্ডারি ছিলেন নিল জনসন। তাঁকে মনে করা হয় জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার ও অন্যতম সেরা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। 'এগ্রেসিভ' স্ট্রোকপ্লে আর 'বৈচিত্র্যপূর্ণ' মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়ে যিনি জয় করেছিলেন অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়।

১৯৭০ সালের ২৪ জানুয়ারি, তৎকালীন রোডেশিয়ার সালিসবুরিতে (বর্তমান হারারে) জন্মগ্রহণ করেন নিল জনসন। তবে জন্মের পরপরই বাবা-মায়ের সাথে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। ক্রিকেটের হাতেখড়িটাও হয়েছিল সেখানেই।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জনসনের অভিষেক মাত্র ষোল বছর বয়সে। খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের দল বোল্যান্ড, ইস্টার্ন প্রভিন্স, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স আর নাটালের হয়ে। ১৯৯৪-৯৫ সালে সাউথ আফ্রিকার 'এ' দলেও একবার সুযোগ পেয়েছিলেন! মজার ব্যাপার হল, 'এ' দলের সেই সিরিজটাও ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে!

১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে জনসন চলে যান ইংল্যান্ডে। চুক্তিবদ্ধ হন কাউন্টি দল লিস্টারশায়ারের সাথে। সেখানে দু'বছর খেলে ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার আজীবন লালিত স্বপ্নটা পূরণ হতে অবশ্য একদমই সময় লাগে নি।

১৯৯৮ সালের ৭ অক্টোবর, হারারেতে ভারতের বিপক্ষে তাঁর টেস্ট অভিষেক। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই ব্যর্থ হলেও (৪ ও ১ রান) তিনি ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিলেন বল হাতে। প্রথম ইনিংসে ৬৪ রান খরচায় ১টি আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪১ রানের বিনিময়ে নেন ৩টি উইকেট। সবচেয়ে বড় কথা, শেষ পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে ম্যাচটি জিতেছিল ৬১ রানে।

উল্লেখ্য, জনসনের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেটটা ছিল বেশ দামী। ব্যাটসম্যানের নামটা যে শচীন টেন্ডুলকার!

একই বছর ডিসেম্বরে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তান সফরে যায় জিম্বাবুয়ে। সেখানেই প্রথমবারের মত ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন এই প্রতিভাবান রোডেশিয়ান। ক্যারিয়ারের 'প্রথম' টেস্ট সেঞ্চুরিটাও পেয়ে যান ওই সিরিজেই।

'ঐতিহাসিক' পেশোয়ার টেস্টে সতীর্থদের ব্যর্থতার মিছিলে ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন নিল জনসন। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আকিব জাভেদ আর সাকলায়েন মুশতাকের মত বোলারকে সামলেছিলেন শক্ত হাতে। খেলেছিলেন ১৬ বাউন্ডারিতে সাজানো ১১৭ বলে ১০৭ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। যে ইনিংসের সৌজন্যে জিম্বাবুয়ে পেয়েছিল ৭ উইকেটের অবিস্মরণীয় এক জয়!

উল্লেখ্য, ওটাই ছিল 'দেশের বাইরে' টেস্ট ক্রিকেটে আফ্রিকান দেশটির প্রথম সাফল্য।

ক্রিকেটার হিসেবে নিল জনসনকে মানুষ কেন মনে রাখবে? তাঁকে মনে রাখার হাজারটা কারণ থাকতে পারে, তবে একটা কারণ অবশ্যই '৯৯ বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সপ্তম আসর মাতানো যে কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন ল্যান্স ক্লুজনার, শেন ওয়ার্ন, রাহুল দ্রাবিড়, স্টিভ ওয়াহ, জিওফ অ্যালট আর নিল জনসন। তা মনে রাখার মত কী এমন করেছিলেন জনসন? চলুন সে গল্পটাই একটু জেনে আসি।

জিম্বাবুয়ে ছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপের 'সারপ্রাইজ প্যাকেজ'। যারা ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তিকে হারিয়ে পেয়েছিল 'জায়ান্ট কিলারের' তকমা; প্রথমবারের মত সুপার সিক্স রাউন্ডে কোয়ালিফাই করার মধ্য দিয়ে গড়েছিল ইতিহাস। আফ্রিকান দেশটির এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে 'নেপথ্য কারিগর' ছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে নিল জনসন অন্যতম। বিশেষ করে, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে বাঁচামরার লড়াইয়ে ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ খেলা জনসন ৩টি ম্যাচে জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ৮ ম্যাচ খেলে ৫২.৪ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৩৬৭ রান। ১ সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি ছিল ৩টি। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১২টি উইকেট। অনেকের মতে, '৯৯ বিশ্বকাপে জনসনের ইম্প্যাক্ট 'টুর্নামেন্ট-সেরা' ক্লুজনারের থেকে কোন অংশে কম ছিল না।

বলাবাহুল্য, জিম্বাবুয়ের পক্ষে আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সর্বাধিক উইকেটশিকারি দুটোই ছিলেন নিল জনসন! একেই বুঝি বলে 'লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট'!

চলুন এক নজরে দেখে নিই '৯৯ বিশ্বকাপে জনসনের উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলো-

❐ কেনিয়ার বিপক্ষে ৫৯ রান ও ৪২ রানে ৪ উইকেট।

❐ সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৬ রান ও ২৭ রানে ৩ উইকেট (গ্যারি কার্স্টেন ও জ্যাক ক্যালিসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেটসহ)।

❐ সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩২* রান ও ৪৩ রানে ২ উইকেট।

❐ সুপার সিক্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫৪ রান ও ৩৯ রানে ১ উইকেট।

১৯৯৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজে ইনফর্ম 'মুরালি-ভাস' জুটির সামনে অসহায় জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার মিছিলে জনসন ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও অধিনায়ক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও নিল জনসনের ব্যাটিং দৃঢ়তায় একটি টেস্ট ড্র করতে সমর্থ হয়েছিল স্বাগতিকরা। মুরালির 'দুসরা' আর ভাসের 'আউটসুইঙ্গার' সামলে জনসন হাঁকিয়েছিলেন দুটি 'লড়াকু' ফিফটি (৫২* ও ৭০)।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিল জনসনের উত্থান দেখে অনেকে মনে করেছিলেন হয়ত আরেকজন 'গ্রেট অলরাউন্ডার' পেতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, "Not every story has a happy ending". জনসনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। মাত্রই তিরিশের কোঠা পেরিয়েছেন, এমন সময় আচমকাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেন তিনি।

২০০০ সালের ইংল্যান্ড সফরের পরপরই জনসনের আকস্মিক এই সিদ্ধান্তের পেছনে আসল কারণটা কী ছিল সেটা অবশ্য জানা যায় নি। তবে বোর্ডের সাথে পারিশ্রমিক নিয়ে বনিবনা না হওয়া, তৎকালীন কোচ ডেভ হটনের সাথে মতবিরোধ, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বর্ণবৈষম্য — সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

জাতীয় দলের হয়ে না খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও বেশ কিছুদিন খেলা চালিয়ে গেছেন তিনি। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে নতুন করে চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন কাউন্টি দল হ্যাম্পশায়ারের সঙ্গে। সেখানে বছর চারেক খেলার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরনের ক্রিকেটকেই বিদায় বলে দেন তিনি। অবসরের পর স্থায়ীভাবে বসত গড়েন শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণ আফ্রিকায়।

জনসনের খেলা যাদের স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছেন তারা হয়ত সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন যে, নিজের দিনে জনসন ছিলেন একজন জেনুইন 'ম্যাচ উইনার'। আর তাঁর দুরন্ত অলরাউন্ড প্রতিভা নিয়ে তো নতুন করে বলারই কিছু নেই। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, উদ্বোধনী বোলার – নিল জনসনের 'অলরাউন্ডার সত্ত্বা' বোঝাতে আশা করি আর কিছু বলতে হবে না! হ্যাডলি, ক্লুজনার, স্টোকসদের মত জনসনও ব্যাট করতেন বাঁ হাতে, কিন্তু বল করতেন ডান হাতে। বল হাতে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল আউটসুইং। ডেথ ওভারেও কার্যকরী ছিলেন।

ভাবা যায়, নিল জনসনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স মাত্র দুই বছর! ক্যারিয়ার ছোট হলেও এই সীমিত সময়েই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে তিনি দিয়েছেন অনেক কিছু। রঙিন পোশাকের ওয়ানডে খেলেছেন ৪৮টি। যার প্রায় সবগুলোতেই ছিলেন ওপেনারের ভূমিকায়। ৩৬.৫০ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১৬৭৯ রান। ৪টি সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছেন ১১টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হার না মানা ১৩২ রান।

এছাড়া ওয়ানডেতে বল হাতে জনসনের ঝুলিতে আছে ৩৫টি উইকেট। সেরা বোলিং ১৯৯৯ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে ৪২ রানে ৪ উইকেট।

ওয়ানডের পাশাপাশি সাদা পোষাকেও বেশ উজ্জ্বল ছিলেন একসময়ের সাড়া জাগানো এই অলরাউন্ডার। ১৩ টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ৫৩২ রান; ব্যাটিং গড় মাত্র ২৫। তবে বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন ৬/৭ নম্বরে। ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটি এসেছিল ৬ নম্বরে নেমে, পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে; যার কথা ইতিমধ্যেই একবার বলা হয়েছে। আর কোন সেঞ্চুরি না পেলেও হাফ সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছেন ৪টি।

টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র ৯ ইনিংসে বল হাতে নিয়েছেন জনসন। আর তাতেই টেন্ডুলকার, ক্যালিস, সাঈদ আনোয়ার, চন্দরপলের মত টেকনিক্যালি সাউন্ড ব্যাটসম্যানের উইকেটসহ সাকুল্যে পেয়েছেন ১৫ উইকেট। সেরা বোলিং ৭৭ রানে ৪ উইকেট, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশ নেয়া জনসনের ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট-এ ক্যারিয়ারে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। 

১৬১টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে জনসনের সংগ্রহ ৭৫৬৯ রান এবং ২৩০ উইকেট। ব্যাটিং গড় ৩৫ এবং বোলিং গড় ৩৩। 

এছাড়া ২৩২ ম্যাচের লিস্ট-এ ক্যারিয়ারে তাঁর রয়েছে সাত হাজারের বেশি রান ও দেড় শতাধিক উইকেট।