সাক্ষাৎকার

‘আব্বু পাকিস্তান ভক্ত ছিলেন, তাই আমার নাম আফ্রিদি’

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 17:02 রবিবার, 10 মার্চ, 2019

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

চট্রগ্রামের ছেলে মিনহাজুল আবেদিন আফ্রিদি নেট বোলার থেকে বিসিবি একাদশ, রংপুর রাইডার্স ও শেখ জামালের মত বড় দলে জায়গা করে নিয়েছেন মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই। ২০ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনার সম্প্রতি ডিপিএল টি-টুয়েন্টির ফাইনালে শেখ জামালকে শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ খেলেছেন তিনি। বিপিএলে আফ্রিদির বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রিকফ্রেঞ্জির সাক্ষাৎকারে একজন নেট বোলার থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেয়ার গল্প বলেছেন আফ্রিদি।

পাঠকদের সুবিধার্থে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল...

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্ততি ম্যাচ সুযোগ পেলেন কিভাবে?

আফ্রিদিঃ ওই সিরিজের সময় আমি বাংলাদেশ দলের নেটে বোলিং করতে গিয়েছিলাম। প্রথম দিন বোলিং করার পর আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন নান্নু স্যার। চট্রগ্রামের স্থানীয় কোচ রাজ কুমার স্যারের কাছে আমার নাম কী, কই থাকি, এইসব ব্যাপারে খোঁজ নেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, আমি চিটাগং প্রিমিয়ার লীগ খেলেছিলাম। এছাড়া কোনো লীগ খেলি নি। তারপর তিনি আমাকে বলেছেন, তোমাকে নান্নু স্যার জিম্বাবুয়ের সাথে প্রস্তুতি ম্যাচে খেলার কথা বলতে বলেছে। পরের দিন রাতে বাশার স্যার ফোন দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি বিসিবি একাদশ দলে আছ। পরে বৃষ্টির জন্য প্রথম দিন তো খেলা হয়নি, পরের দিন আমরা ব্যাট করেছি। বিকেলের দিকে শেষ সেশনে গিয়ে বোলিং করার সুযোগ পাই। তিন ওভার বল করে এক উইকেট পেয়েছিলাম। এভাবেই ম্যাচটা খেলা, নেট বোলিং থেকে প্রস্তুতি ম্যাচে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ওই ম্যাচে সুযোগ পাওয়ার কী ভেবেছিলেন এত অল্প সময়ে এত দূর আসতে পারবেন?

আফ্রিদিঃ না, যখন ওই ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন চিন্তা করেছিলাম হয়তো কোনো এক সময় বিপিএল, ঢাকা লীগ, জাতীয় দল পর্যন্ত যাওয়া যাবে। আল্লাহ রহমতে এবারই বিপিএল খেললাম, সেখানেও নেট বোলার ছিলাম আমি। চট্রগ্রাম থেকে এসেছিলাম নেট বোলিং করতে। রংপুরের ক্যাম্পে একজন নেট বোলার দরকার ছিল। আমার কাছে কল এসেছিল, আমি নেট বোলিং করব কিনা ঢাকায় এসে। এরপর আমার কোনো কাজ ছিল না তাই চলে আসি ঢাকায় নেট বোলিংয়ের জন্য। এরপর তিনদিন বোলিং করার পর আমাকে জানানো হয় রংপুরের স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়ার কথা।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ রংপুরের নেট থেকে কে আপনাকে পছন্দ করেছে?

আফ্রিদিঃ আমাকে কোচ টম মুডি ও মাশরাফি ভাই পছন্দ করেছিল। ম্যানেজার মিতু ভাইও দেখেছিলেন।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এত বড় কোচ, অধিনায়কের পছন্দের ক্রিকেটার হয়ে গেলেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার আর আপনার পরিবারের অনেক বড় পাওয়া ছিল?

আফ্রিদিঃ জি, শুকরিয়া আল্লাহ’র কাছে। সবসময় আশা ছিল, আমার চেয়ে আমার আব্বুর আশা ছিল অনেক বেশি। আমি খুব ছোট থাকতেই বাবাকে হারিয়েছিলাম। তিনি প্রিন্টিং ব্যবসায়ী ছিলেন চট্রগ্রামের আন্দরকিল্লায়। তখন আমি ক্লাস থ্রি’তে পড়ি। আমার বাবার আশা ছিল আমাদের তিন ভাই এর একজন ক্রিকেটার বানাবেন। তিনিই আমার অনুপ্রেরণা। আব্বু মারা যাওয়ার পর সেই অনুপ্রেরণাই আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আর এলাকার কিছু বড় ভাই, যাদের হাত ধরে আমার ক্রিকেট খেলা শেখা, ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া, সেটাও বড় ব্যাপার ছিল।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বাবার হাত ধরেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি?

আফ্রিদিঃ জি, আব্বুই প্রথম ক্রিকেট খেলার কথা বলেন। ক্রিকেট খেলাটার প্রতি ভালো লাগার তৈরি আব্বুর হাত ধরেই। আব্বু ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ভক্ত। পাকিস্তানের খেলা থাকলে আর একই দিন বাসায় স্যার পড়াতে আসলে তিনি স্যারকে বলতেন, আয খেলা আছে, আজ পড়ার দরকার নেই। তিনি এমন ভক্ত ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বাবা পাকিস্তান ক্রিকেটের ভক্ত বলেই আপনার নাম আফ্রিদি?

আফ্রিদিঃ জি, আমার নাম এই কারণেই আফ্রিদি।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এবি ডি ভিলিয়ার্সের বিপক্ষে নেটে বোলিং করেছিলেন...

আফ্রিদিঃ রংপুর দলে সুযোগ পাওয়ার পর তখন আমাকে বিদেশি প্লেয়ারদেরকেই বেশি বল করতে বলা হয়। কোচ আমাকে বিদেশিদের বিপক্ষেই বেশি বল করতে বলত। তখন আমি নিজেকেই বলতাম, আজ আমি এই জায়গায় আছি, এখানে ভালো করলে আমি হয়তো অনেক উপরে যেতে পারব। আমি যা ক্রিকেট খেলেছি বেশির ভাগই স্থানীয় ক্রিকেটারদের সাথে। চট্রগ্রাম প্রিমিয়ার লীগে তেমন আহামরি কোনো প্লেয়ার থাকে না। তো আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম যে আমি পারব, আমাকে দিয়ে হবে। যদি আমি প্ল্যাটফর্ম পাই পারফর্ম করার। আমি চেষ্টা করেছি। কোচ আমাকে একটা কথা বলেছিল, ব্যাটসম্যানকে পড়ার চেষ্টা করতে এবং সেই অনুযায়ী বল করতে। আমি সেটাই চেষ্টা করি, কে ব্যাট করছে সেটা নিয়ে ভাবি না। ডি ভিলিয়ার্স তো বিশ্বমানের প্লেয়ার। যদি ওকে একই ভাবে বোলিং করেছি, যেভাবে আমি নিয়মিত করে এসেছি, দেখলাম যে ভালো হচ্ছে। টম মুডি অনেক বড় মানের কোচ, তিনি একটা কথা বলেছিল, সেই অনুযায়ী বল করে দেখলাম যে ভালোই হচ্ছে। সেইভাবেই ডি ভিলিয়ার্সকে বল করেছিলাম।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিপিএলের প্রথম ম্যাচের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

আফ্রিদিঃ আমি মাঠে যাওয়ার পর শুনেছিলাম আমি ম্যাচ খেলব, ড্রেসিং রুমে যাওয়ার পর। কোচ শেষে আমাকে বলে যে, আজ তুমি ম্যাচ খেলবে। তারপর তিনি বলেছেন, সাহস রাখ নিজের ওপর, প্র্যাকটিসে যা করেছ তাই করবে। মনে করবে এটা আরেকটা প্র্যাকটিস। তারপর মনে হচ্ছিল, এত বড় একটা মঞ্চে এত বড় দলের হয়ে খেলতে নামছি। অনেক বড় বড় প্লেয়াররা আছে দলে, ক্রিস গেইল, মাশরাফি ভাই, ডি ভিলিয়ার্স, বোপারা। স্বপ্নের মত মনে হয়েছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ মাশরাফির সাথে খেলেছেন...

আফ্রিদিঃ স্বপ্ন ছিল কোনো না কোনো সময় মাশরাফি ভাই এর সাথে দেখা করব। উনার সামনে যাবো, উনাকে দেখব সামনে থেকে। তিনি অনেক বড় মানুষ। কিন্তু রংপুরে উনার সাথেই খেলে ফেললাম। অনেক ভালো লেগেছিল, এত বড় দলে খেলতে পেরে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ডিপিএল টি-টুয়েন্টি ফাইনালে দারুণ বোলিং করেছিলেন...

আফ্রিদিঃ এই টুর্নামেন্টটা শুরু হওয়ার আগে সবাই এক্সাইটেড ছিল। সবার ইচ্ছে ছিল আমরা ভালো খেলব, ফাইনাল খেলব। সোহান ভাই সবসময় বলত, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা। আমি চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে খেলি নি। ফাইনাল ম্যাচটা অনেক বড় ম্যাচ ছিল। টিভিতে দেখানো হয়। প্রথমবারের মতন ডিপিএল টি-টুয়েন্টি খেলা হয়। ফাইনাল ম্যাচটা খেলব, অনেক এক্সাইটেড ছিলাম। আমাকে একদিন আগে জানানো হয়েছিল আমি ফাইনালের দলে আছি। টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ, সবাই আমার ওপর ভরসা রেখেছিল। শুকরিয়া আল্লাহ’র কাছে ভালো মতন গিয়েছে সব।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ লিস্ট ‘এ’ অভিষেক হয়েছে সম্প্রতি...

আফ্রিদিঃ আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় এসে প্রিমিয়ার লীগ খেলব। আমি যেই মানের বোলিং করি সেদিন সেই মানের বোলিং করতে পারি নি। অভিষেক ম্যাচ, ভালো শুরু করেছিলাম ম্যাচটায় কিন্তু শেষের দিকে ভালো হয়নি। আমার সেরাটা দেয়ার ইচ্ছে ছিল। আর বাংলাদেশের টপ লীগ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ। সামনে আরও ম্যাচ আছে, সুযোগ পেলে অবশ্যই ভালো কিছু করব। যেই মানের বোলিং করে এসেছি বিপিএল ও ডিপিএল টি-টুয়েন্টিতে, সেটা করতে চেষ্টা করব।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ লেগ স্পিনের শুরু হল কিভাবে...

আফ্রিদিঃ টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলতাম এলাকায়। তখন এলাকার কয়েকজন বড় ভাই আমাকে স্থানীয় ট্যালেন্ট হান্টে যোগ দিতে বলেন। আসাদুল ইসলাম, শামশেদ উল্লাহ রাজিব ও মানিক তাদের নাম। পাহাড়তলী ক্রিকেট ক্লাবের পক্ষ থেকে হান্ট হয়েছিল। ওই প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলাম আমি। উনারা আমাকে আসতে বললে আমি বলেছিলাম, আমি তো কিছু পারি না, কি করব এসে। উনার বলেছিল, তুই আয়, পরে দেখা যাবে। তারপর যাওয়ার পর আমাকে লেগ স্পিন করতে বলা হয়। ‘তুই যেভাবে শহীদ আফ্রিদির খেলা দেখস টিভিতে, সেভাবেই বল করবি,’ ওই বড় ভাই বলেছিলেন। আমি কিছুই জানতাম না, কিভাবে বল গ্রিপ করতে হয়, কিভাবে লেগ স্পিন করতে হয়। তারপর উনারা আমাকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে লেগ স্পিন করতে হয়। এইভাবেই লেগ স্পিন শুরু করি। এরপর চট্রগ্রামে মেরিডিয়ান বিজয় দিবস অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের একটা দলে উনারা খেলার সুযোগ পাই। প্রথম ম্যাচে তিন উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলাম। সেটা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ ছিল। সেখান থেকেই শুরু হয় সব। পরে চট্রগ্রামে অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে খেলেছিলাম। ২০১২ সালে সেই টুর্নামেন্টে খেলেছিলাম। সেখানে চার ম্যাচে আমি নয় উইকেট পেয়েছিলাম। এরপর দুই বছর ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে যায়।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ খেলা বন্ধ করার কারণ কী ছিল?

আফ্রিদিঃ তখন পড়ালেখার চাপের কারণে খেলা বন্ধ রাখি। আমার আম্মু বলেছিল, এখন আর খেলতে হবে না, একটু পড়ালেখা কর মনোযোগ দিয়ে, পরে আবার খেলা শুরু করলেও হবে। এরপর সব প্রেকটিস, খেলা বন্ধ। তারপর দুই বছর পর আবার প্র্যাকটিস শুরু করি। চট্রগ্রামের একটা একাডেমী আছে, সিরাজ ফোর এইচ একাডেমী, সেটায় ভর্তি হই। আমি এখনো সেই একাডেমীর ছাত্র। আমি বিপিএলের পরও সেখানেই অনুশীলন করেছিলাম আমি। সেখানে আমি প্রায় তিন বছর অনুশীলন করার পর আমি প্রিমিয়ার লীগ খেলার সুযোগ পাই চট্রগ্রাম আবাহনীতে। প্রথম বছর আমি ম্যাচ খেলতে পারি নি। অসুস্থ ছিলাম। গত বছর আমি খেলেছিলাম, দুটি ম্যাচ খেলে ছয় উইকেট নেই আমি। এরপর আমি জিম্বাবুয়ের সাথে প্র্যাকটিস ম্যাচ, এরপর বিপিএল ও এখন ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ খেলছি।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আইডল কে?

আফ্রিদিঃ শহীদ আফ্রিদি, তিনি আমার আইডল।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ভবিষ্যৎ নিজেকে কোথায় দেখেন?

আফ্রিদিঃ প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে বাংলাদেশ দলে খেলা, লাল সবুজের জার্সি গায়ে দেয়া, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। সেই স্বপ্নটা আমারও আছে। আমি বাংলাদেশ দল খেলতে চাই, বাংলাদেশ দলের নিয়মিত সদস্য হতে চাই। যেমন মাশরাফি ভাই, সাকিব ভাই, তামিম ভাই, মুশফিক ভাই ও রিয়াদ ভাইদের মতন হতে চাই। সবাই যেন মনে রাখে আমাকে, এমন কিছু করতে চাই। দেশকে কিছু দিতে চাই।