তাসকিনের প্রত্যাবর্তন

তাসকিন আহমেদ ২.০

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 15:31 রবিবার, 27 জানুয়ারি, 2019

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

পচেফস্ট্রুম  টেস্ট ২০১৭ সাল, বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ ও শফিউল ইসলামকে নিয়ে দল সাজায়। উইকেট বাউন্সি, পেস বোলিং বান্ধব, উইকেটে জোরে আঘাত করতে পছন্দ করে, এমন পেসাররা দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো করার কথা। যদিও পচেফস্ট্রুমের উইকেট ছিল সম্পূর্ণ প্রত্যাশার বিপরীত চরিত্রের, উইকেট ছিল মন্থর, কিপার বল ধরছিল অনেকটাই নিচু হয়ে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট অঙ্গনে তখন খালেদ আহমেদের নাম নিয়ে খুব একটা চর্চা হচ্ছিল না। একমাত্র তাসকিন আহমেদই চাহিদা পত্রের সাথে মিলে যায়। মুস্তাফিজের সাথে তাসকিন ও শফিউলই ভরসা। এই তিন বোলারদের নিয়ে গড়া বোলিং লাইন আপে গতির ঝড় তুলবেন তাসকিন, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। উইকেটের চরিত্রে নজর না দিয়ে গতিতে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করবেন তাসকিন।

কিন্তু তাসকিনের প্রথম স্পেলে ভিন্ন গণিত দেখাচ্ছিল স্পিড মিটার। ১২৫-১৩০ কিলোমিটারের আশেপাশে বল করছিলেন তাসকিন। ছিল না কোনো ধার, ছিল না ধারাবাহিকতা। ওভারের তিন-চার বল ভালো জায়গায় করে একটি বল ব্যাটসম্যানকে বাউন্ডারি হাঁকানোর জন্য উপহার দিতেন তিনি।

পচেফস্ট্রুমে প্রথম ইনিংসে তাসকিন বল করলেন ২৬ ওভার, ৮৮ রান দিয়ে উইকেট শূন্য রইলেন। বাংলাদেশের ব্যাটিং এর কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে তাসকিনকে বেশি ওভার বল করে হল না।

ব্লুমফন্টেইনের পরের টেস্টে একাদশে নেই তাসকিন আহমেদ ও শফিউল ইসলাম। বদলী হিসেবে সুযোগ পাওয়া শুভাশিষ রয় ও রুবেল হোসেন প্রথম ইনিংসে বল করেছেন যথাক্রমে ২৯ ও ২২ ওভার, একটি করে উইকেট নিতে গিয়ে দুই পেসারই রান দিয়েছিলেন ওভার প্রতি চার রান করে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ শেষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দলে সুযোগ মেলে তাসকিনের। কিম্বার্লি, পার্ল ও ইস্ট লন্ডনে তাসকিন সব মিলিয়ে বল করেছিলেন ২৪ ওভার, ওভার প্রতি ৮ রান দিয়ে উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২টি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যর্থতা, তার পূর্বে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ব্যর্থতা জমাট বাঁধতে থাকে তাসকিনের নামের পাশে। ফর্মহীনতার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনা মানসিকভাবে ২২ বছর বয়সী তাসকিনকে নড়বড়ে করে দেয়।

দুই মাস বাদেই ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট দলে জায়গা হল না তাসকিনের। ২০১৪ সাল থেকে টানা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে আসা তাসকিন প্রথমবারের মত ফর্মহীনতার কারণে দল থেকে ছিটকে পড়লেন। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে পান তাসকিন। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ভেঙ্গেছে কিন্তু মচকায় নি। তিনি বলেছিলেন,

'স্কোয়াড থেকে বাদ না পড়লে হয়তো আমার মধ্যে উপলব্ধি আসতো না। এখন যে ইচ্ছে শক্তি নিয়ে ট্রেনিং করছি তা ইতিবাচক।'

মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়লেও তাসকিন ভেঙ্গে পড়েছিলেন শারীরিক ভাবে। নিজেকে ফিরে পাওয়ার মিশনে পিঠের ইনজুরি নিয়েই খেলে গেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ (ডিপিএল)। পিঠের চোটে ব্যথায় রাতে ঘুম হারাম হয়েছে তাঁর।

বোলিংয়ে ছিল না কোনো ছন্দ, গতি কিংবা সেই পুরনো আক্রমণাত্মক মনোভাব। ২০১৮ সালের ডিপিএলের সেরা উইকেট শিকারির তালিকায় চোখ দিলে তাসকিনকে নাম খুঁজে পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

ইনজুরি নিয়েই প্রিমিয়ার লীগের নয়টি ম্যাচ খেলে পিঠের ইনজুরি আরও গুরুতর হয়। প্রায় চার মাস মাঠের বাইরেই থাকতে হয় তাসকিনকে। এই সময় বাংলাদেশ দল নিদাহাস ট্রফি, এশিয়া কাপের মতন বড় টুর্নামেন্টে খেলে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে খালেদ আহমেদ নামের দীর্ঘদেহী হিট দ্য ডেক হার্ড গোত্রীয় বোলারের নাম শোনা যেতে থাকে, ঠিক তাসকিনের মতই। নির্বাচকরাও আগ্রহ নিয়ে খালেদে সময় দিতে থাকেন।

অন্যদিকে ইনজুরির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন তাসকিন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে পিঠের ইনজুরি থেকে মুক্তি মিলে তাসকিনের। ফিট প্রমাণ করে বাংলাদেশ 'এ' দলের হয়ে আয়ারল্যান্ডের বিমান ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগা তাসকিনকে সিরিজের মাঝপথেই দেশে ফিরতে হয়।

চার মাস বাইরে থাকার পর আয়ারল্যান্ডে 'এ' দলের চতুর্থ ওয়ানডেতে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ৫ ওভার বোলিং করার পর ফিল্ডিংয়ের সময় আবার হাতে চোট পান। তালুতে দিতে হয়েছে দুটি সেলাই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তার হাতের ওই একই জায়গাতেই চার মাস আগে সাতটি সেলাই পড়েছিল।

জাতীয় দলে ফেরার লড়াই তো দূরের ভাবনা, তাসকিনের জন্য মাঠে ফেরার সংগ্রাম কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। এদিকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় খালেদ আহমেদের।

তাসকিন সম্প্রতি ইনজুরির সাথে নিজের সংগ্রামের সময় নিয়ে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই অনেক কঠিন ও অবসাদের, আপনি যখন ইনজুরিতে থাকবেন, দলের বাইরে থাকবে, পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যাবেন। আপনি তখন একা লড়াই লড়ে যাবেন, কেউ থাকবে না পাশে।‘

দীর্ঘ বিরতির পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট দিয়ে ফের দৃশ্যপটে আসেন তিনি। বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের এক ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ২৬ ওভার বল করে ৫ উইকেট নেন তিনি।

তবে তাসকিনের বড় পরীক্ষার মঞ্চ ২০১৯ সালের বিপিএল। ২০১৩ সালে এই টুর্নামেন্ট দিয়েই ইন্টারনেট সেনসেশনে পরিণত হয়েছিলেন তাসকিন। তৎকালীন চিটাগং কিংসের হয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামে সেদিন দুরন্ত রাজশাহীর বিপক্ষে ৩১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নজরে এসেছিলেন ১৭ বছর বয়সী তাসকিন। সেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

এবারের বিপিএলের শুরুতে সময় টিভিকে তিনি বলেছিলেন, ‘বিপিএলটা ভালো খেলে জাতীয় টিমে যেভাবেই হোক আমি ঢোকার চেষ্টা করবো। কারণ সামনে নিউজিল্যান্ড ট্যুর, তারপর বিশ্বকাপ আছে।'

তাসকিন জানতেন দলে ফিরতে হলে কি করতে হবে। জাতীয় দলের দুয়ারে কড়া নেড়ে নয়, বরং দুয়ারে সজোরে আঘাত করতে হতো তাঁকে। সিলেট সিক্সার্সের হয়ে ঠিক তাই করেছেন তিনি। নতুন বলে উইকেট নিয়েছে, উইকেট নিয়েছেন মিডেল ওভারে, ডেথ ওভারে।

ম্যাচের মোড় বদলে দেয়া স্পেল করেছেন। সিম পজিশন, উইকেট থেকে মুভমেন্ট আদায় করে নেয়া ইয়র্কারে ধাঁর বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাউন্সারগুলো ব্যাটসম্যানদের নাক ছুঁয়ে যাচ্ছে, সবই ফিরেছে বিপিএলের মধ্য দিয়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৭ সালের ১২৫-১৩০ কিলোমিটারের মিডিয়াম পেসার তাসকিন এখন বল করছেন তাঁর পুরনো ছন্দে, ১৪০ কিলোমিটারের আশেপাশে। প্রতিপক্ষ দলের তারকা ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বল করে সফল হচ্ছেন তিনি।

২০১৪-১৫ সালের সেই তাসকিনকে এই বিপিএলের মধ্য দিয়ে আবারো খুঁজে পেল বাংলাদেশ। নামের পাশে ইতিমধ্যে ২০ উইকেট জমা করেছেন তিনি, বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারদের তালিকার চূড়ায় তাঁর অবস্থান।

ইতিমধ্যেই টিকেট মিলেছে নিউজিল্যান্ডের, টেস্ট ও ওয়ানডে স্কোয়াডে রাখা হয়েছে ছন্দে থাকা তাসকিনকে। দীর্ঘ অপেক্ষা, অবসাদ, পুনর্বাসন, মানুষের কটু কথা জয় করে অবশেষে মাঠের পারফর্মেন্স দিয়েই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করেছেন তাসকিন।

'কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডের স্কোয়াড ঘোষণা করেছে। আমি এক বছর পর স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছি, এই জন্য অবশ্যই খুশি আমি। বিপিএলে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হওয়ার কারণে আমার দলে সুযোগ মিলেছে,’ সম্প্রতি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাসকিন।

২০১৪ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচ খেলা তাসকিন ২০১৯ সালের নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়ে পা দিতে যাচ্ছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপে ফিট থাকলে সেরা একাদশের অটো চয়েজ ছিলেন তাসকিন।

এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ওয়ানডে দলে অধিনায়ক মাশরাফির সাথে আছেন মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন ও সম্প্রতি ভালো পারফর্ম করা সাইফউদ্দিন। টেস্ট আঙ্গিনায় দারুণ সূচনা করা খালেদ আহমেদের সাথে থাকবেন আবু জায়েদ রাহি ও মুস্তাফিজুর রহমান।

একাদশে জায়গা করে নিতে হলে লড়াই করতে হবে তাসকিনকে। তবে মাঝের এক বছরের সংগ্রাম তাসকিনকে মানুষ হিসেবে অনেকটাই পরিণত করেছে। প্রত্যাশা থাকবে, মাঠে শুধু একজন পরিণত বোলার নয়, তাসকিনে একজন পরিণত ব্যক্তিও দেখতে পাবে বাংলাদেশ।